Ameen Qudir
Published:2017-03-13 17:38:58 BdST
উভয় সংকটে তরুন চিকিৎসক:আপনারা যারা ডাক্তারদের গালি দেন
ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল
______________________________
আমাদের সমাজে ডাক্তার নির্বাচনের ক্ষেত্রে রোগীরা কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করে। যেমন বন্ধু-বান্ধব, পাড়া প্রতিবেশীর মন্তব্য মূল্যায়ন এখানে মূল নিয়ামক। তারা যার নাম বলবেন সেই ডাক্তারই সেরা। এক্ষেত্রে সেই ডাক্তারের পদ পদবী অবশ্য একটা ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশে যারা গানবাজনা তেমন শোনেন না তাদের যদি জিজ্ঞেস করা হয় বাংলাদেশে দুজন শিল্পীর নাম বলুন তো মশাই। তারা বলবেন রুনা লায়লা ও সাবিনা ইয়াসমিন। খুব চাপ দিলে বলবেন আব্দুল হাদী বা এরকম কিছু। এর বাইরে আসবে না। নিলুফার ইয়াসমিন যে একজন শিল্পী সেটা তাদের বুঝবার কথা নয়।
ডাক্তারের ক্ষেত্রেও তাই। কোনভাবে গ্রামে গঞ্জে নামটা পৌঁছে গেছে এরকম ডাক্তারদেরই জয়জয়কার। কিছুদিন আগে পাইলসের চিকিৎসার জন্য একজন রোগী এক বিখ্যাত প্রফেসরের এপয়েন্টমেন্ট চাইলেন। আমি বললাম উনিই কেন? আপনি অমুকের কাছে যান, উনি অত্যন্ত আন্তরিক, সজ্জন। রোগী রাজি হলেন না। আমিও আর কথা বাড়ালাম না।
ক্রিয়েটিনিন স্বাভাবিকের চেয়ে জিরো পয়েন্ট টু ইউনিট বেড়েছে এমন রোগী কিডনী বিশেষজ্ঞ প্রফেসর অমুক স্যারকে দেখানোর জন্য আবদার করেছেন। এপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে। যুক্তি দিয়ে বোঝালাম আপনার বয়স অনুপাতে এটা স্বাভাবিক। তাছাড়া ডায়বেটিস আছে।
কিছু নিয়ম মানতে হবে। এর বাইরে তেমন করণীয় নেই। বললেন মনের স্বান্ত্বনা। সেই স্বান্ত্বনার জন্য উনি স্যারের এপয়েন্টমেন্ট নিলেন রীতিমত কুরুক্ষেত্র বানিয়ে। স্যারের এটেনডন্টকে ঘুষ দেওয়া সহ এমন কোন অপকর্ম নেই যা করেননি। সচিব, সাংবাদিক, সমাজকর্মী সবাইকে দিয়ে সুপারিশ করিয়েছেন। স্যারের দেখা যখন পেলেন স্যার দুই কথা বলে বিদায় করলেন। কথা সেই একই। তেমন কিছু করনীয় নেই। নিয়মিত চেক আপ করবেন, ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণ করবেন। এত বিড়ম্বনার পর এই সমাধান রোগীর পছন্দ হয়নি। হবার কথাও নয়। শেষে বলেছেন এদেশে মানুষ চিকিৎসা কেন করে? অল আর রাবিশ। উনি ইন্ডিয়া যাবেন।
এসবে তেমন সমস্যা ছিলনা। সমস্যা হচ্ছে এই অতি বিখ্যাত ডাক্তারদের অধিকাংশেরই খ্যাতির কিছু সাইড ইফেক্ট আছে। উনারা স্বাভাবিক কারণেই প্রতিদিন শ খানেক বা তার বেশী রোগী দেখেন। দেখতেই হয়। না দেখলে অনেক সময় বিপদে পড়তে হয়। উভয় সংকট। ফলে তাঁরা রোগীদের সাথে খুব বেশী কথা বলতে পারেন না। মনোযোগ দিতে পারেন না। কেউ কেউ খারাপ ব্যবহারও করেন। খারাপ ব্যবহার করলেও উনাদের চেম্বারে রোগীর অভাব হয়না। ফলে উনারা এটাকে সমস্যা মনে করেন না।
উনারা যখন দেখেন এই মার্কেটে তাঁরা একটা মনোপলি পেয়ে গেছেন তখন দূর্নীতিও করতে থাকেন নির্বিঘ্নে। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিগণ হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে উনাদের চেম্বারে। ডায়গনোস্টিক সেন্টার তাদের পদতলে পদসেবা দিতে ব্যস্ত ।
সাধারণ মানুষ এঁদের গালি দিতে পারেনা। কারণ এঁদের টিকিটাও তারা ছুঁতে পারেনা। এঁরা ফেসবুকেও বসেন না। লোকের গালাগাল এঁদের স্পর্শ করে না। কারণ গালাগালে উনাদের কিছু হয় না। এঁরা এসবের বাইরে। জীবনে অমৃতের স্বাদ এঁরা পেয়ে গেছেন।
হিপোক্রেট মধ্যবিত্ত অথবা বোকা মধ্যবিত্ত রাগটা ঝাড়ে তরুন চিকিৎসকদের উপর। এরা চিকিৎসা পেশার শুদ্ধতম অংশ। এদের পারসোনাল রোগী নেই, সোশ্যাল/প্রফেশনাল স্ট্যাটাস নেই। এঁদের অধিকাংশেরই চেম্বার নেই। কারো কারো আবার মাস গেলে বেতনও নেই ।
এদের উপর ওষুধ কোম্পানির সুনজর নেই। কমিশন তো খাবার উপায়ই নেই। এরা সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে ডিউটি দেয়। হাসপাতালের মালিকদের অপকর্ম দেখে, কিছু বলার ক্ষমতা নেই। স্যারদের দায়িত্বহীন আচরণ দেখে, প্রতিবাদের উপায় নেই।
থাকার মধ্যে আছে কেবল নামের আগের ডাক্তার উপাধিটা আর আত্মীয় পরিজনের প্রত্যাশার চাপ।
একই পেশায় সিনিয়র জুনিয়রের রোজগারে, মর্যাদায় এত বিস্তর ফারাক আর কোথাও আছে কি?
এদের যখন গালি দেবেন এদের গায়ে লাগবে। কারণ এরা দূর্নীতি করেনা। এদের একদিকে আছে সততার অহংকার, মেধার অহংকার আরেকদিকে আছে না পাওয়ার বেদনা। ফলে সম্মান না হোক সামান্য সহানুভূতিটাও এরা যখন পায়না তখন এরা খ্যাপা আচরণ করতে থাকে। গালাগাল করে রাগ ঝাড়তে থাকে। আপনারাও তাদের ভাষা দেখে আবার বলেন “ডাক্তারদের ভাষা এত খারাপ!”
__________________________
লেখক ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল । রেসিডেন্ট। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা।
আপনার মতামত দিন: