Ameen Qudir

Published:
2017-03-09 00:05:56 BdST

এক নারী ডাক্তারের জীবন সংগ্রাম ও জীবনযোদ্ধা হয়ে ওঠার কাহিনী


 



ডা. নাসিমুন নাহার
__________________________

নারী দিবসে চলুন একটা গল্প শোনাই।সত্যি গল্প কিন্তু।নাহ, কোনো বিখ্যাত সেলিব্রেটি নারীর গল্প না।
আমাদের এই কিম্ভূত সব সম্ভবের সমাজেও কিছু মেয়ে আছে যারা সমস্ত রকম সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানসিক প্রতিকূলতাকে একে একে জয় করে নীরবে নিভৃতে সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে টিকে থাকার জন্য জীবন যুদ্ধটা ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছে। আটপৌরে বাঙালি ভীতু ভীতু ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের খুব সাধারন একজন মেয়ের যোদ্ধা হয়ে ওঠার একান্তই সাদামাটা একটা গল্প।

 

বাবা মায়ের প্রথম সন্তান হিসেবে রীতিমতো প্রিন্সেসের মতো বেড়ে ওঠা এই মেয়ের।জীবনে লেখাপড়া আর টুকটাক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ছাড়া আর কোন কিছুতেই তার মন ছিল না। বইয়ের ভেতর দিয়ে যে পৃথিবী চিনতে শিখেছিল। ভুলেও তখন ভাবেনি প্রকৃতি একদিন হাতে কলমে প্রতিটি সেকেন্ড মিনিট হিসেব করে একটু একটু করে জীবনের সংগা তাকে শেখাবে।তার জীবনে একটাই স্বপ্ন ছিল ---- ডাক্তার হতে হবে। দুঃখ, কষ্ট, ব্যাথা, খাবারের কষ্ট, কাপড়ের অভাব, আদরের কমতি কখনও সে দেখিনি।কিন্তু পরবর্তীতে জীবন তাকে শিখিয়েছে--অভাবেই তোমার প্রকৃত স্বভাব সামনে আসবে, এভাবেই তুমি জানবে নিজেকে।

 

জীবন কখনোই একভাবে কাটে না কারো। প্রকৃতি variations পছন্দ করে।মেয়েটির জীবনেও পরিবর্তন এল।মেডিকেল কলেজের ছাত্রী অবস্থায় তাকে ব্যক্তিগত জীবনে চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হলো।সম্ভবত early marriage তার জীবনে অভিশাপ হয়ে ধরা দিল।ঠিক বাল্যবিবাহ না হলেও মেডিকেলের লেখাপড়া করা অবস্থায় বিয়েটা তার জীবনের একটা ভুল হিসেবে প্রমাণ হলো।

আমাদের দেশে আইন করে মেয়েদের বিয়ের বয়স কমানো হয়েছে ! এই সমাজ, সমাজপতিরা, আইনপ্রনেতারা কি জানেন একজন মেয়ের শারিরীক, মানসিক প্রস্তুতি কতটা জরুরী একটা স্বাভাবিক বিয়ের সম্পর্কের জন্য ? লেখাপড়া শেষ করাটা একটা মেয়ের জন্য কতখানি প্রয়োজনীয়?_ তা আমাদের সমাজের নীতি নির্ধারকেরা হয়তো জানে না ! কোন মেয়ের বিয়ের সম্পর্ক যদি sound না চলে/হঠাৎ করে যদি স্বামী মারা যায়/মেয়েটিকে যেকোন কারনে একা থাকার সিদ্ধান্ত নিতে হয় তখন শুধু মাত্র কাগজের সার্টিফিকেটগুলোই পারে মেয়েটিকে এই ভয়ংকর পৃথিবীতে অসহায় বেচারি লেবাস থেকে মুক্ত করে সামনের দিকে এগিয়ে চলার ভরসা দিতে।


