Ameen Qudir

Published:
2016-12-08 16:48:36 BdST

চাইনিজ 'MBBS ' বনাম বাংলাদেশী ডাক্তার


এই সত্য ঘটনায় ছবি মডেল হিসেবে দেয়া ।

_______________________________

 


ডা. জামান অ্যালেক্স

___________________________

হাসপাতালের গেইটে ঘ্যাঁচ করে গাড়ি থামার শব্দ পেলাম।আমি ইমার্জেন্সী রুমে অন্য একটি পেশেন্ট দেখছিলাম। ইমার্জেন্সী রুমটা হাসপাতাল গেইটের কাছাকাছি....

রুমে হুড়মুড় করে দিনমজুর বা শ্রমিক টাইপের দুই-তিনজন লোক তাদের গোত্রীয় আরেক বৃদ্ধ লোককে পাজাঁকোলা করে নিয়ে এসে বেডে শুইয়ে দিলো।সাথে সাথেই এক শ্যুটেড-বুটেড বাঙালি যুবক ও তার পিছে পিছে নাকে রুমাল দিয়ে এক চাইনীজ ঢুকলো, চাইনীজের চোখে-মুখে বিরক্তি স্পষ্ট, চ্যাং-ব্যাং ভাষায় কি যেন বললো....

বাঙালি যুবকটি দ্রুত আমার কাছে এসে বললো, "স্যার জানতে চাচ্ছেন, রুমটা এত অপরিষ্কার কেন?"...... যে পেশেন্টকে তারা নিয়ে এসেছে, তার সম্পর্কে কিছু না বলে ইমার্জেন্সী রুম নিয়ে তাদের চিন্তা...

আমি যথেষ্ট বিরক্ত হলাম, বললাম, "এটা অজপাড়া গাঁ'য়ের ইমার্জেন্সী রুম, কোন ফাইভস্টার হোটেল তো না! রোগীর কি সমস্যা সেটা বলুন..." কথাটি বলতে বলতে আমি বৃদ্ধ পেশেন্টের কাছে গেলাম।

যুবকটি চাইনীজ ভাষায় আমার কথাটি তার উর্ধ্বতন চাইনীজকে জানালো, চাইনীজের বিরক্তি আরো বাড়লো....

ঘটনা শুনলাম, এক বিদেশী NGO এর তত্ত্বাবধানে গভীর নলকূপ খননের কাজ করতে গিয়ে দিনমজুর বৃদ্ধ লোকটি পিছলে গিয়ে আহত হয়, টিন দিয়ে কেটে ডান হাতের মাঝামাঝি একটা জায়গায় কিছুটা রক্ত ঝরছে, তারও নিচে একটা জায়গায় বেশ ফুলে আছে।Fracture হবার সম্ভাবনা রয়েছে, রোগী ব্যাথায় কোঁ কোঁ করছে....

পেইন কিলার, Flucloxacillin নামে একটি অ্যান্টিবায়োটিক, টিটেনাস যাতে না হয়--সেজন্য TT ও TIG ইনজেকশন প্রেসক্রাইব করে হাতের জন্য X-ray অ্যাডভাইস করলাম এবং তা শ্যুটেড-বুটেড বাঙালি যুবকটিকে ইনফর্ম করলাম। চাইনীজের নাক থেকে রুমাল তখনো সরেনি.....

বাঙালি যুবকটিকে দেখলাম চাইনীজটিকে কি যেন বোঝাচ্ছে, মনে হয় আমার নেয়া গৃহীত পদক্ষেপগুলো।তাদের কথা শেষ হবার পর চাইনীজ মোটামুটি আমার দিকে তেড়ে এলো, বললোঃ

"ইতস্ এ সিম্পল ইনজুরি, ইজ নত ইত্? ওনলি পেইন কিলার ইজ এনাফ ডততর, হোয়াই টিটেনাস ইনজেতশন এন্দ এটস্-রে?.."

এতক্ষণে কাহিনী বুঝলাম, চাইনীজ ব্যাটার বেতন হয় ডলারে কিন্তু এই বাঙালি দিনমজুরের জন্য সে টাকা খরচ করতে নারাজ।তার উপর সে আমার ডাক্তারী জ্ঞানকেও চ্যালেঞ্জ দিচ্ছে! ব্যাটা কি আমাকে তার দেশের তথাকথিত চাইনীজ MBBS পাশ ডাক্তার মনে করছে নাকি!...

এমনিতে ইংরেজিতে কথা বলতে গেলে পাস্ট টেনস্-ফিউচার টেনস্ নিয়ে গোল পাকাই কিনা তা নিয়ে চিন্তায় থাকি।এহেন মেজাজ গরম অবস্থায় সেসবের ধার ধারলাম না, ভরাট গলায় বললামঃ" Right now, I am the doctor and I know better than you what I should do..."

কড়া কথায় চাইনীজ ব্যাটা পিছু হটলো, নাকে রুমাল দেয়া অবস্থায় সাথে আনা রোগী নিয়ে দৃশ্যপট থেকে বিদায় নিলো....

ঘন্টাখানেক পর এক্সরে করে দৃশ্যপটে আবার চাইনীজ (অবশ্যই নাকে রুমাল দেয়া), সাথে তার স্যুটেড বুটেড দোভাষী চামচা, দিনমজুরসকল ও বৃদ্ধ রোগী।চাইনীজের চোখে মুখে বিজয়ের হাসি....

আমি এক্সরেটা দেখলাম, কোন Fracture নেই। যা বুঝলাম-চাইনীজ ব্যাটা এক্সরে টেকনেশিয়ানের কাছ থেকে ইনফর্মড হয়েছে যে -এক্সরে নরমাল।বিজয়ের হাসির কারণ বুঝতে পারলাম....

মিঃ চ্যাং: এনিথিন রন্ ডততর?( চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক)

আমিঃ No, no fracture is there. The treatment that I have given, should be continued for 7 days, nothing more...

মিঃ চ্যাং: হেহ্ (চাইনীজরাও বাঙালিদের মত তাচ্ছিল্য নিয়ে 'হেহ্' করতে পারে--তা জানা ছিলো না)....দেয়ার ইতজ্ নাথিং রন্, আই সেইত ইউ আরলিয়ার, ইতজ্ নত ইত্?

আমিঃ Yap, you are right.But you know what--'nothing wrong' is also a finding for us. If fracture is there, my treatment protocol would change...

মিঃ চ্যাং: হেহ্...পুওর পিপল এন্দ পুওর ডততর....

What the hell! কত্ত বড় সাহস " পুওর পিপল এন্ড পুওর ডততর "!!! মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হলো। বাইরে তা প্রকাশ করলাম না।

১৯৭১ এ এরা ছিলো আমাদের বিপক্ষে। তার উপর আমার দেশে এসে আমার দেশের আহত লোককে কমপ্লিট চিকিৎসা করতে না চেয়ে 'পুওর' বলে, আর আমাকে বলে 'পুওর ডততর'!!!

মনে মনে বললাম, "চাইনীজ ম্যান, ঘুঘু দেখেছো, ফাঁদ দেখোনি। প্রতি সপ্তাহে মিনিমাম একবার চাইনীজ খাই আমি..."

MRCP(UK) এর লাস্ট ফেইজের (পেসেস) প্রিপারেশন নিতে গিয়ে এক জায়গায় পড়েছিলাম, UK তে কোন Employe জব করতে গিয়ে কোনভাবে অঙ্গহানির শিকার হলে বা কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে Compensation claim করা যায় এবং যৌক্তিক হলে জব প্রোভাইডিং অথোরিটি সেটা পূরণ করতে বাধ্য। এ জিনিস আমাদের এই দেশে আছে কিনা--তা আমার জানা নেই।ভাবলাম, ঢিল মেরে দেখি কি হয়.....

