DESK

Published:
2024-11-13 17:53:47 BdST

প্রিয় বাবলু, চোখ ভরে যাচ্ছে জলে!


অধ্যাপক ডা. আহমেদ আবু সালেহ, বাবলু, এক পারিবারিক আয়োজনে। সর্ব ডানে । ছবি সৌজন্য অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল

 



অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, কথাসাহিত্যিক
________________

বাবলু, প্রিয় বাবলু, আমাদের বাবলু! অধ্যাপক ডা. আহমেদ আবু সালেহ, বাবলু।
কী লিখব! লিখতে পারছি না! চোখ ভরে যাচ্ছে জলে! বুকটা জ্যাম হয়ে গেছে!
সকালে ঘুম থেকে উঠে সাধারণত সাহিত্যবিষয়ে নতুন নতুন পোস্ট দিই । বহুদিনের অভ্যাস আমার । সবাই বলে আমি জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্য উপহার দিয়েছি। দিয়ে যাচ্ছি।আজ উঠতে দেরি করেছি। মিলি এখনও ঘুমে। ওকে ডেকে তুলিনি। গতকাল নাকি সব বন্ধুরা দল বেঁধে আইসিইউর সামনে বসে কান্নাকাটি করেছে।
আজ সকালে মোবাইল খুলে বসার সঙ্গে সঙ্গে স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম প্রায় এক ঘন্টা। অপ্রতিরোধ্য মৃত্যুর হাত থেকে আমরা কেউ রেহাই পাব না। কিন্তু আমাদের বাবলুর মৃত্যুটা মেনে নিতে পারছি না। রচিত হয়ে গেছে বাস্তব জীবনের নিষ্ঠুরতম সাহিত্য। মনে হচ্ছে আমি ভুল দেখছি ফেসবুকে ।
ভুল! ভুল ! ভুল!
মনে হচ্ছে আসলেই আমি কোনো সাহিত্য লিখতে বসেছি, প্রতিদিনের মতো। মনে হচ্ছে বাবলু কমেন্ট করবে কিংবা ওর প্রিয়তমা স্ত্রী হেলেন বলবে, অসাধারণ হয়েছে, দুলাভাই !
সম্ভবত এক মাসও হয়নি। ওদের বন্ধু লন্ডনের বিখ্যাত অঙ্কোলোজিস্ট লিজা এসেছে ঢাকায়। এক ঘণ্টার নোটিশে মিলি বাসায় আয়োজন করল ছোট্ট একটা গেট টুগেদারের। আমি বাসায় নেই। ওরা যে কজন এসেছে , দলবেঁধে এসেছে। উল্লাস আর উচ্ছ্বাস নিয়ে এসেছে ।
সবচেয়ে উৎসাহী ছিল বাবলু।
ওরা সবাই ক্লাসমেট , ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবী! আর আমি ওদের বড়ভাই। মিলির সুবাদে সবাই আমাকে দুলাভাই বলে ডাকে। ওরা এসওএমসি১৮। উল্লাসের সঙ্গে ওরা বলে, ওদের বয়স থেমে আছে ১৮তে।
একদম ঠিক। আজ এ-বাসায় ,কাল ও-বাসায়, প্রায়ই চলে ওদের সম্মিলন । কখনো মনে হয়নি যে ওরা ১৮ পেরিয়েছে। আর এই তারুণ্যময় উৎসবের উচ্ছ্বসিত মাস্টারমাইন্ড হলো বাবলু। সে ডাক দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই একত্রিত হয়ে যায় ,যখন যেখানে পারে সেখানে । হুট করে আমি কোথাও যেতে পারি না। মিলি চলে যায়। তাদের আড্ডা আর উৎসবের ছবি পাঠায়। আমি ছবি পোস্ট দিয়ে ওদের আনন্দের ভাগ নিয়ে ফেলি।
ওরা কখনো চলে যায় গ্রামেগঞ্জে, নৌকায় ঘুরে বেড়ায়, গাছে চড়ে। ওরা ১৮ । দলটা তাই আমার খুব প্রিয়।