এই গল্পের মেয়েটি ছিল ভীষন স্বপ্নবাজ।তার সমস্ত স্বপ্ন ছিল আকাশ ছোঁয়া ! পৃথিবী জয়ের স্বপ্ন দেখত সে। সেভাবেই ছোটবেলা থেকে নিজেকে তৈরি করেছে সে।
কিন্তু জীবন শুরুর আগেই স্বপ্ন ভঙ্গের কষ্টে ভেঙেচুরে চুরমার হতে হয় তাকে। কিন্তু সে জিদ ধরে নিজের কাছে নিজে প্রতিজ্ঞা করে-- কিছুতেই হেরে যাবে না ।এই ভাঙচুরের শুরুটা তার হাতে না থাকলেও শেষটা সে নিজে তৈরি করবে। চোখ কান বন্ধ করে হোস্টেলের রুমে নিজেকে বন্দি করে নিল মেয়েটি।বাইরের জগত বলতে শুধুই হাসপাতাল, ক্লাস রুম আর সপ্তাহে একদিন ঢাকায় ছুটে যাওয়া।ওহহ বলা হয়নি মেয়েটির জীবন যুদ্ধটা শুধু নিজের টিকে থাকার জন্য ছিল না।তার কোল জুড়ে আসা এক দেবশিশু ছিল তার ভাঙচুর হয়ে পড়া জীবনের একমাত্র সাক্ষী এবং জীবনে ঘুরে দাঁড়াতে হবে এই প্রতিজ্ঞার একমাত্র কারন--- একজন একা মায়ের জীবন সংগ্রামও।

এভাবেই ফাইনাল প্রফ পাশ করে ডাক্তার হয়ে যাওয়া মেয়েটির।হোষ্টেলেই শুরু হলো মা ছেলের ছোট ছোট দুই বেড জোরা দিয়ে ছোট্ট সংসারের, রুমের আরো দুজন রুমমেটের সাথে। মেয়েটির ভাগ্য ভালো ছিল।হোস্টেলমেটরা, রুমমেটরা কখনো কোন অভিযোগ করেনি বাচ্চা নিয়ে থাকার ইস্যুতে। রাইস কুকারে চলত বাচ্চার দুধ গরম, ডিম সিদ্ধ, খিচুড়ি, ম্যাগী নুডলস থেকে পায়েস, পুডিং, সুজি রান্না।

 

মর্নিং ডিউটিতে বাচ্চা কে হোস্টেলে রেখে যেতে হতো কারনে সকালে স্যার ম্যামরা রাউন্ড দিতেন, ফলোআপের ব্যাপার ছিল, ওটি এসিস্ট ছিল।ইভনিং নাইটে মা ছেলে মিলে বিছানা পত্র নিয়ে তারা ডিউটিতে যেত।হাসপাতাল ছিল তাদের সেকেন্ড হোম।হাসপাতালের প্রতিটি মানুষ ছিল তাদের সেইসব দিনের পরম আত্মীয়, ক্যান্টিন বয় থেকে ফার্মেসির দোকানদার মামা, স্যার ম্যাম, সিনিয়র জুনিয়র ক্লাসমেট সবাই তাদের জীবনের ঐ পর্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ।এখনও চোখ বন্ধ করলে মেয়েটির চোখে ভেসে ওঠে ইনাটার্নশীপের সেই কঠিন সংগ্রামের দিনগুলোর কথা।

--------আহারে নিজের জীবনের দায়িত্ব বুঝে নেবার আগেই যাকে বুঝে নিতে হয়েছিল সন্তানের এবং রোগীর দায়িত্ব !!! জীবন তাকে শেখাচ্ছিল পৃথিবীতে টিকে থাকার পদ্ধতিগুলো ।

ইন্টার্নশীপ শেষ করে মেয়েটি USAID এর একটা প্রোজেক্টে জয়েন করল আউটডোর মেডিকেল অফিসার হিসেবে।বাচ্চাকে সাথে নিয়ে ই শুরু হলো তার নয়টা পাঁচটা অফিস। বাচ্চাকে কোথাও রেখে যাবার সুযোগ তার ছিল না।এদিকে চাকরি না করলেই না।তাই দুটোকে নিয়ে শুরু হলো তার ছোটাছুটি।


এরই মধ্যে বাচ্চা কে স্কুলে ভর্তি করানোর সময় হয়ে এল।বাচ্চা কে স্কুল থেকে আনা নেয়া সব মিলিয়ে মেয়েটি এবার চাকরি নিল একটি ডায়াবেটিক হাসপাতালে ইনডোর মেডিকেল অফিসার হিসেবে।সপ্তাহের ছয়টা ডিউটি সে টানা দুই দিন মর্নিং ইভনিং নাইটসহ করে ফেলত।আর বাকী পাঁচদিন চলছিল CCD আর MPH কোর্সের লেখাপড়া। কারন মেয়েটি এটা বুঝে ফেলেছিল এই পোড়ার সমাজে সিম্পল(!) এমবিবিএস নিয়ে সে টিকতে পারবে না।শক্ত একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকলে এই সমাজ, তার পেশাগত জগত তাকে ছিঁড়ে খাবে।সন্তানের জন্যও সম্মানজনক সামাজিক অবস্থা তৈরি করতে হলে ডিগ্রির বিকল্প নাই।
সুতরাং চলল তুমুল যুদ্ধময় আরো বছর দুই।


