Ameen Qudir

Published:
2017-02-02 15:31:25 BdST

বসার ঘরে এক রূপবতী মেয়ে


 

 

 


ডা. রাজীব হোসাইন সরকার
______ ____________________

বসার ঘরে এক রূপবতী মেয়ে আয়েশ করে বসে আছে।
বয়স আনুমানিক সাতাশ-আটাশ। কিঞ্চিত রোগাটে। ফর্সা মুখ। মুখের বর্ণনা দেওয়া বেশ জটিল। মাজহারউদ্দিন ভূঁইয়া-র মতো করে বলা যায়----দীর্ঘভূজ ধারাল নাসিকা, জ্যোতির্ময় পিঙ্গলা চোখ।

তার পরনে শাড়ি।
রাজস্থানী কাতান। শাড়ির আঁচল বেশ কায়দা করে গলার কাছে জড়িয়ে রাখা। জড়ানো আঁচল মুখের চারপাশে ফটো-ফ্রেমের মতো হয়ে আছে। হঠাৎ করে চোঁখ পড়লে শুধু মুখের উপর পড়ছে, ফ্রেমে পড়ছে না। চেহারায় কড়া আভিজাত্যের ছাপ। আভিজাত্যের সাথেসাথে অতিরিক্ত ধরনের রূপবতী। কাতানের জন্য রূপ অস্বাভাবিকভাবে খানিকতা বেড়ে গেছে। চোঁখ ফেরানো দায়। সাধারণত এই লেভেলের রুপ-সৌন্দর্য্য দুই নয়নে ধরা যায় না, ধরতে হলে তৃতীয় নয়ন লাগে। আমি চোঁখ বন্ধ করলাম। তৃতীয় নয়ন খুলতে হবে। হাসন রাজার মতে, তৃতীয় নয়ন খুলতে ‘আঁখি মুঞ্জিয়া’ রাখতে হয়।
আমি আঁখি মুঞ্জিয়া তৃতীয় নয়ন খুলতে পারলাম না। চোঁখ বন্ধ করার পর সবকিছু নিকষ কালো হয়ে গেল। বেশ আফসোস হচ্ছে। তৃতীয় নয়ন খুলতে পারলে রূপবতী মেয়ের সামনে হাসনের মত ভরা গলায় গাওয়া যেত----

‘আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রুপ রে, আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রুপ রে।
আরে দিলের চক্ষে চাহিয়া দেখ বন্ধুয়ার রুপ রে।।’

মেয়েটি কেশে গলা পরিষ্কার করল।
গলা পরিষ্কার করার শব্দে বেশ যত্ন আছে। মনে হল----একটা নরম ব্রাশ দিয়ে গলার কাছটাকে হালকা ঘষে দিল।
‘আপনি চোঁখ বন্ধ করে আছেন কেন?’
আমি চোঁখ খুললাম।
মেয়ের মুখভরা সৌন্দর্য্য। লাগামহীন সৌন্দর্য্য। সেই সৌন্দর্য্য চোখের কাছে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে যাচ্ছে। কারণ কি? চোঁখের দৃষ্টির মধ্যে কি অস্বাভাবিকতা আছে?
অস্বাভাবিকতা এই মুহুর্তে ধরা যাচ্ছে না। ধরতেই হবে এমন বাধ্যবাধকতা নেই। একজন অপরিচিত রূপবতীর চোঁখের অস্বাভাবিকতা আমার ভাববার বিষয় নয়। মেয়েটি যেভাবে এসেছে সেভাবেই কিছুক্ষনের মধ্যে চলে যাবে। আমি সেই সময়ের অপেক্ষা করছি।
আমি আরেকবার চোঁখ বন্ধ করলাম। সাথেসাথে মেয়েটি বেশ শক্তভাবে বলল,
‘আপনি কি আমার সমস্যটা শুনবেন না?’
আমি জবাব দিলাম না।
চোখ বন্ধ রেখেই হাল ছাড়ার মত দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। দীর্ঘশ্বাসের পেছনে ক্ষুদ্র হেতু আছে। তাকে বোঝাতে হবে আমি বিরক্ত হচ্ছি। রুপবতীদের আত্মসম্মানবোধ অস্বাভাবিকরকম বেশি। এর পেছনে কড়া যুক্তি আছে। রূপবতীরা পুরুষজাতির উন্মাতাল প্রশংসা ও অতিরিক্ত যত্নের মধ্যে ডুবে থাকে। কোন পুরুষ তাদের অগ্রাহ্য করলে তারা ভালোভাবে নিতে পারে না। বড় ধরনের ধাক্কা খায়। আন্দাজ করে বলা যায়, আমার সামনের এই কড়া রূপবতী মেয়ে এক ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। তার মুখভঙ্গিমা বদলে গেছে। সেখানে সূক্ষ্ম অপমানবোধ।
‘অনেক দূর থেকে এসেছি। আসতে বেশ কিছু ঝামেলা করতে হয়েছে। আপনি কথা বলতে না চাইলে হ্যাঁ- না বলে জবাব দিতে পারেন। চুপ থাকার ব্যাপারটা অসহ্য। মাত্র দুটো জরুরী কথা বলব। কথা শেষ হলেই চলে যাব।’
আমি আরেকবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।
কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে আমার আগ্রহ দিনদিন শূন্যের কোঠায় নেমে যাচ্ছে। এই বিশাল পৃথিবীর কোথায় কি হচ্ছে, তাতে নিজের মস্তিষ্ককে খুব একটা বিচলিত দেখছি না। সিরিয়ায় আইএস পঁচাত্তর জন নিরীহ স্কুলছাত্রীকে জবাই করে মাথাগুলোকে মালা গাথার মত করে দড়িতে ঝুলিয়ে রেখেছে। এই বিষয় নিয়ে দেশ উত্তপ্ত। বিচিত্র কারণে মধ্যরাতে খবরটি শোনার পর আমি হাই তুললাম। অতঃপর ঘুমুতে গেলাম। আমার সামনে যে মেয়েটি বসে আছে সে পঁচাত্তর জন মেয়ের তুলনায় কিছু নয়। তার একমাত্র যোগ্যতা----সে রূপবতী। শুধুমাত্র রূপবতী হবার জন্য তার কথা আগ্রহ নিয়ে শুনলে এক ধরনের অপরাধবোধে ভোগার সম্ভাবনা আছে। আমি সেই সুযোগ দিতে চাই না।
মেয়েটি অধৈর্য্য নিয়ে বলল,
‘ঠিক আছে। আপনি কিছু না বললেও চলবে। আমি আমার কথা শেষ করে উঠে যাচ্ছি।’
এতসুর বলার পর থামল। বোঝা যাচ্ছে, সে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছে, আমি আগ্রহ পাচ্ছি কী-না। আবার শুরু করল,
‘আমার নাম- তনু। আমার বাবা সৈয়দ আহসান বর্তমান সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। এতটা উচ্চপদস্থ যে আমি তার ব্যাপারে আর কিছু বলতে চাই না। আমি একটি জটিল সমস্যা নিয়ে এসেছি। আপনি কি সমস্যা নিয়ে কথা বলতে চান?’
আমি এবারও কোন জবাব দিলাম না।
চোঁখ বন্ধ করে চিন্তাকে কেন্দ্রীভূত করতে চেষ্টা করছি। তনু নামক মেয়েটির কথাবার্তা বড়ই বিরক্তিকর। পিতৃপরিচয় দিয়ে কি বোঝাতে চাচ্ছে? নিজেকে গুরুত্বপুর্ণ কেউ অথবা তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবেই----এমন কিছু? হতে পারে। আমি সে বিষয় নিয়ে চিন্তিত নয়। মোগল সম্রাট আকবর এসে সামনে দাঁড়ালেও বিরক্ত হয়ে বলতে পারি, ‘আজ বড়ই ব্যস্ত আছি জনাব-এ-আকবর। আগামীকল্য প্রত্যূষে হাজিরা দিন।’
এই মুহুর্তে চিন্তার বেশ কিছু উপাদান আমার নিউরনে জড়ো হচ্ছে। চিন্তার প্রধান উপাদান----সৈয়দ শামসুল হকের কবিতার লাইন। এক কবিতায় বেশ মনঃকষ্ট নিয়ে কবি বলেছেন,
‘আমি কার কাছে জিগামু সে দুঃখ দ্যায় ক্যান,
ক্যান এত তপ্ত কথা কয়, ক্যান পাশ ফিরা শোয়’

