Ameen Qudir

Published:
2018-09-06 18:29:51 BdST

ফারুকীর টেলিছবি ' আয়েশা'র নির্মোহ পর্যালোচনা একজন চিকিৎসক শিল্পামোদীর কলমে


 


ডা.গুলজার হোসেন উজ্জ্বল
_______________________________

মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী নির্মিত টেলিছবি ' আয়েশা' দেখলাম।

গত কয়েকবছর যাবৎ ফারুকীর নির্মান সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণা, একধরণের অরুচি তৈরি হয়েছিল। সেই কারণেই কিনা জানিনা, যথারীতি আবারো বিরক্ত। আজকাল নাটক বা টেলিছবি দেখতে বসিনা সময় নষ্ট হবে এই আতংকে। বাঁঁচবো আর কয়দিন! সময় নষ্ট করার সময় আছে!?

আনিসুল হক অল্প কিছু ভাল উপন্যাস লিখেছেন। 'আয়েশামংগল' তার একটি। এই টেলিছবিটি সেই উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত। কিন্তু ছবি দেখে মনে হলো ভাল একটি উপন্যাসের প্রতি কি নির্মম অবিচার করা হলো!

ইতিহাসের প্রতি অবিচারটা মেনে নেওয়া আরো কষ্ট।
মূল কাহিনীটি ছিল বিশ বছর পর 'ভোরের কাগজ' পত্রিকায় যখন ১৯৭৭ সালের বিমান সেনা বিদ্রোহ নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল তখন আয়েশা বিবি নিশ্চিত জানতে পেরেছিল তার স্বামীর ফাঁসি হয়েছিল। ১৯৭৭ সালের বিদ্রোহের পর আয়েশা বিবি শুধু একটি চিঠি পেয়েছিল যে তার স্বামীর মার্শাল ল ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদন্ড ধার্য করা করা হয়েছে। সেই চিঠির সাথে ছিল একটি পার্শ্বেল। পলিথিন ব্যাগে মোড়ানো একটি শার্ট আর বারটি টাকা, যে শার্টটি পরে আয়েশার স্বামী কর্পোরেল জয়নাল আবেদীন শেষবারের মত বেরিয়েছিল ঘর থেকে৷

সেই চিঠিটিই ছিল শেষ কথা। আয়েশার জানবার সুযোগ আর হয়নি যে তার স্বামীর আসলেই মৃত্যুদন্ড হয়েছিল কিনা। চিঠিতে লেখা ছিল " মৃত্যুদন্ড ধার্য করা হইয়াছে"। মৃত্যুদন্ড হলে তো অন্তত লাশটা পাবে। অনেকেরই তো মৃত্যুদন্ড হয়েছিল, পরে ছাড়াও পেয়েছে। এই আশায় সে বুক বেঁধে ছিল বিশ বছর।

এরপর বেহুলার ভাসানের মত কেটে গেছে বিশ বছর। আয়েশার গর্ভস্থ সন্তান কৈশোর পার করেছে। এখন ইউনিভারসিটতে পড়ে। ১৯৯৭ সালে ভোরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের জের ধরে আয়েশা ও তার পুত্র পত্রিকা অফিসে যায়৷ এবং সেখানে সাংবাদিকের কাছে থাকা মৃতের তালিকা দেখে তারা নিশ্চিত হয় জয়নালের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে নাজিম উদ্দিন রোডের সেন্ট্রাল জেলে, ১৯৭৭ সালের ২৩ অক্টোবর। উপন্যাসের শেষে আয়েশার একটা স্বস্তি ছিল, যাক মৃত্যুর দিনটাতো পাওয়া গেল৷ "দিনটাতো পালন করবার পারব। "
(এগুলো সত্য ঘটনা৷ আয়েশা চরিত্রটি বাস্তবের এক নারী।)

উপন্যাসের মূল শক্তিটি ছিল মাঝের এই বিশ বছর। উজান স্রোতে ভেলা বাওয়ার মত বিশ বছর। বিশ বছর পর এক গ্রামীন নারী ও তার কিশোর পুত্রের স্বামী/ পিতার মৃত্যুর অমীমাংসিত রহস্যের পর্দা উন্মোচন করতে চাওয়ার ভেতর যে তীব্র আবেগ ও বেদনা ছিল তা আর প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হলোনা আমাদের৷ মূল আবেদনটাই চলে গেল।

ইতিহাসের নিষ্ঠুরতাও কিছুটা লঘু করা হলো। ছবিতে দেখা গেল আয়েশা তার স্বামীর বড়কর্তাকে নানারকম প্রশ্ন করছেন। চার্জ করছেন। লাশের জন্য হাহাকার করছেন। হায়! সে সময় কর্তৃপক্ষের টিকির নাগালটিও কেউ পায়নি। সবাই ছিল স্পিকটি নট।

জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদটি বিশ বছর বয়ে বেড়ানোর যে ভয়াবহতা, যে মানবিক বিপর্যয় নির্মাতা তা শুধু একটা ফ্ল্যাশব্যাকেই দেখাতে পারতেন। তিনি কি সচেতনভাবেই এড়িয়ে গেলেন! কেন গেলেন! সে সময়ের সরকারের নিষ্ঠুরতা আড়াল করার জন্যই কি!

প্রায় বিনাবিচারে শুধু ঐ অক্টোবরেই ফাঁসি হয়েছিল সরকারি হিসেবে ১১৪৩ জন বিমান সেনার। আটচল্লিশ ঘন্টার ভেতর এত জনের ডেথ সেন্টেন্সে সই করেন জিয়া। এন্থনী মাসকারেনহাস লিখেছেন জিয়া পাইলট কালি ও ফাউন্টেনপেনে সই করতেন। তার দোয়াতের কালি শেষ হয়ে গিয়েছিল সই করতে করতে৷ তিনি খুব বিরক্ত হয়েছিলেন৷

অধিকাংশই জানতোনা তাদের অপরাধ কি? দেখা গেল আনোয়ার নামে একজনের নাম বলেছে কেউ। বাহিনীতে তিনজন আনোয়ার ছিল। তিনজনকেই ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এরকম।

প্রতিদিন রাতে দুই তিনজন করে নিয়ে যাওয়া হতো ফাঁসি দেওয়ার জন্য। আমি নির্দোষ আমি নির্দোষ আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে যেত সেন্ট্রাল জেলের চারপাশ।

জিয়াউর রহমানের সেই শাসনামলে ছোটবড় বিদ্রোহ মিলিয়ে ২২০০ সেনাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল।

ইতিহাসের পুরোটা হয়ত এক টেলিছবিতে ধারণ করা সম্ভব হবেনা। কিন্তু যে উপন্যাস অবলম্বনে এই টেলিছবি তার মূল স্পিরিট অনুপস্থিত থাকলে বিরক্ত লাগে। মূল উপন্যাসে সাংবাদিক জায়েদুল হাসান একটি শক্তিশালী চরিত্র৷ এই চরিত্রটিকে দশ মিনিটের জন্য উপস্থিত করলেই অনেক কিছু চলে আসতো।
টেলিছবিটি সাতাত্তর সালে শুরু৷ রহস্যের মীমাংসাও সাতাত্তর সালেই শেষ৷

আয়েশা চরিত্রে তিশার অভিব্যক্তি আর নব দম্পতির খুনসুঁটি দিয়ে সময় ক্ষেপণ করা হয়েছে। চঞ্চল চৌধুরি মূলত পার্শ্বচরিত্র। ওয়ান উইম্যান শো।

ফারুকীর ছবিতে কেন্দ্রীয় চরিত্র ছাড়া আর কেউ তেমন অভিনয় পারেনা। তিনি এমেচারদের দিয়ে অভিনয় করান ৷ যথারীতি এখানেও তাই হয়েছে। এসব কাঁচা অভিনয় নাটক/ ছবি দেখার মুডটাই নষ্ট করে দেয়।

বিমানবাহিনীর কোয়ার্টার দেখাতে গিয়ে একেক সময় একেক বিল্ডিং দেখিয়েছেন। দুইএক সময় মনে হয়েছে এটা সাতাত্তর সালের গভমেন্ট /এয়ারফোর্স কোয়ার্টার হতেই পারেনা। দেয়ালের ডিস্টেম্পার সেসময়ে কোন কোয়ার্টারেই ছিলনা। সেসব ডিটেইলের প্রসংগে নাইবা গেলাম।

ইতিহাসের এই অংশটি নিয়ে কাজ করার যথেষ্ট সুযোগ আছে৷ দুঃখজনক যে এই বিষয়ের উপর বইই আছে দুই তিনটা। আরেকটা লেখা হয়েছিল সেই আমলেই। তৎকালীন সরকার এর সাতশ কপি তাৎক্ষণিক পুড়িয়ে ফেলেছিল। বইটির নাম ছিল 'বিমান বাহিনীর ইতিহাস'৷

সাংবাদিক জায়েদুল আহসান ও আনোয়ার কবিরের বই দুটিই ভরসা। আর আনিসুল হকের আয়েশামংগল। আনোয়ার কবিরের বইটি এই মুহুর্তে আমার সংগ্রহে নেই। বাজারেও মিলছেনা। কারো কাছে থাকলে দেবেন কি?
__________________________

 

ডা.গুলজার হোসেন উজ্জ্বল । সঙ্গীতশিল্পী । কথাশিল্পী। লোকসেবী চিকিৎসক।

আপনার মতামত দিন:


বিনোদন এর জনপ্রিয়