সেদিন আমি বাসায় নেই। দিনমজুরিতে ব্যস্ত। রোগী রেখে উঠে আসতে পারছি না। বাবলু বলেছে , 'ওঠা যাবে না। মোহিতভাই আসা পর্যন্ত আমাদের আড্ডা চলতে থাকবে।' আড্ডা চলতে লাগল। শেষ-মুহূর্তে এসে ওদের সঙ্গে বসলাম। গ্রুপ ছবিতে তাই আবিষ্কার করলাম নিজেকে।
হঠাৎ বাবলুর দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম।
ওর স্বাস্থ্য কি একটু খারাপ হয়ে গেছে! মনে প্রশ্ন জেগেছে , কিন্তু কিছুই জিজ্ঞেস করলাম না। সবার আনন্দে আমিও শরিক হয়ে গেলাম। একমাসও হয়নি।
বাবলু ছিল জাসদের ছাত্রনেতা। আমাদের বন্ধু মোহসীন ছাত্রলীগের, ফারুকী ছাত্রশিবিরের, বজলুল গনি ভূঁইয়া ছাত্রদলের। সবার মধ্যে ছিল অসাধারণ বন্ধুত্ব। আমাদের সময় রাজনীতি কারও মধ্যে বিভাজন তৈরি করেনি। সবাই ছিল অন্তরঙ্গ কিন্তু রাজনীতির মাঠে প্রকৃতই রাজনীতিবিদ ।
মেডিকেল কলেজে খেলাধুলায় বেশি সক্রিয় ছিলাম আমি। হোস্টেল-টিমে খেলেছি, ক্লাস-টিমেও । কলেজ-টিমেও খেলেছি, আন্তঃমেডিকেল কলেজ ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি, মেডিকেল কলেজের টিম সদস্য হিসেবে লিগেও খেলেছি। সেই সুবাদে সবার কাছে প্রিয় ছিলাম । আর সব নেতাদের ভালোবাসা পেয়ে ধন্য হয়েছি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমাকে সম্মানিত করেছে আমাদের বাবলুর নানা সময়ের সাহচর্য । আরেকজন ছিলেন মঞ্জু ভাই, করোনাকালে আমরা তাঁকে হারিয়েছি। ছাত্রদলের শাহরিয়ার ভাই আর জাসদের ছাত্রনেতা মঞ্জু ভাই নির্বাচনের সমান সংখ্যক ভোট পেয়ে ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। উভয়ের ভালোবাসা পেয়ে ধন্য হয়েছি। ছাত্রলীগের দুলাল ভাইও স্নেহ করতেন আমাকে, ছাত্রশিবিরের আবদুল হাই ভাইও। আর এঁদের মধ্যে যোগাযোগটা মজবুত করে দিয়েছিল আমাদের বাবলু। বাবলুর সঙ্গে সবার ছিল আশ্চর্য সখ্যতা!
বিস্ময়কর কথা হলো , সব দলের নেতাদের কাছে সে ছিল প্রিয়। এটা একজন রাজনীতিবিদের বড় কৃতিত্ব হিসেবে দেখি আমি। রাজনীতি অর্থে রাজনীতির এটা একটি বড় মানদন্ড হওয়া উচিত।
আমার মনে হচ্ছে, এক শতাব্দীতেও এমন ভালো আর গুণী সন্তান পাবে না দেশ। তাঁর সাবজেক্টের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিল সে। দেশকে পর্যাপ্ত সেবা দিয়ে গেছে।বিভাগীয় চেয়ারম্যান হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছিল। সেই সুবাদে শত শত যোগ্য উত্তরসূরী তৈরি করে গেছে। তাঁরাও তাঁদের গুণী শিক্ষকের মতো সফলভাবে দেশসেবা চালিয়ে যেতে থাকবে। বিশ্বাস আমার।
তাঁর কর্মস্থল বিএসএমএমইউ, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিইউতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল আমাদের প্রিয় বাবলু, অধ্যাপক ডা. আহমেদ আবু সালেহ।

আপনার মতামত দিন:


বিএসএমএমইউ এর জনপ্রিয়