এর মধ্যে তাকে সব থেকে সহজ পথে জীবন শুরু করার অপশন হিসেবে বিদেশে চলে যাবার পরামর্শ দেয়া হলো পরিবার থেকে।কিন্তু ডাক্তার হয়েছি দেশের জন্য কাজ করব -- এই স্টুপিড কনসেপ্ট এবং বিদেশে চলে যাওয়াকে কেউ একজন পালিয়ে যাওয়া বলে আখ্যা দেবে এটা ভেবে ঐ অপশন ওখানেই শেষ করে দিল।

এদিকে সমাজ তাদের দায়িত্ব দাবি অধিকার (!) নিয়ে প্রতিনিয়ত মেয়েটির চলার পথ কঠিন থেকে কঠিনতর করে দিচ্ছিল। সংসার থেকে ছিটকে পড়া মেয়েদের নিয়ে আমাদের সমাজে বহু সস্তা চটকদার মিথ চালু আছে , তাদের নিয়ে সবার ভীষন কৌতুহল থাকে।চোখে থাকে ইঙ্গিত ইশারা।কথায় থাকে খোঁচা।মেয়েটি সবই টের পেত।একটু একটু করে কঠিন কঠোর মুখোশের আড়ালে নরম সরম ভীতু সরল মেয়েটি নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে শুরু করল টিকে থাকার প্রয়োজনে।

পরিচিত পৃথিবীটা ধীরে ধীরে ধারালো নখ দাঁত বের করতে শুরু করল এক সময়ে।তখন মেয়েটি জীবনে প্রথমবারের মতো দুঃসাহসিক একটা সিদ্ধান্ত নিল শুধুমাত্র নিজের জন্য। সে তার পরিচিত জীবন পেছনে ফেলে নতুনভাবে নতুন জায়গায় শূন্য থেকে নতুন জীবন শুরু করবে শুধুমাত্র নিজের পরিচয়ে। বাবার অনুমতি পেলেও আর সবার অসন্তুষ্টি সাথে নিয়ে ব্যাগে একাডেমিক সার্টিফিকেটগুলো, ছয় হাজার সাতশ বিরানব্বই টাকা এবং চাকরির এপয়েনমেন্ট লেটার , বুকের মধ্যে সন্তান কে আঁকড়ে ধরে নতুন জায়গায় শুরু করল নিজের নতুন জীবন নিজের একান্ত ঘর সংসার।


প্রথম প্রথম আশেপাশের লোকজন অফিসের সবার অতিরিক্ত কৌতুহলের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তাকে।মেয়েটি শুরু থেকেই কোন রকম মিথ্যে বা ছল চাতুরী না করে একদম সরাসরি সত্য উত্তর দিতে শুরু করল তাদের কৌতুহলের এবং কেউ অতি উৎসাহী হয়ে অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করলে চোখের দিকে তাকিয়ে বলত--- নিজের সীমা অতিক্রম করা একধরনের বদ অভ্যাস।ব্যাস, দারুণ কাজ হতে শুরু করল।

চাকরি সূত্রে বেশ ভালো ক্ষমতা মেয়েটির হাতে ছিল এবং সরাসরি সত্য কথা হজমে এই সমাজের মানুষদের যে সমস্যা আছে, এটা জেনে ফেলল মেয়েটা।

ফলশ্রুতিতে সমাজের অতি উৎসাহী লোকেদের আশাহত হতে হলো।তারা পারল না মেয়েটিকে অসহায় হিসেবে আবিষ্কার করে আহা উহু করতে।মাইক্রোস্কোপে অনুসন্ধান করেও চারিত্রিক কোন দুর্বলতা খুঁজে না পেয়ে পুরাই হতাশ হয়ে পড়ল তারা।চলনসই চেহারার একজন একা হয়ে যাওয়া ডাক্তার মেয়ের আশেপাশে তন্নতন্ন করে সার্চ করেও একজন ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছে না যাকে নিয়ে গসিপ করে এই সমাজ বিকৃত সুখ লাভ করবে।এটা কি মানা যায় ??!!!

