Ameen Qudir

Published:
2016-11-20 22:15:22 BdST

জীবন নামের রঙ্গমঞ্চ থেকে চিরবিদায়ের আগের মুহূর্তগুলো


        

           ছবিটি হাসিমুখে চিরবিদায়ের অপেক্ষমান এক নারীর।

 

 

ডা. প্রভাতী দাস
__________________________


সকালে হাসপাতালের ডায়ালাইসিস ইউনিটে ঢুকতেই নার্স জানিয়েছিল, মিস প্যাজেট আর ডায়ালাইসিস করবেন না। বেশ কয়েক দিন ধরেই তিনি এমন ভাবছেন, কিন্তু ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারছিলেন না। বেশ কয়েক মাস আগেও তিনি একবার এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে আবার তা বদল করেছেন। তাকে ভাবনা-চিন্তার জন্য আরেকটু সময় দেবো বলে, সকালে তাকে না দেখেই বেরিয়ে এসেছিলাম। বিকেলে হাসপাতালের ডিসচার্জ প্ল্যানার কল করে জানালেন, মিস প্যাজেট আর ডায়ালাইসিস করবেন না বলেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছেন, আমার আপত্তি না থাকলে তাকে কালই বাড়ী পাঠিয়ে দেয়া হবে। আমি অফিস থেকে প্রায় সন্ধ্যেয় আবার হাসপাতালে রওনা হলাম।

মিস প্যাজেট-এর সাথে আমার পরিচয় ২০১০-এ , বেশ অনেক বছর ধরে আমাদের প্র্যাকটিসের রোগী। ষাটোর্ধ এই শ্বেতাঙ্গিনী তখন স্থানীয় একটি নার্সিং হোমে থাকতেন। ভীষণ বাজে ডায়াবেটিসের রুগী, তাতেই কিডনি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এরপর পায়ের সব নার্ভ ড্যামেজ হয়ে গেলে,আর হাঁটতেও পারতেন না। তখন নার্সিং হোমে চলে যেতে হয়, নিজের বাড়ি ফেলে। নার্সিং হোমে তার রুম মেট যিনি, তিনি স্ট্রোকের রুগী কথা বলতে পারতেন না। মিস প্যাজেট সারাক্ষণ অপেক্ষা করতেন ভিজিটরের জন্য, কেউ দেখতে গেলে কী যে খুশী হতেন। আমাকে দেখলেও চোখমুখ ঝলমলে হয়ে উঠতো। এখানে অনেক ভালো ভালো নার্সিং হোম থাকলেও এই নার্সিং হোমটি একদম ভালো ছিলোনা, অতো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নয়, কেমন একটা অসুস্থ গন্ধ লেগে থাকতো যেনো এর দেয়ালে দেয়ালে। কর্তৃপক্ষ এবং কর্মচারীরা বাসিন্দাদের যত্নের ব্যাপারেও খুব সচেতন বলে মনে হতো না। আমার একদম ওখানে যেতে ইচ্ছে করতো না। মাসে একবার কোনো রকমে গিয়ে ডাক্তারি দায়িত্ব পালন করতাম। কিন্তু গেলেই বেশ অনেকক্ষণ ধরে মিস প্যাজেট এর কথা শুনতে হতো। তিনি কোনোদিন কোনো অভিযোগ করতেন না, এমনকি হেলাফেলায় দেয়া খাবার নিয়েও তার তেমন কোন অভিযোগ ছিলো না। তার গল্প শুনে শুনেই জেনেছিলাম, তিনি কোনোদিন বিয়েথা করেননি, সন্তানাদিও কেই। একসময় অফিস সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করলেও মা আর ছোটবোনের সাথেই কাটিয়েছেন সারাজীবন। যখন চলে বেড়ানোর ক্ষমতা হারালেন, তখন তার ছোট বোনের পক্ষে নব্বই ঊর্ধ্ব মা আর হুইলচেয়ারে আবদ্ধ বোনের সেবা যত্ন করা খুব কঠিন হয়ে গেলে, তিনি নিজে ইচ্ছে করেই নার্সিং হোমে চলে এসেছিলেন। ছোট বোনের কথা বলতে গেলেই কেমন উচ্ছ্বসিত হয়ে বলতেন-জানো, ও আমার সন্তানের মতো, আমি-ই ওকে কোলেপিঠে বড় করেছি, আমার থেকে ও প্রায় বিশ বছরের ছোট। এই ছোট বোনটির সাথেও নার্সিং হোমেই দেখা হয়ে গিয়েছিল। তিনি প্রতি সপ্তাহে, তাদের ভাইকে মায়ের কাছে রেখে দিদিকে দেখতে আসতেন।