চাইনীজ ব্যাটা দেখি ধমকের সুরে গরু তাড়ানোর মত করে দিনমজুর রোগীটিকে বলছে, "ওকে, লেতস্ গো, লেতস্ গো, ইতজ্ আ সিম্পল ইনজুরী"....

আমি বললাম, "Wait a bit..."

মিঃ চ্যাং থমকে দাঁড়ালো, বললো, "হোয়াত?"

আমিঃ হ্যাভ ইউ অ্যারেন্জড্ কমপেনশেসন ?

মিঃচ্যাং: (ভুরু কুঁচকে)হোয়াত কমপেনশেসন?

আমিঃ[লম্বা বাক্য, কাজেই বাংলায় বলি] বাহ্, তোমাদের কাজ করতে গিয়ে লোকটি আহত হয়েছে, তার বিশ্রাম প্রয়োজন এবং এ সময়টায় সে কাজ না করলেও তাকে বেতন দিতে হবে...

[কথার কিছু অংশ বোধহয় চৈনিক ব্যাটার বুঝতে সমস্যা হচ্ছিলো, দোভাষী চামচাটা হাত-টাত নেড়ে তাকে বুঝিয়ে দিল।বোঝানোর পর দোভাষীটা দেখি গম্ভীর হয়ে শুধু শুধুই মাথা দোলাচ্ছে]

মিঃচ্যাং: হাউ ফানি! নো ওয়ার্ক, নো পেমেন্ত...

আমিঃদেখো মিস্টার, খালি ওয়ার্ক পেমেন্ট না, ইনজুরী বাবদ একটি এমাউন্টও আইনগতভাবে এই রোগীকে তুমি দিতে বাধ্য, চিকিৎসার খরচ তো বটেই....

দোভাষী আবার আমার কথাটুকু চাইনীজকে বুঝিয়ে বলে আরো গম্ভীর হয়ে মাথা দোলানোর পরিমাণ বাড়ালো....

মি চ্যাং :(চিৎকার করে) নো পেমেন্ত, নো কমপেনশেসন...

"নো পেমেন্ত, নো কমপেনশেসন"!!! বলে কি! আইজ পাশা খেলবো রে শ্যাম....

রুমে থানার নাম্বার ঝোলানো ছিলো, সব সরকারী হাসপাতালেই তা থাকে।সেদিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললামঃ

"তাহলে, আমাকে পুলিশকে জানাতে হবে।আইনগতভাবে(!) পেমেন্ট আর কমপেনশেসন নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমার...."

মিঃ চ্যাং : (ভড়কে গিয়ে)পুলিশ!!! নো, নো, ডততর, নো পুলিশ।পেমেন্ত এন্দ কমপেনশেসন, ইতস্ ওকে, ওকে....

চৈনিক ব্যাটা নাক থেকে রুমাল সরালো...

চামচাটা দেখি এবার হাসতে হাসতে মাথা দোলাচ্ছে।এই প্রথম মনে হলো-চামচা হলেও ব্যাটা বাঙালি, চাপে পড়ে চামচামি করছে....

বুঝলাম, বাঙালি যেমন পুলিশ ভয় পায়, চৈনিকরাও সেরকমই.....

বৃদ্ধ দিনমজুর লোকটিকে সব বুঝিয়ে বললাম, বললাম-১৫ দিন তো রেস্ট পাবেনই, সে সময়টার জন্য বেতনও মিস যাবে না।চিকিৎসার সব খরচও আপনার নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বহন করবে।চিন্তার কিছু নেই.।

বৃদ্ধের চোখের কোণে যে আত্মতৃপ্তির অশ্রু জমে উঠেছিলো, তা কিন্তু আমার চোখ এড়ায়নি ।

____________________

 


ডা. জামান অ্যালেক্স, জনপ্রিয় কথাশিল্পী। লোকসেবী চিকিৎসক।

আপনার মতামত দিন:


ক্যাম্পাস এর জনপ্রিয়