Dr. Aminul Islam

Published:
2020-06-20 15:02:46 BdST

কেসহিস্ট্রি থেকে কাহিনিকান্না ভেজা প্রথম প্রেম


 


অধ্যাপক ডা. ঝুনু শামসুন নাহার
প্রাক্তন চেয়ার পারসন
মনোরোগবিদ্যা বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা
_______________________

গানের কলি মনে পড়ছে “জোছনা করেছে আড়ি; আসেনা আমার বাড়ী; গলি দিয়ে চলে যায়....”
প্রায় সাথে সাথেই আরেকটা গানের দু চরন মনে এলো “ একূল ভেঙে ওকূল তুমি গড়ো/যার একূল ওকূল দুকূল গেল তার লাগি কি করো?”
একদিন একটা ক্লিনিকে গিয়েছি রোগী দেখতে। মাদকাসক্ত রোগী। রোগী দেখবার পরে ডাক্তারকে পরামর্শ দিচ্ছি। ক্লিনিকের পিয়ন এসে বলল- রোগীর স্ত্রী আমার সাথে দেখা করতে চায়। আমি বললাম- যদি এখন ক্লিনিকে এসে থাকেন তবে পাঠিয়ে দাও।
একটা মেয়ে ঘরে ঢুকলো। অপূর্ব সুন্দরী মায়াময় চেহারার একটা মেয়ে। সংকোচের সাথে ধীর পায়ে ঘরে ঢুকলো। টেবিলের এপারে আমি আর ওপারে মেয়েটি। চুপচাপ। কোনো কথা বলছে না। আমি স্বত:প্রনোদিত হয়ে রোগীর অবস্হা বললাম, কি কি ওষুধ পাচ্ছে বললাম, চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদী হতে হবে.....দুসপ্তাহ পর পর ইউরিনে ড্রাগ পরীক্ষা করাতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই সাথে পেশেন্টকে নজরে নজরে রাখতে হবে; হাতে টাকা-পয়সা মোবাইল না দেবার পরামর্শ দিলাম।
মেয়েটা মাথা নিচু করে টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে। দুফোঁটা অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়লো টেবিলের কাঁচে। একটু শান্ত হয়ে আমার দিকে তাকালো। কেমন যেন চেনা চেনা লাগলো মেয়েটিকে। টানা টানা চোখ দুটো ঘিরে আছে দীর্ঘ আঁখিপল্লব। ছলোছলো মায়াময় চোখদুটো তুলে যখন আমার দিকে তাকালো তখন একটা ইথিরিয়াল সৌন্দর্য দেখলাম যেন! আমি থমকে গেলাম। বেশ অবাক হলাম।
মেয়েটি খুব আস্তে আস্তে বলল- আমি তুষ্টি। ডক্টর আমাকে চিনতে পেরেছেন? আমার বাবা পুলিশ অফিসার। প্রায় তিন বছর আগে আমার বাবা আমাকে আপনার কাছে নিয়ে গিয়েছিল।