বড় মায়ার কবিতা। বড় আবেদনের কবিতা। এত আবেদন নিয়ে কেউ আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা লিখতে পারে, আমার বোধগম্য ছিল না। এই কবিতায় চিন্তার মূল কারণ----কবিতার লাইনদ্বয়ের অপরিপূর্ণতা।
কবিতার আরেকটি হাত আছে। সেই হাতের নাম- তৃতীয় লাইন। তৃতীয় লাইনে আসলেই কবিতার পরিপূর্ণতা আসে। সমস্যা হল- তৃতীয় লাইন মনে আসছে না। আমি চাইলেই তৃতীয় লাইনের ব্যবস্থা করতে পারি। আমার পাঞ্জাবীর ডান পকেটে দশ বাই ছয় সেন্টিমিটার পকেট আয়তনের একটি অতি ক্ষুদ্র কবিতার বই রাখা। বই এর নাম ‘পরানের গহীন ভিতর’। মূল্যমান পঞ্চাশ টাকা মাত্র। আজিজ মার্কেট থেকে কেনা। চাইলেই বই বের করে পাতা খুলে তৃতীয় লাইন পড়ে নেওয়া যায়। তাতে আমার ব্যক্তিগত অসম্মতি আছে। বই খুলে তৃতীয় হাত বের করলে মস্তিষ্কের ক্ষমতাকে হেয় করা হবে। সেটা ঠিক হবে না। আমি মস্তিষ্ককে যথেষ্ট সময় দিলাম। সে নিজের মত করে স্মরণ করুক।
মেয়েটি তার স্বাভাবিক পূর্ব কথাবার্তা থেকে কিছুটা সরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
‘আপনি কি দুশ্চিন্তা করছেন?’
‘না, দুশ্চিন্তা করছি না। এমন মনে হচ্ছে কেন?’
আমি জবাব দিলাম। আকস্মিক জবাব দেবার পর নিজেই নিজের উপর বিরক্ত বোধ করলাম। এভাবে না দিলেও পারা যেত। কথা না বললে একসময় মেয়েটি বিরক্ত হয়ে চলে যেত। সেই সম্ভাবনা কমে গেল।
‘কিছু মনে করবেন না। আমার কেন মনে হচ্ছে,আপনার চিন্তার সমাধান করতে হলে ডান পকেটে হাত ঢুকাতে হবে।’
আমি কথা বললাম না। মেয়েটি হাসিমুখে বলল,
‘আপনি কি হতবাক হচ্ছেন, কিভাবে আমি এটা বলতে পারলাম?’
আমি জবাব দিলাম,
‘না অবাক হইনি।’
‘কেন হননি?’
‘সাধারণত অবাক হবার আগে আমি কিছুটা সময় নিই। দেখতে চাই----সেখানে অবাক হবার মত ব্যাখ্যাতীত কিছু ঘটছে কী-না। যদি ঘটে, আমি প্রথমে আমার মত করে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করি। না পারলে বইপত্র খুলে পড়াশোনা করি। এরপর ব্যাখ্যা করি। তাতেও কাজ না হলে, আমি অল্প অবাক হই।’
‘আমার ঘটনায় আপনার ব্যাখ্যা কী?’
‘ব্যাখ্যা বেশ সামান্য। আমি যখন চিন্তা করছিলাম তখন অবচেতনভাবে আমার ডান পকেটে হাত বোলাচ্ছিলাম। কারণ আমার মস্তিষ্ক জানে সেখানে আমার চিন্তার সমাধান আছে। তাই আমার অজান্তেই আমার হাতকে সে নির্দেশনা দিচ্ছে----পকেট খুলে চিন্তার সমাধান করো। অন্যদিকে আমার সচেতন অংশ বলছে----মাথাকে ভাবার সময় দাও। এত সহজে সমাধান করো না।
বেশ যুক্তির ব্যাপার। তুমি সামনে বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছ। তোমার চোখ আমার দিকে। আমার সমুহ কর্মাকান্ড বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছে। কর্মকাণ্ডের মধ্যে আমার হাতের নড়াচড়াও অন্তর্ভুক্ত।’
মেয়েটি হাসল। সামান্য সময় নিয়ে বলল,
‘আপনার ব্যাখ্যা আমার পছন্দ হয়েছে।’
‘পছন্দ করার মত কিছু বলিনি। খুব সহজ একটি ব্যাপারকে গুছিয়ে বলেছি।’
‘আপনার গুছিয়ে বলাতেও আমি মুগ্ধ হয়েছি। প্রথমবার যখন আপনার কথা শুনলাম, ভাবলাম মিসির আলি টাইপের কিছু হবেন।’
‘ভাবনার পরিবর্তন হয়েছে?’
‘হয়েছে। আপনি মিসির আলি নন। মিসির আলির মত আপনাকে আপন লাগছে না।’
‘আমি দুঃখিত- তনু।’
‘আপনি দুঃখিত নন। আমি জানি। ঠিক না?’
আমি চোখ বন্ধ করলাম।
আলোচনা বিরক্তির দিকে গড়াচ্ছে। শ্রোতা যখন কথার পিঠেপিঠে প্রশ্ন করা শুরু করে, সেখানে যুক্তি কে বসানো যায় না। আলোচনা গড়াতে গড়াতে একসময় কাল-ডি-স্যাক এ পৌছায়। এই চোরাগলি থেকে উদ্ধার পাওয়া অসম্ভব। আমি আলোচনা গড়ানো বন্ধ করে দিলাম।
তনু জিজ্ঞাসা করল,
‘এতক্ষন থেকে যা যা বললাম এ বিষয়ে আপনার অভিমত কি?’
আমি জবাব দিলাম না। মেয়েটি আরেকবার জিজ্ঞাসা করল,
‘আপনি কি কিছুই বলবেন না?’
আমি চোখ বন্ধ রেখেই জবাব দিলাম,
‘বলব।’
‘তাহলে বলুন-আমি যা বললাম এ বিষয়ে আপনার অভিমত কি?’
‘আমার কোন অভিমত নেই।’
মেয়েটি ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘নেই কেন? আশ্চর্য!’
আমি ধীর কণ্ঠে বললাম,
‘তুমি শুরুতেই আমাকে এসে মিথ্যা বলেছ। মিথ্যা বলার পর তোমার বিষয়ে আমার তেমন কোন আগ্রহ হচ্ছে না।’
তনুর ভ্রু খানিকতা কুঁচকে গেল।
‘আমি কি মিথ্যা বলেছি? একটা বলুন?’
‘একটা নয়, দুটো বলেছ।’
‘মিথ্যাগুলো কি কি?’
‘তুমি নাম বলেছ-তনু।’
‘নামে মিথ্যা আসল কিভাবে?’
‘মিথ্যা কিভাবে আসল পরে বলি। তনু নামটি দিয়েই তুমি মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছ। তোমার নাম তনুশ্রী অথবা তনু রায়। এই টাইপের কিছু একটা। ধর্মে হিন্দু। খুব সাবধানে ধর্মকে গোপন করেছ।’
‘হিন্দু মুসলমানে কি আসে-যায়? আর ধর্ম কিভাবে গোপন করলাম?’
‘তোমার মাথায় সিঁথিটা মাঝখানে নেই-বামে করা। খুব ভালো করে তাকালে বোঝা যায় মাঝখানের সিঁথিতে তুমি সিঁদুর দাও প্রতিদিন। আজকেও দিয়েছ। এখানে আসার আগে কোন না কোনোভাবে তুলে ফেলেছ। এর পেছনে বিশেষ কারণ আছে। এজন্য সিঁদুরেরটি ব্যাপারটি তোমাকে গোপন রাখতে হয়েছে। চুলগুলো টেনে বামে এনে মাঝখানের সিঁথিকে ঢেকে দিয়েছ।’
‘এটাই আপনার যুক্তি?’
‘না। এটা যুক্তি নয়, প্রমান।’
‘আর কিছু আছে?’
‘আছে। তুমি বাবার নাম বলেছে- সৈয়দ আহসান। সৈয়দ একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম নাম। তুমি একজন হিন্দু হয়ে বাবার নাম মুসলমানের নামে বলেছ।’
‘আপনি কি আমার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করবেন না?’
‘না করার সম্ভাবনা বেশি। আমার মাথায় একটা কবিতা ঘুরছে। তৃতীয় লাইনটা ধরতে পারছি না। এই নিয়ে আমার মস্তিষ্ক বেশ বিব্রত। সে অন্য কিছু নিয়ে ভাবতে চাচ্ছে না।’
‘ওহ। আমার কথা শেষ। আমি চলে যাচ্ছি।’
তনু দাঁড়ালো। সে বেশ লম্বা। মাথার চুল খুলে রাখা। দাড়ানোর সময় খোলা চুলে অল্প ঢেউ উঠল।
তনু দরজার সামনে গিয়ে দাড়িয়ে বলল,
‘আমি একটি অপরাধ করেছিলাম। এই অপরাধ নিয়ে চলতে পারছি না। বড় যন্ত্রনার মধ্যে আছি। আমি ঘুমাতে পারছি না। স্বাভাবিক কিছুতে মনোযোগ দিতে পারছি না। হিসেবে বড় ধরনের গণ্ডগোল হবার কারনে এক সপ্তাহ আগে আমার ব্যাংকের জব চলে গেছে। আমার ধারণা-----সবাই আমাকে অপছন্দ করতে শুরু করেছে। আমি জানি না কি করব।
আমার বন্ধুর কাছে শুনলাম, আপনি বুদ্ধিমান মানুষ। সাইকোলজিক্যাল ব্যাপারে ভালো সমাধান দিতে পারেন। আপনার লেখা দুটো বই পড়লাম। ‘ডাক্তার নাজীব ও কৃষ্ণকুমারী’ বইটা বেশি ভালো লেগেছে। বই পড়ার পর ধারনা হল----আমার সমস্যার সমাধান আপনি করতে পারবেন। আমি বিশ্বাস করেই এসেছি।’
আমি জিজ্ঞাসা করলাম,
‘বিশ্বাস ভঙ্গ হয়ে হয়েছে?’
‘না। হয়নি।’
‘কেন হয়নি?’
‘আপনাকে আমার বাবার মত লাগছে। মনে হচ্ছে----এই মানুষটা আমার মাথায় হাত রেখে বলবে, ভয় নেই রে মা।’
‘আমাকে বাবা মনে হবার পেছনে যুক্তি কি?’
‘যুক্তি কি থাকতেই হবে?’
‘না। থাকতে হবে না।’
তনু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার মুখে হাসি। এই হাসিতে প্রাণ নেই। দেখে বোঝা যায়, বড়সড় ঝামেলার ভেতর দিয়ে সে যাচ্ছে।
তনু ধীরপায়ে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল।


