Dr. Aminul Islam

Published:
2022-06-07 23:16:02 BdST

বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা : বাঙালির মুক্তির সনদ


লেখক: উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

 

 

ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ

উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
_____________________

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ: ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ রাজত্ব শেষে পাকিস্তান নামে একটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পূর্ব পাকিস্তান জনসংখ্যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলো এবং পাকিস্তানের মোট রপ্তানি আয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ রপ্তানি হতো পূর্ব পাকিস্তান থেকে। তবে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক সুবিধা আনুপাতিক ছিলো না। বছরের পর বছর পুর্ব পাকিস্তান আঞ্চলিক ভিত্তিতে ক্রমাগত বৈষম্যের শিকার হওয়ায় গুরুতর অর্থনীতির দৈন্যতার সস্মুখীন হয়। যার ফলশ্রুতিতে সৃষ্টি হয় ছয় দফা আন্দোলন। ৬ দফা আন্দোলন বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লাগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষে ৬ দফা দাবি পেশ করেন।

৬ ফেব্রুয়ারি পত্রিকায় শেখ মুজিবকে বিছিন্নতাবাদী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। ফলে তিনি নিজেই ৬ ফেব্রুয়ারি এর সম্মেলন বর্জন করেন। ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়াকিং কমিটির সভায় ৬ দফা প্রস্তাব এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচি গৃহীত হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান বিরোধীদলীয় সম্মেলনে ৬ দফা পেশ করেন। এরপর ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ‘আমাদের বাঁচার দাবি: ৬ দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রচার করা হয়। ২৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে ৬ দফা উত্থাপন করা হয় লাহোর প্রস্তাবের সংগে মিল রেখে। ৬ দফা দাবির মূল উদ্দেশ্য-পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র, ৬ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে এই ফেডারেল রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যকে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন দিতে হবে। ৬ দফা কর্মসূচির ভিত্তি ছিল ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব। পরবর্তীকালে এই ৬ দফা দাবিকে কেন্দ্র করে বাঙালী জাতির স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলন জোরদার হয়। বাংলাদেশের জন্য এই আন্দোলন এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে একে ‘ম্যাগনা কার্টা’ বা বঙালী জাতির মুক্তির সনদও বলা হয়।
৬ দফার দাবি সমূহ নিম্নরূপ: ১. শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি। ২. কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা। ৩. মুদ্র বা অর্থ-সম্বন্ধীয় ক্ষমতা। ৪. রাজস্ব, কর বা শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা। ৫. বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা। ৬. আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা।

৬ দফার মূল বক্তব্য ছিলো প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয় ছাড়া সব ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকবে। পূর্ববাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানে দুটি পৃথক ও সহজ বিনিময়যোগ্য মুদ্রা থাকবে। সরকারের কর, শুল্ক ধার্য ও আদায় করার দায়িত্ব প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকাসহ দুই অঞ্চলের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার আলাদা হিসাব থাকবে এবং পূর্ববাংলার প্রতিরক্ষা ঝুঁকি কমানোর জন্য এখানে আধা-সামরিক বাহিনী গঠন ও নৌবাহিনীর সদর দফতর স্থাপন। বাংলার সর্বস্তরের জনগণের মাঝে ৬ দফা ব্যাপক সমর্থন পায়। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ১৯৬৬ সালে ৮ মে নারায়ণগঞ্জ পাটকল শ্রমিকদের এক সমাবেশে ভাষণ দেওয়ার পর তাকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী। তাঁকে এ ধরনের হয়রানিতে জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়।



৭ জুন আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য নেতার মুক্তির দাবিতে এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন তথা বাঙালি জাতির মুক্তির ৬ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে পূর্ণ দিবস হরতাল আহ্বান করেছিল। অভূতপূর্বভাবে সে হরতাল সাড়া দেয় ছাত্র-শ্রমিক-জনতা সহ সারা দেশের মানুষ। হরতাল বানচাল করতে পুলিশ ঢাকা ও নারায়নগঞ্জে মুক্তিকামী মানুষের মিছিলে গুলি চালায়। এতে ঢাকার তেজগাঁওয়ে শ্রমিক নেতা মনু মিয়া, ওয়াজিউল্লাহ-সহ ১১ জন এবং নারায়ণগঞ্জে সফিক ও শামসুল হক নিহত হন। আহত হন অনেকেই। সরকারের বিরূপ প্রচারণা ও অত্যাচারে ৬ দফা আরও বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ৬ দফা যখন জনগণের ব্যাপক সমর্থন পায় ঠিক সেই সময় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবকে অভিযুক্ত করে এক নম্বর আসামী করা হয়। স্বৈরাচারী শাসকেরা ভেবেছিল মামলা দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবন নিঃশেষ করে দেবেন। কিন্তু হলো তার বিপরীত। আগরতলা মামলা দায়েরের পর তিনি পরিণত হন মহানায়কে।

সরকারের যড়যন্ত্র ছাত্র-যুব-জনতা ব্যর্থ করে দেয় গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। প্রিয় নেতাকে তারা সেনানিবাসের কারাগার থেকে মুক্ত করে আনেন। মুক্তি পেয়ে তিনি তাঁর ৬ দফা ভিত্তিক আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। ঐতিহাসিক দিনটি বাঙালির স্বাধীনতা, স্বাধিকার ও মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসের অন্যতম মাইলফলক, অবিস্মরণীয় একটি দিন। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে যেসব আন্দোলন বাঙালির মনে স্বাধীনতার চেতনা ও স্পৃহাকে ক্রমাগত জাগিয়ে তুলেছিল ৬ দফা আন্দোলন তারই ধারাবাহিকতার ফসল। এরই ধারাবাহিকতায় উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান সত্তরের নির্বাচনে বাঙালির অবিস্মরণীয় বিজয়, একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫ মার্চের গণহত্যা এবং ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পথ ধরে দেশ স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যায়। ১৬ ডিসেম্বর ৯ মাসের মুক্তি যুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু উত্থাপিত ৬ দফা দাবির সাথে যেমন এদেশের মানুষ একাত্মতা প্রকাশ করেছিল। ঠিক যেমনি দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে তারই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এদেশের মানুষ ঐক্যবন্ধভাবে কাজ করছে। যার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ আজ বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আজকের এই উত্তরণ-যেখানে রয়েছে এক বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়ার ইতিহাস। ২০২১ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ সব কিছুই সম্ভব হচ্ছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের করণে।
লেখক: উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

 

 

আপনার মতামত দিন:


বিএসএমএমইউ এর জনপ্রিয়