বার্ধক্য জনিত কারণে বছর দুয়েক আগে মিস প্যাজেট-এর মা মারা যান। তাকে নার্সিং হোম থেকে আবার নিজেদের বাড়িতে নিয়ে আসেন তার ছোট বোন। প্রথম দিকে বোনটি-ই তাকে ডায়ালাইসিস সেন্টার এ নামিয়ে দিয়ে যেতেন, উঠিয়েও নিয়ে যেতেন। মায়ের জন্য মন খারাপ করলেও বাড়িতে ফিরতে পেরে মিস প্যাজেট কে খুশী-খুশী লাগতো দেখতে অনেক। মাস ছয়েক আগে, তার পায়ে ইনফেকশন শুরু হয়, সেও সেই ডায়াবেটিস থেকে, পায়ের রক্ত সঞ্চালন খুব কমে গিয়েছিল বলে অনেক দিন বিভিন্ন রকম এন্টিবায়োটিক দিয়েও সেই ইনফেকশন ভালো হলো না। সার্জন বললেন, ডান পাটা কেটে বাদ দিতে। তিনি কিছুতেই রাজি হতে চাইছিলেন না। সেবার-ই প্রথম সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ডায়ালাইসিস বন্ধ করে দেবেন। আমাকে নিজেই বলেছিলেন, তিনি আর বাঁচতে চান না এভাবে। কিন্তু একদিন পরেই সেই সিদ্ধান্ত বদলালেন। ডায়ালাইসিস চললো, ডান পা কেটে বাদ দেয়া হলো, হাঁটুর নীচ থেকে। তবে তিনি আর বাড়ি ফিরে যেতে পারলেন না। এবার আবার নার্সিং হোম, যদিও এটি অন্য একটি, বেশ ভালো একটি নার্সিং হোম। সেখান থেকে এতোদিন ডায়ালাইসিসে আসছিলেন। ছোট বোনটি প্রায়-ই এসে দিদির পাশে বসে থাকতো, ডায়ালাইসিসের সময়। কয়েক সপ্তাহ আগে মিস প্যাজেট-এর বাম পায়ে ইনফেকশন, এবারেও ঔষধে কিছু-ই হলো না। আবার সেই একই সমাধান, পা কেটে বাদ দিতে হবে। এবার মিসেস প্যাজেট পুরো বেঁকে বসলেন, কিছুতেই তিনি এই পা'টি কাটতে দেবেন না। আমরা সবাই বুঝিয়েও কিছু হয়নি। কয়েক সপ্তাহ ধরে হাসপাতালেই ছিলেন। গত দুই দিন ধরে শুধু বলেছিলেন, তিনি ডায়ালাইসিস বন্ধ করে দেবেন, তাহলে আর পায়ের যন্ত্রণায় তাকে অস্থির থাকতে হবে না। বুঝলাম সেই সিদ্ধান্ত-ই আবার নিয়েছেন তিনি।