তনু আগের মতই সোফায় ক্রস-লেগ করে বসেছে। সোফার রঙ ধবধবে সাদা। সাদা সোফায় কালো কাতানের তনুকে বেশ চমৎকার লাগছে। সাদা ক্যানভাসে আঁকা কালো পরীর মত। পরী জিজ্ঞাসা করল,
‘আপনি তাহলে আমার সমস্যার সমাধান করছেন?’
আমি বললাম,
‘না।’
‘তাহলে কাজের লোক পাঠিয়ে রাস্তা থেকে ডেকে আনলেন কেন?’
‘আনার পেছনে যৌক্তিক কারণ নেই। সামান্য আলোচনা করা যেতে পারে।’
‘সামান্য আলোচনার জন্য রিক্সা থেকে নামিয়ে এনেছেন?’
‘হুম।’
তনু ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘বড় বিচিত্র লোক আপনি।’
‘আমি বিচিত্র নই তনু। খুব স্বাভাবিক একজন মানুষ। একটা গল্প বলার জন্য ডেকেছি। শুনবে?’
‘বলুন।’
‘দুই যুগ আগে আমি একবার অপরাধ করেছিলাম। সূক্ষ্ম অপরাধ। আমি তখন রংপুর থাকি। ডাক্তারির পাশাপাশি অল্পস্বল্প লিখি। সারা সন্ধ্যা বাসায় থাকি। আমার স্ত্রীর পেটে নয় মাসের বাচ্চা। আল্ট্রাসনোগ্রাম করা হয়েছে। মেয়ে হবে। আমার স্ত্রী আনন্দে আত্মহারা। স্ত্রীর হাসি দেখে আমি মাঝেমাঝে ভাবি- বড় আনন্দময় আমার জীবন।’
‘এরপর?’
‘আমি তখন একটা বই লিখছি। সাইকোলজিক্যাল ব্যাপারস্যাপার। এক কালো মেয়ের জটিল সমস্যা। সেই মেয়ে সুইসাইড করবে। তাকে ফেরাতে হবে। কিন্তু কোনভাবেই ফেরানো যাচ্ছে না। মেয়ে দরজা বন্ধ করলেই হাত পা কেটে একাকার করে ফেলে। মনের আনন্দে লিখছি। লেখা শেষের দিকে। সমাপ্তিটা কোনভাবেই ঠিক করতে পারছি না। প্রচণ্ড অস্থিরতায় কাটছে। সারাদিন লিখি আর কাগজ ছিড়ে ফেলি। দুনিয়ার কারো সাথে আমার যোগাযোগ নেই। আমি উদভ্রান্ত হয়ে গেলাম।
একদিন মধ্যরাতে আমার মনে হল- উপন্যাসের সমাপ্তি পেয়ে গেছি। বড় আনন্দে আমি। চোখমুখ বন্ধ করে লিখছি। এই পৃথিবীর কোন কিছুই আমাকে টানছে না। এমন সময় আমার স্ত্রীর প্রসব বেদনা। আমি পড়লাম গভীর যন্ত্রণায়। সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না কি করব। লিখব নাকি হাসপাতালে রওয়ানা দিব। বড় বিপদ।
শেষে ড্রাইভারসহ প্রসব বেদনায় কাতর স্ত্রীকে একাএকা হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলাম।
তনু আগ্রহ নিয়ে বলল,
‘এরপর?’
‘এরপর কিছু না। আমার স্ত্রী আমার কন্যার জন্ম দেয়।’
‘সে এখন কোথায়?’
‘কোথায় আছে জানি না। সেই রাতের পর আমার স্ত্রী প্রচণ্ড অভিমানে আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে। বাবার বাড়ি চলে যায়।’
‘আশ্চর্য! আপনি কোনদিন আপনার মেয়েকে দেখেন নি?’
‘না দেখিনি।’
‘তার ব্যাপারে কিছুই জানেন না?’
‘না, জানি না। বছরখানেক আগে একবার খোঁজ পেলাম ঢাকায় আছে। খুঁজতে গেলাম। পেলাম না। তারা নাকি অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেছে। সেখানে তার মা এবং নতুন বাবা থাকে। বাবা অস্ট্রেলিয়ান। সাউথ ওয়েলসের দিকে একটা ফার্ম হাউস চালায়।’
‘এরপর আর খুঁজে পাননি?’
‘না, পাইনি।’
তনু চোখভরা মমতা নিয়ে বলল,
‘এই ঘটনার সাথে আমার সম্পর্ক কি?’
‘কোন সম্পর্ক নেই।’
‘তাহলে কেন ডেকে আনলেন?’
‘জানি না। তোমার সমস্যার কথা বল। কি নিয়ে কথা বলতে এসেছিলে?’
তনু হাসল। কিছুক্ষন আগের মমতা চোখ থেকে উধাও। সেখানে বিচিত্র সকল অনুভূতি। তনু বলল,
‘আমি আমার ব্যাপারে কিছু বলতে চাই না।’
‘কেন?’
‘তখন ইচ্ছা করেছিল, এখন করছে না।’
‘তাহলে কি তুমি চলে যাবে?’
‘না, চলে যাব না। আমি সমস্যার সমাধান নিয়ে যেতে চাই।’
‘সমস্যা না জানলে সমাধান দিব কিভাবে?’
তনু রহস্যমাখা হাসি নিয়ে বলল,
‘সেটা আপনি বুঝবেন। সবাই সমস্যা বলে। আমি বলব না। আপনি সমস্যা খুজবেন। এরপর সমস্যার সমাধান করবেন।’
তনুর মুখে এখনো রহস্যমাখানো হাসি খেলছে।

