Ameen Qudir

Published:
2016-11-11 06:47:40 BdST

মনসুরের দোকানে কলা-পাউরুটি খেয়ে রুমে ফেরা সিএমসি স্ক্র্যাপ বুক


                      

 


ডা. ওমর ফারুক একান্নবর্তী

একঝাঁক বিকেল চড়ুই তেপান্তরের মাঠে জমে থাকা জলে স্নান সেরে ফিরে আসছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। ওদের গন্তব্য মেডিক্যালের অগুনতি ভেন্টিলেটরের খোপ।
সুতপা হিসেব করে দেখল, বাড়ি থেকে এসেছে আজ তিনমাস হল। এত দীর্ঘ সময় বাড়ির বাইরে থাকার অভিজ্ঞতা ব্যাচমেটদের মধ্যে সিফাত ছাড়া আর কারও নেই। ভেন্টিলেটর গলে ফুড়ুৎ করে একজোড়া চড়ুই করিডোরে নেমে আসে, নির্ভয়ে বেদম নাচে। চড়ুইদের দেখে তারও নাচতে ইচ্ছে হল।

ঠিক সাড়ে এগারোটায় কমিউনিটি মেডিসিনের লেকচার শুরু হবে। করিডোরের ওপ্রান্তে ম্যামকে দেখা যাচ্ছে। সুতপা শিস দিতে দিতে লেকচার গ্যালারিতে ঢুকল।

ম্যাম আজ পড়াচ্ছেন পাবলিক হেলথ। প্রথম আধঘণ্টা পড়িয়েছেন পাবলিক হেলথের সংজ্ঞা। লেকচার এককান দিয়ে ঢুকছে অন্যকান দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। সিফাত ছাড়া কাউকে মনযোগী মনে হল না। মেয়েরা চিরকুট আদানপ্রদান করছে, পাশের জনকে চিমটি কাটছে, সামনের জনের বেণী খুলে দিচ্ছে। সুতপার মাথায় একটা দুষ্টবুদ্ধি খেলা করছে।

চিরকুটে সুতপা লিখেছে, বড় ভাইয়া আপুরা নাকি না-বলে-কয়ে অর্থাৎ অটো নিয়ে কলেজ থেকে চলে যায়। অনেকটা স্কুল পালানোর মত।” হঠাৎ ম্যামের আওয়াজ শোনা গেল, রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছেন উনি। সামনের বেঞ্চের কেউ পাবলিক হেলথের সংজ্ঞা বলতে পারেনি। সিফাত হাত তুলে গরগর বলে গেল। ম্যাম বললেন, ভেরি গুড!

চিরকুট চালাচালির পর সিদ্ধান্ত হল, লেকচার শেষে সবাই গ্যালারিতেই থাকবে, অটোর ব্যাপারে আলোচনা হবে। আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হল, সামনে কুরবানির ইদ উপলক্ষে যে-ছুটি সরকারি ক্যালেন্ডারে আছে তার সাথে পনের দিন যোগ হবে। সবাই রাজি হলেও বেঁকে বসল এ-ব্যাচের মনিটর কাকলি। বলল, তোমরা বুঝতে পারছ না, আমরা কার্ড-টার্মে পিছিয়ে যাব! সবাই বেরিয়ে গেল লেকচার গ্যালারি থেকে। বসে রইল কেবল সুতপা, কোন এক অজানা কারণে এই গ্যালারির প্রতি তার মায়া হচ্ছে। সুতপা কি জানত অটো শেষে সবাই যখন ফিরে আসবে তখন ওর শেষস্মৃতি ধরে রাখার উদ্দেশ্যে এই গ্যালারির নামকরণ হবে ‘সুতপা লেকচার গ্যালারি’?