মিস প্যাজেট এর রুমে ঢুকেই তার ছোট বোনকে দেখলাম, বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। কাঁদছেন অঝোরে। মনে হলো, দিদিকে বোঝাতেও চেষ্টা করেছেন কিছু। আমার দিকে খুব আশা নিয়ে তাকালেন। আমি কিছু বলবো ভেবে মিস প্যাজেট এর দিকে তাকাতেই তিনি আমাকে বললেন,
-ডঃ দাস, তুমি ওকে বুঝিয়ে বলো তো, ডায়ালাইসিস বন্ধ করে দেয়াটাই সবচেয়ে ভাল হবে। তাই না? তাহলে পায়ের এই অসহ্য ব্যথা আর আমাকে সহ্য করতে হবে না। তুমি ওকে একটু বুঝিয়ে বলো।
আমি বুঝলাম, গতবার ওকে ইউরেমিক ডেথ( ডেথ ফ্রম কিডনি ফেইলিওর) যে ব্যথাহীন সেকথা বলেছিলাম, সেটা ও মনে রেখেছে। আমি কিছু না বলে মাথা নাড়লাম তার বোনের দিকে তাকিয়ে। মিস প্যাজেট আবার বলতে লাগলেন,
-ডান পাটা ফেলে দিয়ে তো কিছু হলো না, এখন বাম পা কাটার কথা হচ্ছে, এর পর হয়তো হাতদুটো বা পায়ের উপরের অংশ...। আমি এভাবে আর বাঁচতে চাই না রে। তোর জন্য গতবার ডায়ালাইসিস বন্ধ করতে গিয়েও করিনি। তুই একদম একা হয়ে যাবি। কিন্তু আমি তো সেই নার্সিং হোমেই পড়ে আছি, বাড়ি তো যেতে পারলাম না। আরেকটা পা কেটে ফেললে আর কোনদিন-ই বাড়ি যেতে পারবো না। তার চেয়ে এই ভালো...। তুই কাঁদিস না...। তুই কাঁদলে আমার আবার মন নরম হয়ে যাবে।
আজ জানলাম, কেনো মিস প্যাজেট আগের বার ডায়ালাইসিস বন্ধ করে দেবার সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেন নি, তাকিয়ে আছি, দিদির হাত ধরে বোন দাঁড়িয়ে, দু'জনেই চোখের জলে ভাসছেন। আমি নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বিছানার অন্য পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
-মিস প্যাজেট, কী বলবো ঠিক জানি না। তুমি যা সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই আমার সিদ্ধান্ত। এই তো কিছুদিন আগেই আমরা এ নিয়ে অনেক কথা বললাম। তোমার কিছু জানবার থাকলে, আমি উত্তর দেবার চেষ্টা করতে পারি।
- ডঃ দাস তুমি, তোমরা আমার জন্য অনেক করেছ, ওকে বলো, অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই সব শেষ হয়ে যাবে, তাই না?
আমি মাথা নাড়ি শুধু। কয়েকদিন থেকে সপ্তাহ দুই মতন; আগের বার ওকে বলেছিলাম। আমি তার হাত ছুঁয়ে বললাম,
-তাহলে 'বিদায়', মিস প্যাজেট।
তিনি আমার দিকে হালকা রাগের ভঙ্গীতে তাকালেন,
-তুমি বুঝি এভাবে 'বিদায়' বলবে আমাকে! নাহ, বিদায় বলা যাবে না একদম। বলো, আবার দেখা হবে।
তারপর আমার কিছুটা অবাক দৃষ্টি দেখে বললেন,
-পরপারে আবার দেখা হবে, আমাদের সবার। আমার মা সেখানেই অপেক্ষায় আছেন আমার জন্য।
আমি তার পাশ থেকে সরে এসে, তার বোনের কাছে থেকে আগে বিদায় নিয়ে, তাকে কিছু প্রয়োজন হলে জানাতে বলে মিস প্যাজেট এর দিকে ফিরলাম আবার,
-এবারের মতো বিদায় তাহলে মিস প্যাজেট, আবার কোনো একদিন দেখা হবে হয়তো।
-বিদায় ডঃ দাস। হ্যাঁ, আবার দেখা হবে। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।

মিস প্যাজেট এর ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে ভাবছিলাম, এই পৃথিবীতে জীবিতদের কেউ পরকাল দেখেনি। কেউ পরকাল দেখে এসে বলেনি সে আছে কী নেই, কেমন দেখতে সে জগত, কে থাকে সেখানে প্রতীক্ষায়। অথচ পরকালে কী অটল বিশ্বাস আমাদের সকলের, সেই অনিশ্চিত পরকালের আশায় জীবনের দিনগুলো হেলায় ফেলে দিয়ে কত কত জন মৃত্যুর পথটা পাড়ি দেয় কতো অনায়াসে।

বাড়ী ফেরার পথে গাড়ীর জানালার বাইরে কৃষ্ণপক্ষের প্রথম রাতের চাঁদ। পূর্ণিমার মতো ঢলঢল নয়, তবুও বিশদ জোছনায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর, কী বিষণ্ণ তবুও কী অনিন্দ্য। মিস প্যাজেট তার ঘরে বসে পার্থিব এই চাঁদের দিকে শেষ বারের মতো চেয়ে, এই ম্লান জ্যোৎস্নায় দু'চোখ ভাসিয়ে দিয়ে নতুন যে জগতের কথা ভাবছেন, সে তার জীবন-তুল্য হোক।
_____________________________


লেখক ডা. প্রভাতী দাস । প্রবাসী খ্যাতিমান চিকিৎসক। Nephrologist
Former Post-Doctoral Fellow at Johns Hopkins University
Studies Nephrology and Hypertension at Johns Hopkins University
Studied Internal Medicine at Wayne State University
Studied Medicine at Chittagong Medical College

আপনার মতামত দিন:


নির্বাচন এর জনপ্রিয়