Ameen Qudir

Published:
2020-04-12 17:43:09 BdST

লেখাটি একজন চিকিৎসকের স্ত্রী'র : "লেখাটি পড়ে চোখের পানি আটকে রাখা মুশকিল"


ফাইল সংগৃহীত ছবি। লেখকের ছবি নয়।

ডেস্ক
___________________

  লেখাটি একজন চিকিৎসকের স্ত্রী'র । লেখাটি তার টাইমলাইনে পোস্ট করেছেন। মর্মস্পর্শী লেখা। অনেক পাঠক লেখা পড়ে জানিয়েছেন, লেখাটি পড়ে চোখের পানি আটকে রাখা মুশকিল ।
লেখাটা পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হল।

"ডাঃ আহাদ।আমার স্বামীর নাম।
হ্যা, আমার স্বামী একজন ডাক্তার।
সে কোন সরকারি ডাক্তার না, হয়নি এখনো। বেসরকারি হাস্পাতালে মানুষের চিকিৎসা দেয়। চাইলেই সে এই অবস্থায় তার মানব সেবার কার্যক্রম স্থগিত রাখতে পারে। কিন্তু সে রাখবেনা, তার আবার নিজের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধতা অনেক। দেশের এই ভয়াবহ অবস্থার কথা ভেবে আরো অনেক আগেই আমি তাকে ডিউটি করতে মানা করেছিলাম, বলেছিলাম লাগবেনা তোমার এখন হাসপাতাল যাওয়া, তোমার এইটা ফিক্সড জব না, চাইলেই পরে অন্য হাসপাতালে জয়েন করতে পারবে।

আমি মানা করেছিলাম, করবইতো! আমার স্বামী আর সবার জন্য ডাক্তার হলেও সে আমার দুই সন্তানের বাবা, আমার শশুড়-শাশুড়ীর একমাত্র ছেলে, দুইজন বোনের ভাই। সে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, ওর কিছু হলে আমার কি হবে, আমার সন্তানদের কি হবে, বাবা-মা ওর বোনদের কি হবে? এদেশের মানুষ কি ডাক্তারদের মানুষ মনে করে।?? ওরা তো ডাক্তার কে কষাই বলে! ওর কিছু হলে ওরা তো বিন্দুমাত্র কস্ট পাবেনা, উল্টা হাসিতামাশা করবে। তাদের জন্য ও কেন মরতে যাবে??

না,,,আমার কথা শোনেনি সে। জানতাম শুনবেনা। উল্টা আমাকে বিবেক সম্পর্কিত অনেক গুলা লেকচার দিয়ে সে ২ দিনের জন্য হাস্পাতালে গেল। সেখানে গিয়েই সে সর্দি-কাশি-জ্বরের কবলে পড়লো, এবং ঐখান থেকেই বললো সে বাসায় এসে কারো সাথে দেখা করবেনা, স্পৃহা স্পন্দনকে যেন ওর কাছে থেকে দূরে রাখা হয়। সে আলাদা রুমে থাকবে কিছুদিন। আমি চিন্তায় পরে গেলাম। মেয়েকে খুব বোঝালাম, বাবাই আসলে যেন বাবাই এর কাছে না যায়, মেয়ে বুঝতে চাইলোনা, অনেক বুঝিয়ে রাজি করালাম। ওর বাবাই বাসায় আসলো, আলাদাও থাকলো, আমাদের কারো আশেপাশে আসতোনা, মেয়েটা আমার দুর থেকে দরজা দিয়ে ওর বাবাই কে দেখতো, কাছে যাইতে চাইতো, বাবার সামনে হেসে এসে আমার কাছে এসে চোখ আড়াল করে কান্না করতো, আমি শুধু রুমে গিয়ে খাবার, পানি দিয়ে আসতাম, তাও ওর কাছে গিয়ে না। একটা ছোট টেবিল রাখা ছিল, সেখানে। অনেক কস্ট হতো। ছোট ছেলে তো কিছু বোঝেনা, কিন্তু মেয়ে আমার ভীষণ কস্ট পাইতো। বাবাই ওর সামনে আছে কিন্তু, বাবাই এর কাছে যাইতে পারছেনা, বাবাই ওরে আদর করতে পারছেনা, ওর ছোট্ট মনে কত কিছু চলতো, আমাকে কত কত প্রশ্ন করতো,,তখনি তো দোয়াটা শিখে নিছিলো। আর আমি? আমি ওরে একটু পর পর লেবু মধু আর কালিজিরা দিয়ে গরম পানি দিতাম, নামাজে বসে অনেক কান্নাকাটি করতাম। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর ও সিওর হলো ওর জ্বর সর্দি নরমাল ফ্লু ছিল। এরপর রুম শিফট করে আমাদের রুমে আসলো। তখন আমার মেয়ের খুশি দেখে কে?! বাবাইকে পেয়ে যেন চাঁদ হাতে পেল সে। আমার স্বামী চাইলেই এরপরে ডিউটিতে যাওয়া বন্ধ করতে পারতো। কিন্তু নাহ! সে যাবেই। তাইতো সুস্থ হওয়ার ২-৩ দিন পর আবার চলে গেল হাস্পাতালে।