২.
মেডিক্যাল থেকে আন্দরকিল্লা যাচ্ছিল মনসুর। গলির মুখে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি জিপ দাঁড়িয়েছিল। মনসুর না-দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু পিছন থেকে ডাক আসলে তাকে ফিরতে হল।
কোথায় যাওয়া হচ্ছে, হে?
আন্দরকিল্লা, জেনারেল হসপিটাল।
তোমার হাতে এসব কী?
পোস্টমর্টেম রিপোর্ট।
দেখি।
কাগজপত্র দেখে মনসুরকে ছেড়ে দেওয়া হল। পিছন থেকে টুপি পরা একজন বলল, ভাগ যা সালে।

যুদ্ধ শেষে মনসুর বড় স্যারের কাছে যায়।
স্যার, আমি আর চাকরি করবো না, মিরসরাই চলে যাব।
বাড়িতে গিয়ে কী করবে? ফ্যামিলি নিয়ে এখানে চলে আসো, আমি ব্যবস্থা করছি।
মনসুর ফ্যামিলি না-এনে বড় ভাই হোসেনকে নিয়ে আসে। চট্টেশ্বরী রোডের হোস্টেলে নাস্তার খুপরি খোলে বসে দুই ভাই।

 

 

 

৩.
হোস্টেলের কেউ কেউ টিউশন করে মাসের হাতখরচ জোগাড় করে ফেলে, দুই-একজন আছে বাড়তি টাকা বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। সুভাষ সিনিয়রদের অনুরোধ করে, বন্ধুদের জানিয়ে রাখে— প্রফের আগে টিউশন ছাড়লে ওকে-ই যেন দেয়। সবাই আশ্বস্ত করে-- লেগে থাক, পেয়ে যাবি।
রাতে ডায়নিং বন্ধ হলে সুভাষ জুনিয়রদের নিয়ে ব্যাট-বল হাতে লবিতে চলে আসে ক্রিকেট খেলতে। ফিল্ডিং-এর ফাঁকে ফাঁকে সুভাষের চোখ লবির মেজেতে একটি বিজ্ঞাপন খুঁজে বেড়ায়— টিউটর আবশ্যক, অমুক নাম্বারে যোগাযোগ করুন। অমুক নাম্বারে কল দিয়ে, কথা বলে জানতে পারে— মিডিয়ার টিউশন, প্রথম মাসের বেতনের ৫০% এডভান্স দিতে পারলে টিউশন কনফার্ম। এর কাছে ওর কাছে ধার করে আর চলছিল না, এডভান্স দেবে কোথা থেকে!

খেলা শেষ করে মনসুরের দোকানে কলা-পাউরুটি খেয়ে রুমে ফিরে আসার সময় টিভি রুমটা একবার দেখে আসে। ফুটবল-ক্রিকেট বিশ্বকাপ এলে এই রুমটাতে শ্বাসরুদ্ধ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। ‘আর্জেন্টিনাই এবার বিশ্বকাপ নিয়ে যাবে’। ব্রাজিল সমর্থকরাও কম যায় কিসে! বলে, ফুটবল হাত দিয়ে খেললে অসম্ভব কিছু না।

কয়েক মাস পর। চাঁদপুরের নিবিড় কোন পল্লীতে প্রমীলা যখন সেলাই মেশিনে সুঁই-সুতা ঠিক করছিল, ঠিক তখন তার একমাত্র ছেলে সুভাষকে ওর-ই ব্যাচমেটরা কলেজ থেকে মারতে মারতে টিভি রুমে নিয়ে আসে। সেই টিভি রুম যেখানে একবার মিটিং বসেছিল ব্যাচমেটদের মধ্যে। নিজেদের মধ্যে গ্রুপিং-এর সমঝোতা করতে সুভাষই সেদিন মিটিং কল করেছিল।

সন্ধ্যা সাতটায় প্রিন্সিপ্যালের রুমে স্ট্যান্ডিং কমিটির জরুরি মিটিং বসে। অনির্দিষ্টকালের জন্য কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়, সবাইকে রাতের মধ্যে হোস্টেল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
সাড়ে সাতটায় গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিতে একটি অ্যাম্বুলেন্স ছাত্রনেতাদের নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয়। ঠিক সেই মুহূর্তে মেঘনার বুকে সহস্র ইলিশ ছটপট করে, প্রমীলার হাতে সুঁই বিঁধে— ‘উহ, লেগেছে’।
সাতটা পঁয়তাল্লিশে এক ব্যাটালিয়ন পুলিশ চট্টেশ্বরীর হোস্টেল গেইটে এসে দাঁড়ায়। ভেন্টিলেটর গলে একজোড়া চড়ুই করিডোরে নাচতে থাকে, খুনসুটি করে। পাখিদের স্বাধীনতা আছে আইন হাতে তুলে নেওয়ার।
লেখক : চিকিৎসক। সিএমসিয়ান।

আপনার মতামত দিন:


ক্যাম্পাস এর জনপ্রিয়