মনে পড়েছে। হ্যাঁ বছর তিনেক আগে পুলিশ অফিসার বাবা তার একমাত্র কন্যাকে নিয়ে এসেছিলেন আমার কাছে। মেয়েটির কোমল কমনীয় অপূর্ব মাধুর্য দেখে আমি সত্যিই মুগ্ধ হয়েছিলাম। নাম বলল তুষ্টি। মেধাবী; ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ফিন্যান্সে অনার্স পড়ছে। মেয়ে প্রেমে পড়েছে। বিয়ে করতে চায়। একদম এ্যাডামেন্ট। ছেলে দেখতে খুব হ্যান্ডসাম। মাদকাসক্ত এবং ইন্টার পর্যন্ত পড়েছে। নাম ফয়সাল। স্বাভাবিক ভাবেই অভিভাবকরা রাজী নয়।
বাবাকে আলাদা করে বললাম- প্রেম তো মানসিক অসুস্হতা নয়। আপনার মেয়ের কথা শুনে এ বিয়ের মেরিট/ডিমেরিট সম্পর্কে বোঝাতে পারি। মাইনর মেয়ে হলে হয়তো ক্লিনিকে ভর্তি করা যেতে পারতো আপনাদের সম্মতিতে। কিন্তু তুষ্টি তো এ্যাডাল্ট। তারপরে তুষ্টির কথা শুনলাম মনোযোগ দিয়ে।ফয়সাল যে মাদকাসক্ত সে সম্পর্কে তার অভিমত জানতে চাইলাম। তুষ্টির আত্মবিশ্বাস প্রবল। সে ফয়সালকে মাদকাসক্তি থেকে বের করে অানবেই; সমাজে প্রতিষ্ঠিত করবে— এই তার চ্যালেন্জ। ছেলেটার লেখাপড়ার বিষয়ে আর কিছু বললাম না। তবে ভবিষ্যতে ইনকাম করে স্ত্রী-সন্তানকে ভরন-পোষন করবে কিভাবে তার একটা প্ল্যান চক-আউট করতে বললাম। আরো বিশেষ ভাবে বললাম আগামী তিন মাস যেন তুষ্টি নিজের গঠনমূলক আত্মসমালোচনা করে এবং ফয়সালই তার জন্য সবচেয়ে কেয়ারিং ও উপযুক্ত পাত্র— সেটা যেন নৈর্ব্যক্তিক ভাবে দেখবার চেষ্টা করে। এই তিন মাসের মধ্যে বিয়ে না করাই ভালো।
তিন বছর পরে একদম অন্য ভাবে অন্য পরিবেশে দেখা হলো তুষ্টির সাথে। কথা বলে যাচ্ছে তুষ্টি আর অঝোর ধারায় চোখের জল ঝরছে।
বাবা আমার সাথে কোনো সম্পর্ক রাখেনা। মা লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করে; টাকা-পয়সা দেয়। ভাই-ভাবী পরিচয় দিতে চায় না। স্বামীকে মাদকমুক্ত করতে পারলাম না — সব দোষ আমাকেই দেয় শ্বশুর বাড়ীর লোকেরা।
আমার একটা ছেলে হয়েছে। দুবছর বয়েস। আজ আপনি যাকে রোগী হিসেবে দেখছেন সে ফয়সাল। আমার ও আমার সন্তানের প্রতি ওর কোনো খেয়াল নেই। শ্বশুরের টাকায় সংসার চলে। আমার কোনো অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নেই। অথচ বাড়ীতে আমি কত আদরের মেয়ে ছিলাম। ডুকরে কেঁদে উঠলো মেয়েটি। অন্তরের গভীর থেকে হৃদয় বিদীর্ন করা হাহাকারের মতো শোনালো তার কান্নার শব্দ। আমি নির্বাক। দুজনেই চুপ করে রইলাম অনেকক্ষন।
বেশ কিছুক্ষন পর তুষ্টি বলল— এই ভালবাসাটাই কি আমার জন্য কাল হলো?
বেশী কথা আর বললাম না। শুধু বললাম মনকে শক্ত করো। ভেতর থেকে নিজেকে এমপাওয়ার করো। সন্তানকে সুশিক্ষা দিয়ে সত্যিকারের একজন ভাল মানুষ করবার চেষ্টা করো। তোমার এই অকৃত্রিম ভালবাসাই হয়তো একদিন ফয়সালকে আবার তোমার কাছে ফিরিয়ে আনবে।

বললাম বটে। অথচ আমার মনে কেন জানি আরো একটা গানের কলি বারবার মনে আসছে “কি আশায় বাঁধি খেলাঘর বেদনার বালুচরে....”

_____________INFORMATION_________________

আপনার মতামত দিন:


বিএসএমএমইউ এর জনপ্রিয়