আজ ১১ দিন হলো সে হাসপাতালে মানুষের চিকিৎসা দিচ্ছে। ১৬ তারিখে ওর বাসায় আসার কথা। এই ১১ টা দিনের প্রতিদিন আমার মেয়েকে আমার উত্তর দিতে হইসে, তার বাবাই বাসায় আসছেনা কেন? কবে তার বাবাই বাসায় আসবে? অথচ আমার স্বামী আজকে আমাকে কল করে বলতেছে বাসায় আসবেনা, আসলেও সেল্ফ কোয়ারেন্টাইনে থাকবে আগের মতো, আমার বাচ্চা কাচ্চাদের থেকে দূরে, বাবা মার কাছে থেকে দূরে। কারণ, সে যেহেতু হাস্পাতাল থেকে আসবে, তার ইনফেক্টেড হওয়ার চান্স বেশী এবং ওর থেকে আমাদের ইনফেক্টেড হওয়া এড়াতে সে বাসায় আসতে রাজী না।

এই হচ্ছে ডাক্তারদের অবস্থা! শুধু আমার স্বামী না, আমার স্বামীর মত আরো যারা ডাক্তার আছেন, সব ফ্যামিলিরই একই অবস্থা! এইসব ডাক্তারদের অনেকেরই বউ বাচ্চা বাবা মা নিয়ে সুন্দর পরিবার। কিন্তু তারা এই সবকিছু ফেলেই মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছে, প্রতিদিন প্রতিনিয়ত। হয়তো ২-১ জন সেবা দিতে পারছেনা, ব্যতিক্রম সব পেশাতেই থাকে। তাই বলে ঢালাও করে যখন বলা হয় ডাক্তার রা রোগী দেখছেন না, পালিয়ে যাচ্ছেন, ডাক্তারদের জন্য যখন মানুষ মৃত্যু কামনা করে,কষাই বলে... তখন আমার সত্যি খুব ঘেন্না হয় ঐ সব মানুষ নামের পশুদের প্রতি, মন থেকে না চাইতেও বদ দোয়া চলে আসে তাদের জন্য! আর আমার স্বামীকে খুব করে চিল্লায়া শোনাতে মন চায়, কাদের সেবা দিতে যাও তুমি? কাদের জন্য নিজের বিবেকের কাছে অপরাধী সাজতে বলো আমায়? এরা তো হাস্পাতাল থেকে সেবা নিয়ে গিয়ে বলবে সালা ডাক্তার কষাই,, দুরে থেকে দেখলো শুধু, কোলে নিয়ে দেখলোনা..এরা ডিউটি করছেনা ঠিকমত, সেবা দিচ্ছেনা ভালোভাবে! আল্লাহ এদের করোনা দাওনা কেন??

