Ameen Qudir
Published:2017-01-02 19:37:14 BdST
ডাক্তারদের বিরুদ্ধে অভিযোগের মোক্ষম জবাব
প্রবাসী আহমেদ স্বাতীর ১০০ টাকা ভিজিটের দাবি ডাক্তার প্রতিদিনের প্রকাশের পর ঝড় তুলেছে অনলাইন মিডিয়ায়।
জবাব দিলেন ডা. আইনুল হক।
_________________________
ডা. আইনুল হক
___________________________
কোন একজন ভদ্র মহিলা নামিদামী এক রেস্টুরেন্টে খেতে খেতে স্ট্যাটাস দিলেন, ডাক্তারদের ভিজিট ১০০ টাকার বেশি হওয়া উচিৎ নয়। সেটা ডাক্তার প্রতিদিনে প্রকাশের পর অমনি শুরু হয়ে গেল চিকিৎসক আর আমজনতার যুক্তি-পাল্টা যুক্তি, আকথা-কুকথা আর দেশ নিয়ে বাহারি সব মতামত।
ভাই, আপনি একজন মোবাইল মেকারকে পাচশত টাকা দিতে কার্পণ্য করেন না অথচ নিজের জীবনের দাম একশত টাকার নিচে ধরেন। আপনার জীবন কি এতই অদামী? সত্য কথা কি জানেন দাদা, যেদিন থেকে ডাক্তাররা একশ টাকা ভিজিট নিতে শুরু করবে সেদিন থেকেই আপনি আর তাকে দেখাবেন না। কারণ আপনি নিজের জীবনকে এতটা মূল্যহীন যেমন ভাবেন না, তেমনি বেশী টাকায় বড় ডাক্তার দেখিয়ে বলে বেড়ানোর সুখটাও হাত ছাড়া করবেন না।
আবার কেউ কেউ বলেন আমাদের দেশের ডাক্তারদের ব্যবহার খারাপ তাই সবাই বিদেশে যায়। সবার না হলেও অনেকের ব্যবহার খারাপ এটা যেমন সত্য, আবার শুধু ব্যবহার খারাপের জন্যই বিদেশে যায় এটাও তেমনি অসত্য।
যে দেশের আলু পটল না হলে কারও বাজার সম্পুর্ন হয় না, যাদের টিভি পোগ্রাম না দেখলে মা-খালাদের পেটের ভাত হজম হয় না, যে দেশের সিনেমা না দেখলে পাবলিকের রাতের ঘুম ভাল হয় না, যাদের শাড়ি-কসমেটিকস না হলে আমাদের রমণীদের একটা দিনও চলে না, যাদের গরু না আসলে বাঙ্গালদের মাংসের চাহিদা মেটে না- তবে কেন চিকিৎসার বেলায়ই ডাক্তারদের গুষ্টি উদ্ধার হয় আমার মাথায় আসে না।
এবার আসেন এদেশের চিকিৎসকদের সফলতার কিছু গল্প শোনাই:
১) WHO বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মানের উপর Ranking প্রকাশ করেছে যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৮ তম আর ভারতের অবস্থান ১১২ তম। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র শ্রীলঙ্কার অবস্থান বাংলাদেশর উপরে (৭৬ তম)। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়নের সেই মহান কারিগর কারা?
২) ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৩৯ বছর আর ভারতের ছিল ৫০ বছর। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে দাড়িয়েছে ৭৪ এর কাছাকাছি। ভারতের গড় আয়ু বাড়লেও তারা আমাদের কাছাকাছি আসতে পারেনি। এতে অবদান কাদের?
৩) ২০০০ সালে জাতিসংঘ "সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা" ঘোষণার মাধ্যমে ৮টি লক্ষ্য নির্ধারণ করে, যার মধ্য ৩ টি ছিল স্বাস্থ্য সম্পর্কিত। এই তিনটি লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ এতটাই সফলকাম হয় যে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে MDG বাস্তবায়নের "রোল মডেল" হিসেবে ঘোষণা করে। এতে অবদান বেশী ছিল কাদের?
৪) সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিতে বাংলাদেশের সাফল্য প্রায় ৭৬%, যা কিনা উন্নত দেশগুলোর প্রায় কাছাকাছি ( কানাডা ৮০%, ডেনমার্ক ৮৯%)। এই সফলতা কাদের শ্রমের ফসল বন্ধু?