কিন্তু এই সমাজ তো জানে না একজন তেইশ/চব্বিশ বছরের উচ্ছল উজ্জ্বল স্বপ্নবাজ মেয়ে যখন জেনে ফেলে তার আর কখনোই আকাশ ছোঁয়া হবে না,তার সমস্ত স্বপ্ন কে মাটিচাপা দিয়ে ফেলে শুধুই টিকে থাকার প্রয়োজনে ছুটতে হবে, সারাজীবন এই সমাজ তাকে খুঁতয়ালা মেয়ে হিসেবে ট্রিট করবে, আজীবন তাকে নিয়ে এই সমাজ সামনে না হলেও পেছনে ফিসফাস করবে, যতদিন মেয়েটির শরীরে সৌন্দর্য থাকবে ততদিন বালক থেকে শুরু করে ষাট বছরের বুড়োও সুযোগ নেবার চেষ্টা করবে------তখন সেই মেয়েটিকে বয়সের পরোয়া না করে অনেক বেশি ম্যাচিউর, আবেগহীন, কঠোর হয়ে যেতে হয় সম্মানের সাথে টিকে থাকার জন্য।আর তা নাহলে স্রোতে গা ভাসিয়ে দেবার দরজা তো খোলাই থাকে !

এই সমাজ কখনো জানবে না একা হয়ে যাওয়া মেয়েটি কত অজস্র রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছে, হাতে এন্ডিকাটার নিয়ে বসে থেকেছে শরীরের কোথায় কেটে ফেললে ব্যাথা কম পাবে ভেবে, একটার পর একটা সিডেটিভের পাতা হাতে নিয়ে গুনেছে আর সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে ময়লার ঝুড়িতে ছুঁড়ে ফেলেছে, মেয়েটির বাসার মেইন দরজা লক করার পরেও জুতা রাখার শোকেসটা টেনে দিয়েছে দরজার সামনে যাতে বাইরে থেকে কেউ দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকতে না পারে, কর্মস্থলে সব সময় এপ্রোনের পকেটে সেফটীপিন রেখে দিয়েছে, বাচ্চাটাকে কখনো বুয়ার কাছে রেখে পাঁচ মিনিটের জন্য রেখেও কোথাও যায়নি বিগত সাত বছরে, পুরো তিনটা বছর মেডিকেল কলেজের কারো সাথে কোন যোগাযোগ করেনি, রাত আটটার পর সব সময় মোবাইল অফ করে রেখেছে, রাত দশটা বাজলেই সব রুমের লাইট অফ করে শুধু বেডরুমের জিরো পাওয়া ভালভ অন করে রেখেছে যাতে পাশের বাসার ভদ্রলোক 'আজকের পেপারটা একটু দেন তো' এর অজুহাতে বিরক্ত করতে না পারে ইত্যাদি ইত্যাদি কত শত এমন টুকরো গল্প জমে মেয়েটির আজকে নিজের পরিচয়ে তৈরি একটা সম্মানের আইডেন্টিটি, নিজের টাকায় মাথা গোঁজার ঠাঁই, সন্তানের বাবা মা এর দায়িত্ব, সন্তানের জন্য সমাজে মাথা উঁচু করে চলাফেরা করার পথ তৈরি করা, পরিচিত অপরিচিত কতজনের বাড়িয়ে দেয়া ভুলের অথবা ভালোবাসার হাত না দেখে পথ চলা...........
কখনোই কেউ তা জানবে না।

যাহোক,
এই গল্পের মেয়েটির আজকে পর্যন্ত টিকে থাকার পেছনে ছিল তিনটি মূল কারন।তাহল-- লেখাপড়া, আত্মসম্মানবোধ এবং আসাধারন সাপোর্টিভ একটা পরিবার
এবং অবশ্যই সৃষ্টি কর্তার রহমত।
তাই আজকে নারী দিবসে মেয়েদের কাছে অনুরোধ--- লেখাপড়াটা কখনো ছেড় না।কে জানে কার জীবনের ভবিষ্যৎ টা কেমন হবে।
লেখাপড়া ই হোক নারীর শক্তি।

__________________________

লেখক ডা. নাসিমুন নাহার । দেশের জনপ্রিয় কলাম লেখক।

আপনার মতামত দিন:


প্রিয় মুখ এর জনপ্রিয়