আমি যে আমার হাজবেন্ড কে মানা করি হাস্পাতালে যাইতে, এজন্য আমার সত্যি খারাপ লাগেনা, বিন্দুমাত্র বিবেকেও বাধেনা। কেন বাঁধেনা একটু পর বলতেসি। আমার স্বামী বলে সে এখন একটা যুদ্ধে আছে, এগেইন্সট আননোন,,,আর সে নাকি এইটার ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা!! ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা?!! মাই ফুট!! কিসের যোদ্ধা মনে কর তুমি নিজেকে?? ঢাল নাই তলোয়ার নাই, নিজেরে যোদ্ধা মনে করো? তোমার পারসোনাল প্রটেক্টিভ ইক্যুপমেন্ট কোথায়? স্বাস্থ্যমন্ত্রী তো বলেই দিসে, সরকারি ডাক্তার গুলার ব্যবস্থা উনারা করবেন, বেসরকারি ডাক্তারদের দায়িত্ব সরকার নেবেন না। তো? তুমি জানোনা? একসেট পিপিই একবারই পরা যায়?একসেট পিপিইর দাম প্রায় ২০০০ টাকা। তুমি প্রতিদিন নিজের টাকায় পিপিই কিনে পরা এফোর্ড করো?? করোনা তো? তাহলে কেন যাবা? কিসের মিশন? সুইসাইডাল মিশন না এইটা? অথচ এদেশের বোকা পাবলিক বলবে পিপিই কিনতে কয় টাকা লাগে? ডাক্তার রা চেম্বার করে ভিসিট নেয় ৫০০/৭০০/১০০০/১২০০ টাকা! পিপিই নিজেরাই কিনে পরবে। আরে গাধা পাবলিক, নিজের সুরক্ষার জন্য তো বাজারের সব খালি করছো, নিজের সর্দি হলে দৌড় মারো প্রফেসরদের কাছে।তোমাদের তো আবার সাধারণ এমবিবিএস এ চিকিৎসা হয়না! উনারা জানে নাকি কিছু? প্রফেসর তো তার লেভেল অনুযায়ী ফি নেবেনই, অথচ এই সো কল্ড ফ্রন্ট লাইন যোদ্ধা যারা, এদের তো ম্যাক্সিমাম নরমাল এমবিবিএস ডাক্তার, এরাই তো রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে, এবং এদের ম্যাক্সিমামের স্যালারি সর্বোচ্চ ৩০০০০-৩৫০০০ টাকা। এই টাকায় তারা তাদের সংসার চালাবে নাকি পিপিই কিনে পরে রোগীর সেবা দেবে? যেখানে উন্নত দেশগুলাতে হাই প্রোটেক্টিভ পিপিই পরে সেবা দেয়ার পরেও অনেকগুলা ডাক্তার ইনফেক্টেড হয়ে মারা গেসে,সেখানে আমার হাজবেন্ড নরমাল ওটি ড্রেস পরে রোগীর সেবা দিতে গেলে আমি একশোবার মানা করবো, আমার জন্য মানা করবো, আমার বাচ্চাদের জন্য মানা করবো, আমার স্বামীর যদি সুরক্ষা নিশ্চিত থাকতো আমি কখনোই মানা করতাম না!
যেখানে এত অনিশ্চয়তা সেখানে আমি আমার স্বামীকে কিভাবে পাঠাবো? মরার জন্য? ঢাল তলোয়ার থাকলে না হয় মন কে সান্ত্বনা দিতে পারতাম, সব ঠিক থাকার পরেও সে চলে গেল, এইটা আল্লাহর ইচ্ছাই ছিল। কিন্তু জেনে বুঝে ঠান্ডা মাথায় তার সুরক্ষা ছাড়া আমি কেন তাকে মরতে পাঠাবো? আমি তো সবসময় না -ই করবো, যদিও সে আমার কথা শুনবেনা, আমি জানি। সে সেবা করতে যাবে ঐসব পশুদের যারা তাকে কষাই বলবে, যারা দিনশেষে আর্গুমেন্টে লিপ্ত থাকবে এই বলে যে ডাক্তারদের সংসার চলে ঔষধ কোম্পানির টাকায় অথবা ডাক্তারদের সন্তানরা বিদেশ পড়া লেখা করে কোম্পানির টাকায়। অথচ দিনশেষে এরাই পরিচিত ডাক্তারদের ইনবক্সে নক দেয় অথবা মোবাইলে কল দেয় নিজের থেকে শুরু করে আত্নীয় স্বজন সহ সবার অসুখের প্রেসক্রিপশন নেয়ার জন্য। মন থেকে সত্যি সত্যি ঘৃনা এইসব ডাবল স্ট্যান্ডার্ড মানুষদের জন্য।"
---- লিখেছেন Miftaul Jannat

আপনার মতামত দিন:


ক্লিনিক-হাসপাতাল এর জনপ্রিয়