Ameen Qudir

Published:
2017-01-24 14:37:30 BdST

মা অামার মা



ডা. শিরিন সাবিহা তন্বী
___________________________________


মায়ের শান্ত মুখখানার দিকে অপলক চেয়ে থাকতে থাকতে জীবনে প্রথম বার হয়ত চোখ ভিজল চল্লিশোর্ধ শাহেদের।ধীর,শান্ত,ফ্যাকাশে মুখ।ঠোঁটের কোনে যেন সেই চিরাচরিত ম্লান হাসিটুকু।পার্থক্য শুধু এখানেই।আজ সে হাসিটা প্রসারিত করে বলবে না,ছোট খোকা যে!আয় আয়!কেমন আছ মানিক আমার??জীবনে প্রথম বার মার জন্য বুকটা বড্ড জ্বালা করে উঠল শাহেদের।এই মুখ আজ শেষ বারের মত দেখছে।আর কখনোই দেখবে না।কখনোই না????

মা তো অনেকদিন যাবৎ ভুগছিল।ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছে মায়ের শ্বাসকষ্ট আছে।গত বছর ফুসফুসে পানিও জমেছিল।সবাই খুব করে বলেছিল ঢাকা গিয়ে চিকিৎসা করাতে।তার ছেলে যুগ্ম সচিব।মা কখনো কিছু আব্দার করেনি শাহেদের কাছে।গত শীতে কথাচ্ছলে বলেই ফেলেছিল,ঢাকায় শুনেছি বুকের অসুখের বালা চিকিৎসা হয় বাবা।বুকটায় বড় কষ্ট।শাহেদের পরের সপ্তাহেই দিল্লী ট্যুর ছিল।তাই এড়িয়ে গিয়েছিল।এসে শুনল মফস্বলে সরকারী হাসপাতালে ট্রিটমেন্ট শুরু হয়েছে!

দিন পনের আগে বড় ভাই যখন ফোন দিয়ে বলল,মার বড্ড বাড়াবাড়ি হচ্ছে,তখন ও সময় পায়নি শাহেদ।বড় মেয়ে জেএসসি শেষ করেছে।কথা দিয়েছিল এক্সাম শেষ হলে ওর অনারে বালি দ্বীপে ছুটি কাটাবে!মেয়েকে দেয়া কথা রেখেছে শাহেদ!মাকে দেখতে আসেনি।

কাল নেহায়েত দায়সারা ভাবেই মেজ ভাই ফোন দিয়েছিল,মা খুব কষ্ট পাচ্ছে।তোকে দেখতে চায়!সময় পেলে একটি বার আসিস!
কাল কি হলো শাহেদ জানে না।একটা গভীর হাহাকার,একটা শূন্যতা!বিষাদে যেন পৃথিবী ছেয়ে গেল।এতটা পথ পাড়ি দিয়ে যখন বাড়ীতে পা রেখেছে,ততক্ষনে মা তার কোলের ছেলেকে দেখার আশা জলাঞ্জলি দিয়ে পৃথিবী ছেড়েছে।

সারা বাড়ীতে যেন চাপা কান্না।বড় দু ভাই,ভাবীরা,ছোট বোন দুটো এদের সকলের বাচ্চারা সবাই কাঁদছে।চেনা অচেনা অনেক আত্মীয়।উৎসুক হয়ে সবাই দেখছে ওকে।খুব খেয়াল করে লক্ষ্য করল শাহেদ।সবার দৃষ্টিতে সম্ভ্রম আছে,সাথে উপেক্ষা।আন্তরিকতা নেই।ভালবাসা নেই।আত্মীয়রা সবাইকে শান্তনা দিচ্ছে।ওকে কেউ দিচ্ছে না।যেন ওর মা মারা যায় নাই।যেন ওর কোন শোক ই নাই।

আপনমনে হাসল শাহেদ।তাইতো!ওর তো কিছুই হারায়নি।ঢাকায় আলিশান কোয়াটার্র,সপিং সেন্টার,ফ্ল্যাট,গাড়ী,বড়লোক রিটায়ার্ড এসপি শ্বশুড় আর তার বিশাল আত্মীয়ের পঙ্গপাল!সবই তো একরকম ই আছে।ওর শোক কিসের??

হাই স্কুলের দাঁড়োয়ান ছিলেন বাবা।মাষ্টার মশাইরা খুব ভালবাসতেন।ছোট চাকরী করতেন।অথচ শিক্ষানুরাগী দেখে সবাই খুব সাহায্য করতেন ওদের ভাইবোনদের পড়াশুনায়!বড় ভাই গার্লস স্কুলের শিক্ষক,মেজ ভাই একটি এনজিওতে।বোন দুটো প্রাইমারী স্কুল শিক্ষিকা।

 

শাহেদ এদের থেকে আলাদা ছিল।ক্লাসে শুধু প্রথম ই হতো না,অনেক পার্থক্যে থাকত দ্বিতীয় স্থান অধিকারী।কোচিং করার টাকা ছিল না।মেডিকেলে চান্স পেল না।ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ইংলিশে পড়ল।এই পথটা ওর জন্য সহজ ছিল না।একা অনেক কষ্ট করেছে।শুধু ভাবেনি কখন ও,ওর থেকে বেশী কষ্ট মা করেছে।বাবা করেছে।
চাকরী পাবার পরের বছর বাবা মারা যায়।হার্ট এট্যাক করে।হার্টে অসুখ ছিল।চিকিৎসা হয়নি।গরীব বাবা মায়ের সচিব ছেলে!দুজন ই বিনা চিকিৎসায় মারা গেল একরকম!তবে কেন এত বড় অফিসার হতে গেলাম!নিজের জন্য?শুধু নিজের!

