ডা সানজিদা শারমিন

Published:
2021-04-27 15:01:48 BdST

উত্তমকুমার ও রুপালি সৈকতের জয়শ্রী , মাদকাসক্তিকে জয় করা অল টাইম বিউটি কুইন



ডা সানজিদা শারমিন
--------------------------

জয়শ্রী , বাংলা দেশের অস্মরনীয় মহা নায়িকা। জয়শ্রী যায় থেকে তিনি হয়েছিলেন জয়শ্রী কবির। তিনি ছিলেন উত্তমকুমারের নায়িকা।
ছিলেন সেই সোনালী সময়ের মিস ক্যালকাটা। কলকাতার টালিগঞ্জের সোনালী রুপোলী ছেড়ে প্রেমের টানে এসেছেন বাংলাদেশের পরিচালক অালমগীর কবিরের ছবিতে ; পরে ঘরেও। কিন্তু সুখ জোটে নি। বরং দুঃখের কাহিনি শুরু। সুয়োরানী থেকে পরিনত হন দুয়োরাণী তে। কলকাতার সেলুলয়েড তাকে ফেরত নেয় নি। বাংলা দেশের ঢাকায় এক করুণ জীবন যাপন করতে বাধ্য হন।
হতাশা পেয়ে বসে। মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন।
তবে মিস ক্যালকাটা বলে কথা। অনন্য তাঁর মনোবল। নিজেকে জয় করেন তিনি। মাদকাসক্তিকে জয় করে একক শক্তির জোরে ফিরে অাসেন স্বাভাবিক সুন্দর জীবনে।
এক মহানায়িকার অনন্য জীবন। ছিলেন উত্তমকুমারের নায়িকা। ১৯৭৫ সালে খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবিরের সাথে মন দেয়ানেয়ার পর্ব চুড়ান্ত হয়ে যায়। আলমগীর পূর্ব বিবাহিত এবং দুই সন্তানের জনক ছিলেন। ১৯৬৮ সালে মঞ্জুরা ইব্রাহীমের সাথে বিয়ে হয়েছিল। ইলোরা ও অজন্তা নামে দুইমেয়ের পিতা ছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালে ঝলমলে রূপসী নায়িকা জয়শ্রীকে বিয়ে করার জন্য মঞ্জুরা ইব্রাহীমকে তালাক দেন। জয়শ্রীকে বিয়ের
পর তাঁদের হানিমুন পিরিয়ড মহাসুখে কেটেছে। বিয়ের সময় জয়শ্রী কবির হয়ে যান। এই দম্পতি একটি সন্তানলাভ করেন। ছেলের নাম লেনিন সৌরভ কবির। কিন্তু আলমগীর কবিরের সাথে জয়শ্রী কবিরের দাম্পত্য জীবনের চাকা বেশিদুর যেতে পারেনি। তাঁদের ডিভোর্স হয়ে যায়। আলমগীর কবির শিশুপুত্র লেনিনকে তার মা জয়শ্রীর কাছ থেকে নিয়ে যান। এতে করে চরম মানসিক কষ্টে পড়েন জয়শ্রী। সেই সাথে আর্থিক কষ্টেও। ডিপ্রেশনে ভুগতে ভুগতে একসময় ড্রাগ অ্যাডিকটেড হয়ে পড়েন জয়শ্রী। অভিনেত্রী রানী সরকারের কাছে জয়শ্রী নাকি ১০০ টাকা চেয়েছিলেন প্যাথেড্রিন কেনার জন্য। মিনু রহমানের কাছেও নেশা করার জন্য টাকা চাইতেন। একথা মিনু রহমান কেঁদে কেঁদে সাংবাদিককে বলেছিলেন। পত্রিকার পাতা দখল করে নেয় জয়শ্রীর মাদকাসক্তির খবর।

 