তনু অভিজাত ও রূপবতী। এই দুই মিশ্রণের নারীরা স্বাভাবিকভাবেই ঘাড়ত্যাড়া টাইপের। এরা যুক্তির ধার ধারে না। নিজে সমস্যার কথা বলবে না আবার সমাধান নিয়েই যাবে। বড় যুক্তিহীন আবদার। তনু বলল,
‘সমাধান করুন?’


তনু আমাকে তেমন গুরুত্বপুর্ণ তথ্য দেয়নি, যে তথ্য ধরে আগানো যাবে।
আমি বিশ্লেষনধর্মী মানুষ। দু-চারটে অসঙ্গতি পেলে তাদের জোড়া লাগিয়ে কিছু একটা দাড় করাতে পারতাম। তনুর সাথে আমার দীর্ঘ কথোপকথন হয়নি। হলে বেশ ভালো হত। দীর্ঘ কথোপকথন হলে-অনেক কথার মাঝে অবচেতনভাবে দুয়েকটা তথ্য বের আসে। তনুর ব্যাপারে সেই তথ্য বের করার সুযোগ নেই। তনু দরজা দিয়ে বের হবার সময় শুধু একবার বলেছিল, ‘আমি একটি অপরাধ করেছিলাম।’ তনুর সেই অপরাধটি কি?
তনু অধৈর্য্য হয়ে বলল,
‘বাঘবন্দি মিসির আলি নামে বইটা পড়েছেন?’
‘না পড়িনি।’
‘পড়লে বুঝতে পারতেন। সেখানে মিসির আলিকে বিপদে ফেলানোর চেষ্টা করা হচ্ছিল। আমি কি আপনাকে সেরকম বিপদে ফেলেছি?’
‘না। তুমি আমাকে বিপদে ফেলনি।’
‘না ফেললে কথা বলতে পারছেন না? মিসির আলি তো চমৎকার করে বলতে থাকে।’
‘আমি মিসির আলি নই। আমি নাজীব। ডাক্তার নাজীব। আমি অতি নগণ্য এক মানুষ। আমার জ্ঞান সীমাবদ্ধ।’
‘আপনি নগণ্য নন। নগণ্য হলে আমি আসতাম না। আমার সম্পর্কে আপনার প্রথম তথ্য কি?’
আমি তনুর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বেশ গম্ভীর গলায় বললাম,
‘তোমার বাবা কেমন আছে?’
সমস্যার সাথে সম্পর্কহীন প্রশ্নটি এক ধরনের খেলা। তনু বাঘবন্দি খেলতে চাচ্ছে। সে তার মত করে একটা শক্ত চাল দিয়েছে। আমার কাছ থেকে সে কি আশা করছে? আমি তার মত করে পরের চাল দিব? এই সুযোগ দেওয়া যাবে না। বাঘবন্দির প্রথম শর্ত হল----সম্পূর্ণ উল্টো ধরনের চাল দেওয়া। যে চালের সাথে খেলার সম্পর্ক নেই। এতে প্রতিপক্ষ ঘাবড়ে যাবে। সে এমনটা আশায় ছিল না।
আমার প্রশ্ন শুনে তনু চমকে গেল। কিছুক্ষন সময় লাগল চমক ভাঙ্গতে। ইতস্তত করে বলল,
‘উনি ভালো।’
‘শুধু ভালো নাকি ভালো আছেন?’
তনু ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ভালো আছেন।’
আমি গম্ভীর হয়ে বললাম,
‘তোমার বাবা মৃত। মৃত মানুষ কিভাবে ভালো থাকেন?’
তনু আরেকবার চমকে গেল। চোখ বড়বড় করে বলল,
‘কিভাবে বুঝলেন?’
‘তোমাকে জিজ্ঞাসা করার পর বললে, ‘উনি ভালো’। বড় জটিল উত্তর। তোমার জবাবটা হওয়া উচিত ছিল-বাবা, ভালো আছেন। প্রথমবার ‘আছেন’ শব্দটি বলোনি। পরের বার ‘আছেন’ শব্দটা উচ্চারণ করার আগে তুমি একটু সময় নিয়েছ। খুবই অল্প সময়। তবে বোঝা যায়। তুমি সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলে না, কি বলবে।
শুধু ‘ভালো’ বললে বোঝা যায় না----উনি বেঁচে আছেন নাকি মরে গেছেন। তুমি সেই কৌশলটা কাজে লাগিয়েছ। প্রশ্ন শুনে কিছুটা চমকেও গেছ। তোমার আইবল খুব মৃদ্যু কাঁপাকাঁপি (Psychological Nystagmus) করছিল। সজ্ঞানে মিথ্যা বলার সময় এটা হয়। এত মৃদ্যু কম্পন যে সবার চোখ এটা ধরতে পারবে না। আমি পারি। এটা আমার একটা বিশেষ ক্ষমতা। এই ক্ষমতা অর্জন করতে আমাকে দীর্ঘ দুই যুগ খাটতে হয়েছে। তুমিই বলো-কোনটা সত্য? তোমার বাবা তোমার সাথে থাকে না অথবা মারা গেছে।’
তনু বিমর্ষ কণ্ঠে বলল,
‘বাবা গত বছর মারা গেছেন। তার সাথে আমার সমস্যার কি সম্পর্ক?’
‘সম্পর্ক নেই। তোমার স্বামীকে কেন পছন্দ করো না?’
তনু আরেকবার চমকে গেল। চমকের ব্যাপারটা একবার আসলে সহজে দ্বিতীয়বার আসে না। আমি চেষ্টা করছি বারবার চমকে দেবার। বাঘবন্দি খেলায় অতিরিক্ত বুদ্ধিমান ভাবা মানুষদের মস্তিষ্কে ঢুকতে হলে তাদের চমকের উপর রাখতে হয়। শত্রুপক্ষকে অস্থির রাখতে হবে। বুঝতে দেওয়া যাবে না----তীর ধেয়ে আসবে কোনদিক থেকে।
তনু মৃদ্যু কণ্ঠে জবাব দিল,
‘স্বামীকে অপছন্দ করব কেন?’
‘অপছন্দ করার কারণ পরে বিবেচনা করা যাবে। তার সাথে তোমার বর্তমান সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না----কেন?’
‘সম্পর্ক তো ভালো ছিল। এখন ডিভোর্স।’
‘ডিভোর্স কথাটাও কি মিথ্যা বললে?’
‘হুম। আপনি কিভাবে বুঝলেন?’
