Ameen Qudir

Published:
2018-04-11 16:57:29 BdST

ফরেনসিকীয় আত্মহত্যার কল্পকথা


এটি প্রতিকী ছবি।

ডা. শরীফুল আলম রুবেল
___________________________

আজ ফরেনসিক মেডিসিন ডিপার্টমেন্ট বেশ এলার্ট। সকাল ৮টা থেকেই সাজসাজ রব। কোন এক ‘মেডিকেল পার্সন’ গতরাত্রে আত্মহত্যা করেছেন। বিভাগীয় প্রধান স্যার গতরাত্রে সবাইকে ক্ষুদে বার্তায় সতর্ক করে দিয়েছেন, “কাল ৮টায় সবাই মর্গে থাকবেন,আমি আসব।”
সিনিয়র লেকচারার স্যার-ম্যামরা সকালে এসেই ময়নাতদন্তের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি দেখে নিচ্ছেন। মর্গ এসিস্ট্যান্টদের ধমক-ধামক দিচ্ছেন,
গ্লাভস সবগুলা খোলা কেন ?
ম্যাকিনটোস এত কম কেন?
স্কালপেল স্টেরাইল না কেন ?
বেচারারা চোরের মতো মাথা নিচু করে আছে,সিনিয়র লেকচারারদের উপর কী ই বা বলবে; এসব তো সরকারী বরাদ্দে পাওয়া মাল।

আমরা পোস্ট গ্রাজুয়েট (ডিএফএম) স্টুডেন্টরা আছি মহাবিপদে।হেড স্যার এত সকাল সকাল আসা মানেই,রাতে ঊনার কম ঘুম হবে। আর স্যার কম ঘুমালে প্রশ্ন করবেন বেশী,মাথা থাকবে গরম। আর মৃতদেহ সামনে রেখে শুরু হবে ‘আত্মহত্যা সম্পর্কিত প্রশ্নোত্তর পর্ব’। প্রশ্ন যে সংজ্ঞা,প্রকারভেদ,পোস্টমর্টেম ফাইন্ডিংস এ সীমাবদ্ধ থাকবে না তা সহজে অনুমেয়। সকল ডিএফএম গেলাম সিনিয়র লেকচারারের কাছে,হাতে বই-খাতা-কলম।কিছু টপিকস জেনে না নিলে আজকে ইজ্জত দফারফা। লেকচারার স্যার অবশ্য ব্যস্ত ‘মর্গের নষ্টলাইটের আলো’ নিয়ে। আমরা এই চিল্লাফাল্লার মাঝেও গেলাম,নিজেদের ইজ্জত বাঁচানো ফরজ।

লেকচারার স্যারঃ সূর্যের আলো ছাড়া ময়নাতদন্ত কেন করি না?
আমাদের দলগত উত্তরঃ ইনজুরি এবং ডিজিজ কন্ডিসন সূর্যালোক ছাড়া বুঝা কঠিন।

লেকচারার স্যারঃ মৃতদেহে কী কী ইনসিশন দেব? একটাও বাদ দিবা না,মেডিকেল পার্সনের ডেডবডি বলে কথা।
আমাদের দলগত উত্তরঃপ্রথমে থুতনি থেকে তলপেট পর্যন্ত কাটব,বুকের হাড় ভেঙ্গে ফুসফুস ও হার্ট বের করব।সাথে পেটের সব ভিসেরা যেমন পাকস্থলি,কলিজা,কিডনি,ইন্টেস্টাইন বের করব। এগুলোর ভেতর-বাহির দেখতে ‘পেঁয়াজের মতো’ কাটব।প্রয়োজনে বিষের উপস্থিতি জানতে ল্যাবে পাঠাব। মাথা ও একইভাবে ব্যবচ্ছেদ করে ‘মগজ’ বের করে পরীক্ষা করব। হাতে-পায়ে ‘ডিফেন্স উন্ড’ দেখতে ৮ টা ইনসিসন দেব।

লেকচারার স্যারঃ আর,আর........
আমাদের দলগত উত্তরঃজিহবাসহ,গলার ভেতর দেখব। হেংগিং এর টিপিক্যাল সাইন খুঁজব।

লেকচারার স্যারঃ পুরুষ হলে কী বাকী থাকল,ইনকমপ্লিট ময়নাতদন্ত করার চেয়ে না করাই ভালো।
আমরাঃ নিশ্চুপ,এ ওর মুখ চাই। সবই তো দেখা হইছে। বাকী তো কিছু নাই।

লেকচারার স্যারঃ স্ক্রোটামে ইনসিসন দিবা না,পায়ুপথ দেখা লাগবে না ? প্রয়োজনে গোশতের টুকরা হিস্টোপ্যাথ ল্যাবে পাঠাব ‘রোগ নির্ণয়ের’ জন্য। কোন নীলাফুলা জখম থাকলে তাতেও ব্যবচ্ছেদ করা লাগবে। আর মনে রাখবে ফাঁস লাগা স্থানের ‘চামড়া’ কেটে ও ল্যাবে পাঠানো উচিত।