একদিন চিত্রালী পত্রিকার সাংবাদিক গেলেন জয়শ্রীকে দেখতে। নোংরা স্যাঁতসেঁতে একরুমের একটা বাসায় জয়শ্রী থাকতেন। প্রতিবেদকের বর্ণনায় সে ঘটনা তুলে ধরছি --- সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছিল। ভেজা স্যাঁতসেঁতে ফ্লোরে পা দিতেই আবছা অন্ধকারে চোখে পড়লো ইঞ্জেকশনের অসংখ্য সিরিঞ্জ। উৎকট দুর্গন্ধে বমি আসার উপক্রম। প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল বের করে নাকমুখ ঢাকলাম। ঘরটিতে কোনো বাতি ছিলনা। এদিক ওদিক দেখার চেষ্টা করছিলাম। এমন সময় কানে এলো, "কি হল? দেখতে পাচ্ছেন না আমাকে? অবশ্য লাইট নেই আমার ঘরে। চৌকির কোণে একটা টর্চলাইট আছে। ওটা জ্বেলে টেবিলের উপর রাখুন। এরচেয়ে বেশি আলো দিতে পারবো না। জয়শ্রীর কণ্ঠ শুনে আমি শিউরে উঠলাম। দ্রুত টর্চলাইট অন করে টেবিলে রাখলাম। টর্চের আলোয় দেখতে পেলাম অচেনা এক নারীকে। পাতলা নোংরা একটা কাঁথা গায়ে জড়িয়ে চৌকিতে উবু হয়ে বসে আছেন। ঘরময় ভ্যাপসা গন্ধ। চোখ তার কোঠরে ঢুকে গেছে। হাতের সর্বত্র সিরিঞ্জের দাগ। দুর্ভিক্ষে আছেন মনে হল। এককালের পর্দার ঝলমলে রূপসী তারকার আজ একি হাল?? আমি স্বপ্ন দেখছিনা তো? মহাকালের সেরা নায়িকাকে এমন অবস্থায় দেখব ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবিনি। জয়শ্রীকে এমন অবস্থায় দেখে আমার কান্না পেল। চুলে জটা, মনে হল বহুদিন চিরুনী পড়ে নি পর্দার সেই কাব্যিক সৌন্দর্যময় চুলে। চুলে বোধহয় উকুনও হয়েছে। বার বার তীব্রবেগে মাথা চুলকাচ্ছিলেন জয়শ্রী। তার শরীর ও চুলের দুর্গন্ধের সাথে একমুহূর্তে আমি অভ্যস্ত হয়ে পড়লাম। আমার নাকমুখ থেকে রুমাল সরে গেল। আমাকে কাঁদতে দেখে জয়শ্রী বললেন, "ভয় পেয়েছেন আমাকে দেখে? দুর্গন্ধে বমি ঠেকাতে পারছেন না? কিন্তু কি করব বলুন? আমাকে কেউ একটু সাহায্য করছেনা। জিনিস এনে দিচ্ছেনা। আমার অন্ধকার ঘরে কেউ আসেনা। সবার কাছে আমি অরুচিকর নোংরা ডাস্টবিন। আপনি আমাকে দেখতে এলেন। আমি আপনাদের সেই জয়শ্রী। আমাকে একটু সাহায্য কর‍তে পারেন? আপনার পায়ে পড়ি, আমাকে কিছু প্যাথেড্রিন এনে দিতে পারেন? আমার কাছে পাঁচটা টাকাও নেই। প্যাথেড্রিন না পেলে অল্টারনেটিভ অন্যকিছু দিন প্লিজ। আমি মরে যাচ্ছি। আমাকে বাঁচান------!!!"

২০১৮ সালে ঢাকায় এসেছিলেন।ছবি সংগ্রহ 

‘'বিমূর্ত এই রাত্রি আমার মৌনতার সুতোয় বোনা একটি রঙিন চাদর সেই চাদরের ভাঁজে ভাঁজে নিঃশ্বাসেরই ছোঁয়া আছে ভালোবাসা আদর’--ভূপেন হাজারিকার সুরে আবিদা সুলতানার কণ্ঠে সীমানা পেরিয়ে ছবির কালজয়ী গানে বিমূর্ত শিল্পের মতো এক অভিনেত্রী প্রচলিত সমাজের শ্রেণি বিভাজনকে মাড়িয়ে নিজের ভালোবাসাকে জয় করে নিয়েছিলেন। তিনি জয়শ্রী রায় (পরবর্তীতে জয়শ্রী কবির)। কলকাতা থেকে আগমন ঘটেছিল জয়শ্রীর। কলকাতা থেকে দুজন অভিনেত্রী ঢাকার চলচ্চিত্রে এসেছেন। জয়শ্রী এবং সুনেত্রা। জয়শ্রী ১৯৬৮ সালে ‘'মিস ক্যালকাটা’' খেতাব পান। বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ছবিতেও জয়শ্রী অভিনয় করেছিলেন। জয়শ্রী কবির ন্যাচারাল অভিনয় করতেন। তাঁর চোখ কথা বলত। রোমান্টিক কি স্যাড সব অভিনয়ে তাঁর চোখ কথা বলত ।

১৯৮৯ সালের ২০ জানুয়ারি নগরবাড়ি ফেরিঘাটে আলমগীর কবিরের প্রাইভেট কার নদীতে ডুবে যায়। তাঁর সাথে ছিলেন অভিনেত্রী টিনা খান এবং আরও একজন মহিলা। মহিলা বেঁচে যান। মৃত্যু হয় আলমগীর কবির ও টিনা খানের।
শোনা গিয়েছিল, এরপর জয়শ্রীকে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছিল। নব্বইয়ের গোড়ার দিকে জয়শ্রী তাঁর ছেলে লেনিনকে নিয়ে লন্ডনে চলে যান। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। লন্ডনের একটি কলেজে অধ্যাপনা করছেন জয়শ্রী। বয়স ৭০ পেরিয়ে গেছে। বাংলাদেশে অবর্ণনীয় কষ্টের পথ পাড়ি দিতে হয়েছিল জয়শ্রীকে। কিন্তু তিনি অকল্পনীয় মনের জোর ও আত্মবিশ্বাসের কারণে তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে অনুসরণীয় ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।
আজও জয়শ্রীর অগণিত ভক্ত আছেন। যারা তাঁকে মিস করেন। "চেনা চেনা লাগে তবু অচেনা ভালোবাসো যদি কাছে এসোনা"........ সূর্যকন্যা ছবিতে গাওয়া শ্যামল মিত্রের কিংবদন্তি এইগানের মধ্যমণি জয়শ্রীকে ভুলে যাওয়া যে অসম্ভব।

 

আপনার মতামত দিন:


বিনোদন এর জনপ্রিয়