‘তোমার মাঝের সিঁথিতে সিঁদুরের অস্তিত্ব এখনো আছে। সম্ভবত সিঁদুর পরে বাসা থেকে বের হয়েছ। পরে কোথাও তুলে ফেলেছ। তুলে ফেললেও সিঁদুরের অস্তিত্ব অল্প করে বোঝা যাচ্ছে। সিঁদুর থাকা মানে---তুমি বিবাহিত। সিঁদুর তুলে ফেলা মানে---বিয়ের প্রতি তোমার দায়িত্বজ্ঞান অল্প। দ্বিতীয়ত, হিন্দু ধর্মে নারীরা পুরুষদের ডিভোর্স করতে পারে না। সেই সুযোগ তাদের দেওয়া হয়নি।’
তনু জবাব দিল না। তার চোখ স্থির হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
‘তুমি কি বাসার বাইরে কারো সাথে দেখা করতে বের হয়েছ?’
‘এ ব্যাপারে আমি কোন কথা বলব না। আপনার যুক্তি কি বলে?’
‘আমার যুক্তি বলে কেউ একজনের সাথে দেখা করতে বের হয়েছ।’
তনু হেসে বলল,
‘সেই মানুষটা আপনি।’
‘আমি নই। অন্য কেউ। অন্য কোন পুরুষ মানুষ।’
‘মেয়ে মানুষের সাথেও তো দেখা করতে পারি।’
‘পারবে না কেন, অবশ্যই পারো। কিন্তু কোন রূপবতী তরুনী এত চমৎকার সেজেগুজে অন্য কোন নারীর সাথে দেখা করবে না। তোমার মুখে হালকা মেক-আপ করা। নেইল পলিশ করা। সম্ভবত পার্লার ঘুরে এসেছ। এত সাজগোজের উদ্দেশ্য কোন মেয়ের জন্য নয়।’
তনু জবাব দিল না।
‘সেজেগুজে বের হয়েছ কিন্তু সিঁদুর তুলে ফেলা। সিঁদুর ততক্ষণ ছিল যতক্ষন তুমি বাড়ির লোকদের সামনে ছিলে। যেই বের হয়েছ, তুলে ফেলেছ। তুমি চাও না সেই মানুষের সামনে দাড়ানোর সময় তোমার মাথায় সিঁদুর থাকুক। বড় জটিল সম্পর্কের কোন পুরুষ। তার নাম কি?’
‘সেটা আপনিই বলুন।’
‘আমি সব বলতে পারি না তনু। আমি শুধু শিকলের মতো একটার পর একটা প্যাঁচে যেতে পারব। এর বেশি কিছু নয়। আচ্ছা----আমি তোমার ব্যাপারটিকে একটু এগিয়ে দিই।
যে ছেলের সাথে দেখা করবে সেই ছেলেকে তোমার পরিবার চেনে না। তারা জানলে ঝামেলা তৈরি হতে পারে। তাই একা দেখা করতে এসেছ।’
‘কেন এমন ভাবছেন?’
‘এমন ভাবনার পেছনে যুক্তি আছে। তুমি সাধারণত একা চলো না। কিছুক্ষন আগে আমার বাসা থেকে বের হয়ে তুমি যখন রাস্তায় দাড়ালে, আমি ব্যালকনী থেকে তোমাকে খেয়াল করেছি। রিক্সায় উঠতে তোমার কষ্ট হচ্ছিল। এমনভাবে উঠছিলে, মনে হচ্ছিল তুমি কখনো রিক্সায় উঠোনি। তুমি চড় গাড়িতে। সেই গাড়িও আজ তুমি আনোনি। তুমি চাও তোমার বাইরে আসার ব্যাপারটি কেউ না জানুক। এমনকি ড্রাইভারও না। ঠিক বলেছি?’
‘জ্বি বলেছেন। আমার উদ্দেশ্য তো অন্যকিছুও হতে পারে।’
‘অবশ্যই পারে। তার নাম কি?’
তনু অসহায়ের মত বলল,
‘মনসুর।’
‘তার সাথে তোমার কতদিনের পরিচয়?’
‘পাঁচ বছর। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকত। প্রচণ্ড অপছন্দ করতাম। ড্রাগ ফ্রাগ নিত। বাজে ছেলে। ছয় মাস জেলেও ছিল। কোন এক অজানা কারণে তার মত ছেলের সাথেই আমার প্রেম হল।’
‘এরকম ছেলের সাথে প্রেম হওয়া অস্বাভাবিক নয়। রূপবতীরা সুদর্শন বা শান্ত ছেলেদের খুব একটা পছন্দ করে না। যা করে তার নাম মায়া। তুলনামূলক বাজে ছেলেরাই রুপবতীদের বগলদাবা করে ঘোরে। এটা পরীক্ষিত। মনসুরের সাথে কতদিনের সম্পর্ক?’
‘পরিচয় পাঁচ বছরের। প্রেম এক বছর থেকে।’
‘ওহ।’
তনু অসহায়ের মত আমার দিকে তাকালো। বেশ শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল,
‘আর প্রশ্ন করবেন না?’
আমি বললাম,
‘না, করব না।’
‘কেন করবেন না? সাইকিয়াট্রিস্টরা তো অনেক আজেবাজে প্রশ্ন করে। সুন্দরী মেয়ে দেখলে জিজ্ঞাসা করে----শারিরীক সম্পর্ক করেছেন? স্বামী ছাড়া অন্য কার কার সাথে? কয়বার করেছেন? কোথায় করেছেন? অন্য কেউ জানে কী-না? জোর করে না-কী স্বেচ্ছায় সম্পর্ক? পেটে বাচ্চা এসেছিল? অ্যাবরশন করেছেন কোথায়?’
‘আমি সাইকিয়াট্রিস্ট নই তনু। আমি সামান্য ডাক্তার। একসময় প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা করতাম। এখন সেটাও ছেড়ে দিয়েছি। আজকাল একা থাকি। মাঝেমাঝে বই পড়ি। মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমার আগ্রহ কম।’
‘আগ্রহ না থাকলেও বলি, মনসুরের সাথে আমার শারিরীক সম্পর্ক হয়েছে। দুইমাস আগে। স্বেচ্ছায়। আমার আগ্রহই বেশি ছিল।’

আমি চোখ বন্ধ করলাম।
বিচিত্র কারণে শারিরীক সম্পর্ক টাইপের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপারটি নিয়ে কথা বলতে তেমন আগ্রহ হচ্ছে না। কবিতার তৃতীয় লাইনটি মনে আসবে আসবে করছে। আমি চিন্তাকে কেন্দ্রীভূত করার চেষ্টা করছি।
তনু ভরাট গলায় বলল,
‘আমি বড় বিপদে।’
আমি চোখ বন্ধ রেখেই জিজ্ঞাসা করলাম,
‘তুমি বিপদে আছো, বুঝতে পারছি।’
‘কি বুঝতে পারছেন?’
‘তোমার পেটে একটা ভ্রুন বড় হচ্ছে। তোমার ধারণা, এই ভ্রুনের পিতা-মনসুর।’
‘এটা কি আপনার ধারনা?’
‘না, ধারনা নয়।’
‘কিভাবে বুঝলেন পেটে বাচ্চা আছে?’
‘বোঝার অনেকগুলো পথ আছে। পেটে বাচ্চা আসার প্রথম ট্রায়ামস্টারে মেয়েদের বমিবমি ভাব হয়। নাকের ঘ্রাণসংবেদী স্নায়ু অতিরিক্ত কাজ করে। আমার বাসার পাশ দিয়ে একটা একটা ড্রেন চলে গেছে। সেই গন্ধ দোতলায় আসতে পারছে না। তবুও তোমার নাক সেই গন্ধ ধরতে পারছে। বারবার তুমি জানালার দিকে তাকাচ্ছ। গন্ধের উৎস খোজার চেষ্টা করছ অথচ আমার নাক ধরতেই পারছে না।’
‘আর কোন যুক্তি আছে?’
‘তোমার চোখেমুখে এক ধরনের আলাদা সৌন্দর্য্যের আভা ( Glow of Pregnancy) খেলছে। গর্ভবতী অবস্থায় এই আভা চলে আসে।’
তনু মুখ ঢেকে রেখেছে দু-হাত দিয়ে। আমি চোখ বন্ধ করেই বুঝতে পারছি----তনু কান্না চেপে রাখতে চেষ্টা করছে। পারছে না। বারবার কেঁপেকেঁপে উঠছে। তার ফোঁপানোর শব্দ অল্প করে বোঝা যাচ্ছে।
চোখ খুলতে ইচ্ছা করছে। এত চমৎকার রূপবতী মুখের সৌন্দর্য্য কাঁদার সময় বদলে যায় নাকি অপরিবর্তিত থাকে----জানতে ইচ্ছা করছে। আমি চোখ খুলতে পারছি না। চোখ খুললে তনু লজ্জা পেতে পারে। তাকে লজ্জা দিতেও ইচ্ছা করছে না। তনু কান্না থামিয়ে বলল,
‘আর কিছু বুঝতে পারছেন?’
‘মনসুর কি এখন জেলে আছে?’
‘হুম।’
‘তুমি কি তার সাথে দেখা করতে গিয়েছ?’
‘জ্বি। আজ দুপুরে দেখা করেছি।’
‘মনসুর কি বলেছে?’
তনু দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। শ্বাস ভরা বেদনা।
‘তাকে জানানোর পর উল্লেখযোগ্য কিছু বলেনি। কড়া গলায় কয়েকবার বলেছে- গেট আউট, কয়জনের সাথে শুইছিলি, মাগী?’
‘তুমি এখন কি করতে চাও?’
‘আমি কি করতে চাই, সেটা আমি স্পষ্ট জানি। আপনিই বলুন আমি কি করতে চাচ্ছি।’

বাঘবন্দি খেলায় এবার তনুর চাল দেবার পালা।
সে জানে, খেলার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ চলছে। এই মুহুর্তের চাল সবচেয়ে বিপদজনক চাল। খেলার শেষ চাল। বাঘবন্দি হবার সময়। এখানে তনু ভুল করলে আমি জিতে যাব। তনু ঠিক করলে আমি হেরে যাব। আমার ধারনা-আমি একা না, আরো কেউ হেরে যাবে। কে সে?
তাকে খুজে বের করার আগে গুরুত্বপুর্ণ হল, বাঘবন্দি চাল কি হবে? বড় বিপদজনক চালটি তনু কি ভেবেছে?
বাঘবন্দি খেলায় আমি অনেকটা এগিয়ে আছি। এই খেলায় এগিয়ে থাকার খুব একটা মূল্য নেই যদি তনুর চাল ভুল না হয়। যেকোন মুহুর্তে বোর্ড ঘুরে যেতে পারে। নিয়ন্ত্রন চলে যেতে পারে তনুর হাতে। আমার ভাবনা জুড়ে বাঘবন্দি।
তনু মৃদ্যু হেসে বলল,
‘কথা বলছেন না কেন?’
‘ভাবছি।’
‘কি ভাবছেন?’
‘কবিতার লাইনটা নিয়ে।’
‘পেলেন?’
‘না।’
‘এখন কি পকেট থেকে বই বের করবেন?’
‘না।’
‘ঠিক আছে। এবার বলুন, আমি কি করতে চাচ্ছি?’
তনুর চোখেমুখে হাসির ঝিলিক। আমাকে বন্দি করার ঝিলিক। আমি বললাম,
‘তুমি আত্মহত্যা করতে চাও?’
তনু হেসে ফেলল।
‘আমি শিক্ষিত মেয়ে। আপনার এতক্ষন ধরে কথা বলার পর বোঝার কথা---আমার মস্তিষ্ক এত উদ্ভট চিন্তা করবে না।’
‘ঠান্ডা মস্তিষ্ক ভুল করে তনু। বিপদজনক ভুলগুলো তারাই বেশি করে। তুমি কি অ্যাবরশন করতে চাচ্ছ?’
‘না। একটা খুন করতে চাচ্ছি। সব কিছু ম্যানেজ করেছি। এখন শুধু একটা ভালো দিনের অপেক্ষা।’
তনুর মুখে হাসি। এই হাসির অর্থ উদ্ধার করা অসম্ভব। আমি চমকে গেলাম। মস্তিষ্ক উত্তেজিত হবার চেষ্টা করছে। উত্তেজিত হতে দেওয়া যাবে না। শেষ চালের আগেও কিছুটা সময় আছে। নিজেকে বিপদজনক সীমা থেকে বের করে আনতে হবে।

মস্তিষ্ক দ্রুত কাজ করতে শুরু করেছে। তনু কি সত্যিই খুন করবে?
হ্যা, খুন করার সম্ভাবনা প্রবল। ঠান্ডা মস্তিষ্কের চিন্তাভাবনা পরিষ্কার হয়। তনু পরিষ্কার চিন্তা করেছে খুন করার। সে করবেই। কাকে করবে? মনসুর? সে তো জেলে।
কমল? তাকে খুন করার কারণ কি? তার তো দোষ নেই।
নাকি অন্য কেউ?

আমি ভয়ংকর ভাবে চমকে গেলাম।
আমি তনুর চোখকে পড়তে পারছি। তনু কাকে খুন করবে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। তার মারাত্মক সুন্দর চোখের ভেতর সহজেই ঢোকা যাচ্ছে। সে ভয়ংকর পরিকল্পনা করেই এসেছে। আমার সাথে সমস্যার সমাধান তার মূল উদ্দেশ্য নয়। তার উদ্দেশ্য বড় ভয়াবহ। সাইকোপ্যাথ ছাড়া কেউ এভাবে ভাবতে পারে না। তনু সাইকোপ্যাথ। সাইকোপ্যাথরা ভুল চাল দেয় না।


তনু ক্রস-লেগ করে বসে আছে।
তার সীনা টান। রোমান মিথলজির যুদ্ধদেবী বেলোনার ছাপ চোখেমুখে। দৃষ্টিতে মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস। আমি আন্তরিকতার সাথে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘খুন কবে করবে, ঠিক করেছ?’
‘হুম। আগামী পূর্ণিমায়।’
‘খুনের জন্য পূর্ণিমা বেশ ভালো সময়। একটা প্রশ্ন করি?’
‘করুন।’
‘খুনের সময় আমি উপস্থিত থাকতে পারি? সাধারণ দর্শক হিসেবে। বাধা দিব না।’
‘কেন থাকতে চান?’
‘পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড নিয়ে আমার প্রবল আগ্রহ। পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডে হুট করে কিছু ঘটানোর সুযোগ নেই। খুনিকে ভাবতে হয়। খুনের নকশা আঁকতে হয়। সবকিছু ঘটবে ঠাণ্ডা মাথায়। খুনির অনুভূতি গোপন থাকবে। মুখে ঝুলবে নকল অনুভূতি। শিকার খুনির মুখ দেখে মুগ্ধ হয়ে বলবে----বড় নিষ্পাপ মুখ।
অপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডে খুনিদের খুব একটা বৈচিত্র্য নেই। নিজেও কিছু বোঝার আগেই সব ঘটিয়ে ফেলে।
তুমি অতি রূপবতী। খুন করার সময় তোমার মুখের অনুভূতি কেমন হয়, আমার দেখার আগ্রহ। আগ্রহ মেটানোর জন্য হলেও আমি থাকতে চাই।’
তনু হেসে বলল,
‘ঠিক আছে। আপনি থাকতে পারেন।’

তনুর আত্মবিশ্বাস অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে।
সাইকোপ্যাথদের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে। এরা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের বাজে দিক হল- এক সময় নিজের অজান্তেই একটা চোখ বন্ধ হয়ে যায়। ভুল পদক্ষেপগুলো সহজে দেখতে পায় না।
তনুর এখন এক চোখ বন্ধ।


উত্তরা।
আজমপুর।
হাউজ বিল্ডিং গলির ভেতরের দিকে তনুদের বাড়ি। বিশাল বাড়ি। সদর দরজার সামনে দেড়হাত জায়গায় লাল গোলাপ লাগানো। বড়বড় শাহী গোলাপ। দলবল নিয়ে ফুটে আছে। শেষরাতে অল্প বৃষ্টি হয়েছিল। বৃষ্টির ভারে গোলাপেরা কিছু পাপড়ি ঝরিয়ে ফেলেছে। গোলাপতলায় তাকালে মনে হবে----পাপড়ির বিছানা।

কমল অফিসে।
বুধবার। পূর্ণ কার্যদিবস। কমলের ফিরতে দেরি হবে।
আমাকে বসতে দেওয়া হয়েছে কমলের লাইব্রেরী ঘরে। বসতে বলে তনু আধঘন্টা হল গোসলে চলে গেছে। যাবার আগে এক কাপ চা রেখে গেছে। সাথে পিরিচ ভরা নোনতা বিস্কুট।
দুধ চা। চায়ের উপর মশলা ভাসছে। আন্দাজে বলা যায়----দুধ চা খেতে চমৎকার। চমৎকার চা এখনো খাওয়া হয়নি। ঠান্ডা হয়ে আছে। উপরে দুধের একটা ঘন সর।

আধঘন্টা হল।
নতুন করে কোন চা আসে নি। অতিথি আসলে বাড়িওয়ালা না থাকতে পারলে কাজের লোককে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়----অতিথির পাশে থাকতে। এই বাড়িতে সে ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। আমি একা চা পাশে রেখে চেয়ারে বসে আছি।

কমলের লাইব্রেরী ঘরের অতি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিই।
বিশাল হলঘর। দেয়ালে কাঠের তাক। তাক ভরা বই। বই এর পরিমান দেখে আমি চম

আপনার মতামত দিন:


নির্বাচন এর জনপ্রিয়