আমরা একসাথে মাথা চুলকালাম,এত্ত ব্যবচ্ছেদ করা হলে তো রিপেয়ার করতে প্রচুর সময় লাগবে।তার উপর পুলিশের দেয়া কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করতে হয়। আত্মীয়-স্বজনের সাক্ষাৎকার ও অনেক সময় নেয়া লাগে।অবশ্য এতো বিশাল হাঙ্গামা করতে আমরা বাধ্য।কারণ, একটা পূর্ণাঙ্গ ময়নাতদন্তের মাধ্যমে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ বের হয়ে আসে।আর কে না জানে,সুষ্ঠু তদন্তের জন্য ময়নাতদন্ত আবশ্যক এবং রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।

লেকচারার স্যার আবার মর্গ এসিস্ট্যান্টদের নিয়ে পড়েছেন,ওরা ভিসেরা সংরক্ষণের লবণ ঠি কঠাক স্যাটুরেটেড করেনি। শেষ প্রশ্নটা সুযোগে করেই ফেললাম, “আজকে কী সত্যিই মেডিকেল পার্সনের পোস্টমর্টেম হবে ?”
লেকচারার স্যার মুখ ফিরিয়ে মুখ কালো করে বললেন,হ্যা হবে।আমাদের মতোই কারও ময়নাতদন্ত হবে।যার দুইদিন পর ডাক্তার হবার কথা অথবা ডাক্তার হয়ে স্বল্প খরচে রুগী দেখার কথা,সেরকম এক হতভাগ্যের আজ পোস্টমর্টেম হবে। বাবা-মা,বন্ধু-পরিচিতরা বাইরে আফসোস করবে আর আমরা তাঁর বুকে ছুরি চালাব,নিজেদের বুকে পাথর রেখে। রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে,আবেগের কোন স্থান নেই। তবে তোমাদের চোখে পানি আসবে জানি,পানি দেখে হেড স্যার ধমকিয়ে বলবেন “লায়ন্স হার্ট না হলে কোর্স ছেড়ে দাও,ছিঁচকাদুনেদের জন্য অন্য প্রফেশন।আমরা কাঁদি না,কাঁদতে জানিও না।” তখন বলিও, “স্যার ফরমালিনের জন্য চোখে পানি আসছে।” তবে বোকাগুলার জন্য মনটা খারাপ লাগে রে, বাঁচলে ভালো হইত,সবার পোস্টমর্টেমে হাত অবিচল থাকে না.......

বাইরে গাড়ীর আওয়াজ শুনা যাচ্ছে,মৃতদেহ এল বলে। সুরতহাল,চালান দেখি অনেকগুলা। নামগুলা পড়া শুরু করলাম,আত্মহননের তারিখসহ,সবাইকে চেনা মনে হচ্ছে,চোখে ফরমালিন কাজ শুরু করেছে......

১.মেহেদী হাসান ফারুক,কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ; ৪ঠা মে ২০১৮।
২.তানহা রহমান শ্রেয়া,শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ; ১০ই মার্চ ২০১৮ ।
৩.জান্নাতুল ওয়াহিদা মিতু,রাজশাহী মেডিকেল কলেজ; ১০ই ফেব্রুয়ারি ২০১৮।
৪.বিনিসা শাহ (নেপাল),পাইওনিয়ার ডেন্টাল কলেজ; ১৯শে ডিসেম্বর ২০১৭।
৫.রাওদা আতিফ(মালদ্বীপ),রাজশাহী ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ; ২৯শে মার্চ ২০১৭।
৬.শিরিন আক্তার রেখা,চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ; ...সময়..অজানা..।
৭.হাবিবা কুলসুম খুশী,উত্তরা মেডিকেল কলেজ;১৯শে জুলাই ২০১৭।
৮.ডা.এনজেল শুভাগত বৈদ্য,এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর সার্জারী,জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ; ৫ই ডিসেম্বর ২০১৩।
৯.মো. নাহাল,ঢাকা মেডিকেল কলেজ; ১০ই ডিসেম্বর ২০১০।
১০.ডা. রবিউল, দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ; ...সময়..অজানা..।
১১.ঢাকা মেডিকেল কলেজের আরও একজনের নাম জানা যায়নি;২৫শে ফেব্রুয়ারি ২০১৮।

https://youtu.be/mXsdy6UnGVI
(ইহা কল্পকাহিনী,আমাদের প্রতিদিনের বাস্তবতার নিরিখে লেখা,কারও সাথে মিলে গেলে কাকতালীয়। ভিডিও তৈরীতে ব্যবহৃত ছবি ও তথ্য অনলাইন থেকে সংগৃহিত যা মাইকেলস অব মেডিকেল দ্ধারা অণুপ্রাণিত)
ভিডিও লিঙ্ক : https://www.facebook.com/Shariful.Alam.Rubel1464/videos/2094822347450901/
_______________________________

ডা. শরীফুল আলম রুবেল । চিকিৎসক। আলোকচিত্রী ও লেখক।

আপনার মতামত দিন:


ক্যাম্পাস এর জনপ্রিয়