 

কেউ একজন এক কাপ চা এনে রাখল।মনে পড়ল!মা শীতের সকালে খেঁজুর রসের পায়েস করতেন।কালজিরা চালের আর কচি নারকেল কোড়া দিয়ে ঝাঁউ রাঁধতেন।বাবা চেটেপুটে খেয়ে বলতেন,লতু আর এক চামচ হবে?মার নাম লতা।বাবা লতু ডাকতেন!কোনদিন বা চিতই পিঠা,মরিচ ভর্তা,গুড় নারকেল।কিংবা ধোয়া ওঠা গরম ভাপা,পাটিসাপটা বা দুধ কুলি।শাহেদ নাক সিটকাত!এর কি খায়?ঢাকায় কত কেক,বার্গার,পেষ্ট্রি,পিৎজা,হরেক রকম কাবাব।
মা অধীর আগ্রহে ওর ছুটির অপেক্ষায় থাকত।রাত ভর খেঁটে পিঠা করত।ও খেত না।

 

সবাই আগ্রহ করে খেত।মা আঁচলের কোনে চোখ মুছত।আজ বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে মাকে ডেকে বলতে মা,রুটি পিঠা করো।চাঁদের মতো গোল তোমার হাতের পিঠা।সাথে নারকেলের ঝোল,কষা হাসের মাংস আর আলান!অনেকদিন পেট পুরে খাইনা।আজ পেট ভরে খাব।ডুকরে কেঁদে উঠল শাহেদ।মুহূর্তে সামলে নিল নিজেকে।মাকে দাফন করে বিকেলেই ফিরল শাহেদ।
এ যেন আর সে নয়।এক নিঃস্ব ফকির অপ্রকৃতস্থ শাহেদ।স্বভাব সুলভ গাম্ভীর্যে নিজের স্টাডি রুমে ঢুকল শাহেদ।


বাহিরে একটা দীর্ঘ কালো রাত নেমেছে।বাড়ীতে স্ত্রী কন্যারা কেউ নেই।কারো বার্থ ডে পার্টিতে গেছে।মাতৃহারা এই বেদনা কেবল ওর।নিজেকে যাযাবরের মত লাগল শাহেদের।যারা ওর আপনজন তাদের ও বহু আগেই পর করেছে।আর যারা ওর আপন নয়,তাদের ভালবেসে তাদের কৃষ্টি কালচারে বড় করেছে ওর মেয়েদের।এরা সবাই আলাদা।খুব দূরের।ওর আপন কেউ নয়।

 

অন্ধকার বাড়ছে।বাতি জ্বালেনি শাহেদ।মা খুব ভাল উল বুনত।বছর কয়েক আগে একটা সোয়েটার বুনে দিয়েছিল শাহেদকে।পরেনি শাহেদ।বাড়ীর কেয়ারটেকারকে দিয়ে দিয়েছে ওর স্ত্রী।ভাবছিল এটা ছাড়া মায়ের আর কোন চিন্হ ই তো নেই।হঠাৎ ই মনে হলো।আসার সময় ব্যাগে একটা কাঁথা দিয়েছে ছোট বোন।মা নিজের শাড়ী দিয়ে তার জন্য বানিয়েছিলেন।দেয়ার আগেই দুনিয়া ছেঁড়ছেন।কাঁথা দেয়ার অভ্যাস নেই শাহেদের।তবু ব্যাগ থেকে কাঁথাটা বের করে জড়িয়ে বারান্দায় বসল শাহেদ।অবিকল মায়ের গায়ের গন্ধ কাঁথাটায়।

 

একটু তন্দ্রা এসেছিল।আচমকা যেন শ্বাস বন্ধ হবার যোগাড়।বুকের বামদিকটাতে প্রচন্ড ব্যথা শাহেদের।একনো ফেরেনি কেউ।তবে কি এভাবেই?একাকী??
মায়ের কাঁথাটাকে শক্ত করে বুঁকে জড়িয়ে অস্ফুটে বলল শাহেদ "মা"!

____________________________

 

ডা. শিরিন সাবিহা তন্বী । দেশের জনপ্রিয় কলামিস্ট। মহৎপ্রতিভাবান কথাশিল্পী। মেডিকেল অফিসার, শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

আপনার মতামত দিন:


নির্বাচন এর জনপ্রিয়