৫) ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে পাচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর হার ছিল প্রতি হাজারে ১৪৬ জন, যা ২০১৩ সালে ৪৬-এ নেমে এসেছে। নির্ধারিত সময়ের আগেই তা পূরণ হয়েছে কারণ ২০১৫ তে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৮ ।
৬) ১৯৯০ সালে মাতৃ মৃত্যুর হার ছিল ৫৭৪, যা ২০১৩ তে নেমে এসেছে ১৭০ এ। এটা কিভাবে সম্ভব হল?
বাপ দাদাদের মুখে শুনেছি তারা নাকি কার্তিক মাস কে খুব ভয় পেতেন। কার্তিক মাস পেরুলেই তারা হাফ ছেড়ে বাচতেন। কারণ ঐ সময় অসংখ্য লোক ডায়েরিয়ায় মারা যেত। আজ যারা দেশের বড় বড় পদ দখল করে আছেন অথবা দেশ জাতির চিন্তায় যাদের কি বোর্ডের বারোটা বাজছে, ICDDRB যদি ওরাল সেলাইন না আবিষ্কার করত তাহলে বাপ দাদার কল্যাণে অনেকেরই হয়ত সোসাল মিডিয়ায় জ্বালাময়ী স্ট্যাটাস লেখার সৌভাগ্য হত না।
বাঙ্গালীদের কার্যকলাপে হতাশ হয়েই হয়ত কবিগুরু লিখে গেছেন:
"সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী,
রেখেছ বাঙ্গালী করে মানুষ কর নি।"
বিদ্রোহী কবির মেজাজ তো আরও চড়া:
"বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে!
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।"
আমার মতে, শুধু ফি নির্ধারণ করার মাধ্যমে ডাক্তারদের বস্তাবন্দী করে সুফল আসবে না। বরং সব সেক্টরকে (স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি ইত্যাদি) সুনির্দিষ্ট নীতিমালায় নিয়ে এসে বেসরকারিকরণের মাধ্যমে সরকারী খাতগুলোকেও বেসরকারির পাশাপাশি নিয়ে যেতে হবে। জনগণ যেন তাদের সাধ্যমত যে কোন সেক্টর (সরকারি/বেসরকারি) থেকে সর্বোচ্চ সেবা পায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষার মৌলিক অধিকার রাষ্ট্রের, ডাক্তারদের নয়।
অনেক চিকিৎসকের আচরণই অমানবিক। আমি নিজেও এর ভূক্তভোগী। যার পারিবারিক শিক্ষা কোন কাজে আসেনি বা শিক্ষিত হয়েও যিনি নিজের চরিত্রের পরিবর্তন করতে পারেননি তার আচরণ সংশোধন করার দায়িত্বও আপনারই।
কিন্তু কিভাবে? আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে নিশ্চয়ই নয়। আরও একটা কথা, চিকিৎসকরা ভিনগ্রহের কেউ নয়। বাঙ্গালীর কমন দোষ ত্রুটি গুলো তাদের মধ্যে কমনলি থাকাটাই স্বাভাবিক। সর্বক্ষেত্রে দেশ প্রেমের চর্চা করা সবার জন্যই কর্তব্য। এজন্যই কবি আব্দুল হাকিম বলেছেন:
"যে সব বংগেতে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী,
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।"
সুতরাং, ডাক্তার মারবেন না। এদেরই কেউ আপনার ভাই, কেউ বন্ধু, কেউবা প্রিয়জন। বিপদের সময় এদেরকেই পাবেন সবার আগে।
যাইহোক, আমি আশাবাদী মানুষ। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও আশার আলো খুজেঁ বেড়ানোই আমার কাজ।
"আধারের ভ্রুকুটিতে ভয় নাই,
মাগো, তোমার চরণে জানি পাব ঠাঁই,
যদি এ পথ চলিতে কাটা বেধেঁ পায়
হাসিমুখে সে বেদনা সবো।"
___________________________
লেখক ডা. আইনুল হক । রেসিডেন্ট , বিএস এম এম ইউ।
আপনার মতামত দিন: