Ameen Qudir

Published:
2018-07-18 18:07:02 BdST

সিনেমা শিল্পে বিপর্যয় ও একটি গানের লিরিক ও কিছু কথা


এখানে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা গানটির ছবি প্রকাশ করা হয় নি। কি ধাঁচের গান হয়,তার প্রতিকী একটি গানের দৃশ্যের ছবি দেয়া হল।



চিকিৎসক হলে কি শুধু পেশা স্বার্থ নিয়েই তিনি লিখবেন। কিন্তু বাস্তবে বেশীর ভাগ এমবিবিএস চিকিৎসক বাংলা লেখেন সংবাদপত্রসেবীদের চেয়েও অতি উচ্চমানের। এসব লেখা প্রকাশ করা
অামরা অবশ্য কর্তব্য মনে করি। ডা সুরেশ তুলসান লিখেছেন বাংলাদেশের সিনেমার নিহতপ্রায় অবস্থার কথা। তার অনন্য দক্ষতায়। তিনি বলেছেন, এখন সময় এসেছে , আমাদের উচিৎ সিনেমা শিল্পের শেষকৃত্য অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তুতি নেয়ার।


ডা সুরেশ তুলসান
_________________________

"এই ছুড়ি তোর গাছে পাকা জাম্বুরা ফল কে খাবে ? " ---

যৌথ প্রযোজনার সিনেমা নির্মান স্থগিত। আশা করা যায় অচিরেই সকল সিনেমা হল মালিকেরা তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে।

বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই শুনে আসছি এদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশের স্বার্থে এই উপমহাদেশের কোন চলচ্চিত্র আমদানি করা যাবে না। দেশ স্বাধীন আজ ছেচল্লিশ বছর। কেউ কি আছেন হিসাব দিতে পারবেন এই ছেচল্লিশ বছরে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের কি কি বিকাশ হয়েছে। হাঁ তবে একটা বিকাশ হয়েছে, দেশ জুড়ে অসংখ্য বিকাশের বুথ হয়েছে।

এদেশের সিনেমা শিল্প আমাদের কিছুই দেয়নি একথা বলবো না। তবে যাদের হাত ধরে আমরা হাতে গোনা গোটা কয়েক ভালো ছবি পেয়েছি আমার বিশ্বাস তাদের কেউই এদের মত সংকির্ন হৃদয় এবং রক্ষণশীল ছিলেন না, কারন তারা সকলেই তাদের নিজেদের যোগ্যতা সম্পর্কে যথেষ্ট আস্থাশীল ছিলেন।

যখনই উপমহাদেশ এর চলচ্চিত্র আমদানি বিষয়ে কথা উঠে তখনই আমাদের গুণধর শিল্পী কলাকুশলী গন একতরফা আন্দোলন এ মেতে উঠে।

এই আন্দোলন এ সিনেমা হল মালিকদের এবং প্রতিটি সিনেমা হল পিছু যে অসংখ্য পরিবার রুটি রুজির জন্য নির্ভরশীল তাদের, এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ অর্থাৎ দর্শক বা ভোক্তা শ্রেণী, এদের কোন কথা বলার সুযোগ বা স্পৃহা কোনটাই কখনও সেইভাবে দৃশ্যমান হয়নি।

আর দর্শকদের কথা আরেকবার একটু আলাদা করে বলি। এদের যেন কথা বলার কোন অধিকারই নেই। আমাদের গুনধর শিল্পী কুশলীরা যা কিছুই বানান না কেন তা যেন আমাদের সিনেমা হল মালিকেরা প্রদর্শন করতে বাধ্য, এবং আমাদের দর্শকরা তা দেখতে বা গিলতে বাধ্য। হোন না তা নান রুটির তুলনায় আটার বস্তার সমতুল্য। এজন্যই তো আমাদের এমন গানের লিরিকও শুনতে হয় " এই ছুড়ি তোর গাছে পাকা জাম্বুরা ফল কে খাবে "

যখন ছোট ছিলাম, অন্য কোন শহরে বেড়াতে গেলে সমবয়সীদের কাছে প্রথম প্রশ্ন থাকত, তোমাদের এখানে সিনেমা হল কয়টি? যেন সিনেমা হলের সংখ্যা ওই এলাকার উন্নয়নের মাপকাঠি। আগে ভদ্রলোকেরা সপ্তাহান্তে, বাড়ীতে অতিথি এলে সপরিবার এ সিনেমা হলে যেতেন বিনোদন এর জন্য।

পর্যায়ক্রমে ভালো সিনেমার অভাব, কুরুচিপসম্পন্ন সিনেমা ইত্যাদি কারনে ভদ্রলোকেরা হল বিমুখ হয়, সেই স্থান দখল করে অশিক্ষিত, অভদ্র, নেশাখোর শ্রেণী। তাদের রুচির সাথে তাল মিলিয়ে প্রতিযোগীতা শুরু হয় অসুস্থ রুচির কুরুচিপসম্পন্ন অশ্লীল সিনেমা তৈরির। একঘেয়েমির কারনে একসময় এই শ্রেণীও হল বিমুখ হয়।

একে একে দেশের অধিকাংশ সিনেমা হল বন্ধ হতে থাকে। অনেক সিনেমাহল মালিক শহরের বনেদী শ্রেণী থেকে দরিদ্র শ্রেণীতে পরিণত হয়। আবার অনেক সিনেমাহল মালিক ব্যবসা পরিবর্তন, এমনকি সাধের সিনেমাহল ভেংগে বহুতল বাণিজ্যিক অথবা আবাসিক ভবন নির্মাণ করে সমাজে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হন। তবে সবচাইতে বিপদে পড়েন সেই সব সিনেমাহল মালিক, যারা পরিবর্তনে সামান্য কিছুদিন পুর্বেই অনেক টাকা খরচ করে নুতন সিনেমাহল গড়েছিলেন।

সিনেমা হল নির্ভর অনেক পরিবার, যেমন কর্মচারী, বাদামভাজাওয়ালা, ঝালমুড়িওয়ালা, পান-সিগারেটওয়ালা, ফান্টা, কোক, মিরিন্ডা পেপসি, চটপটি - ফুচকা বিক্রেতারা হয়ে পড়ে পথের ফকির, অথবা বিকল্প কোথাও ব্যবসা করে অথবা বিকল্প পেশায় যেতে বাধ্য হয়।

কেউ কেউ অবশ্য এই অবস্থার জন্য উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতিকে দায়ী করতে পারেন। তবে ভেবে দেখুন এই অবস্থা আকাশ সংস্কৃতি বিকাশের বেশ আগে থেকেই এই অবস্থার শুরু।

এই পরিস্থিতি এক দিনে তৈরি হয়নি। রুচিশীল দর্শকদের সিনেমা হল বিমুখ হওয়ার জন্য সিনেমা হল মালিকেরাও কিছ অংশে দায়ী। সপরিবারে সিনেমা দেখতে গিয়ে ভালো একটা ছবি চলার মাঝপথে হঠাৎ করে কোন পর্ন সিনেমার কাটপিছ। এরকম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে মাথা নিচু করে মুখে ঢেকে হল থেকে বের হয়ে আসা। আমার মত অনেকেরই হয়ত এইরকম কোন অভিজ্ঞতা নিয়েই শেষ বারের মত সিনেমা হলে যাওয়া।

সিনেমা হল মালিকদের কেউ কেউ এই অকাম, কুকাম করেছেন স্বভাব দোষে, কেউ করেছেন অভাবে পড়ে। অভাব আবার দুই রকম, এক প্রদর্শন উপযোগী ভালো ছবির অভাব, দুই অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা। অনেকটা অভাবের তাড়নায় কোন ভদ্র বাড়ীর মেয়ে বা বউয়ের বিপথে যাওয়ার মত অবস্থা।

এদেশে " বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন " এবং " বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড " নামে দুইটি প্রতিষ্ঠান আছে।

সেন্সর বোর্ড ঠিকমত তাদের দায়িত্ব পালন করলে হয়ত " এই ছুড়ি তোর গাছে পাকা জাম্বুরা ফল কে খাবে " --- গানের লিরিকটি হয়ত আমাদের শুনতে হত না।

চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন কি পারতো না ভালো ভালো ছবি তৈরিতে উৎসাহ উদ্দীপনা দিতে ? এদের একটা বডি থাকতে পারতো যাদের কাজ হতো বিদেশী ভালো শিক্ষামুলক ছবির খোজ করে এদেশে এনে সেন্সর বোর্ড এর মাধ্যমে ভালো- মন্দ বিচারের পর এদেশে প্রদর্শনের ব্যাবস্থা করা।

এই ধ্বংস যজ্ঞের পিছনে চলচ্চিত্র প্রযোজকদের অবদান কিন্তু কারও চেয়ে কম নেই। স্বল্প বিনিয়োগে অধিক লাভের আশায় ভালো সৃজনশীল ছবিতে এদের আগ্রহ বরাবরই কম, উপরন্ত স্বল্প পুঁজির কারনে ব্যয়বহুল High Tech Film - এর ক্ষেত্রে আধুনিক বিশ্বের তুলনায় আমরা অনেক পিছনে।

তবুও ভালো এই নিষেধাজ্ঞা শুধুমাত্র এই উপমহাদেশ এর ছবির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, তা না হলে হয়ত মর্নিংশো তে দেখা Sunflower, One million years bc, Guns of Navaron, Bruce - Lee - র ছবিগুলোর মতো অসংখ্য ভালো ছবিগুলো ওই সময়ে দেখার সৌভাগ্য হত না।

আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের বর্তমান যা অবস্থা তাতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় আপাতত ক্লিনিকাল ডেথ না হলেও irreversible shock বা MODS অর্থাৎ Multi-organ Dysdunction Syndrome বলা যায়।

আমরা একটি বি.এফ.ডি.সি কে Patronage করতে গিয়ে দেশের শত শত সিনেমা হল গুলোকে প্রকৃত অর্থে শ্বাসরোধ করে হত্যা করলাম। বি.এফ.ডি.সি নির্ভর কয়েকশত পরিবারের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে সিনেমা হল সমুহের উপর নির্ভরশীল লক্ষ লক্ষ পরিবারকে চরম অনিশ্চয়তা আর দারিদ্রের মুখে ঠেলে দিলাম। আমাদের বি.এফ.ডি.সি - পক্ষে সিনেমা হল গুলোকে বাঁচিয়ে রাখার মত পর্যাপ্ত ভালো ছবি উপহার দেয়ার ক্ষমতা না থাকলে দেশের বাইরে থেকে ভালোভাবে যাচাই - বাছাই ও সেন্সর করে ভালো ছবি আমদানি করে অন্তত সিনেমা হল গুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে পাড়তাম।

ICU, CCU, HDU,- যেখানেই চিকিৎসা করা হোক না কেন, এই শিল্পকে আর কোনভাবেই বাঁচানো সম্ভব না।

এখন সময় এসেছে , আমাদের উচিৎ সিনেমা শিল্পের শেষকৃত্য অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তুতি নেয়ার।
__________________________

 

ডা সুরেশ তুলসান।
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ।

আপনার মতামত দিন:


বিনোদন এর জনপ্রিয়