Ameen Qudir

Published:
2017-09-06 17:39:19 BdST

হাসপাতালের জার্নালহাসপাতালের জার্নাল : ডা. সাহেনুর বললো ,না স্যার, ও জিনিস আমি নিই না




ডা. অরুণাচল দত্ত চৌধুরী

________________________________

আধুনিক সময়, অপরিগ্রহ আর তৃতীয় বিশ্বের চিকিৎসক সমাজ সম্বন্ধে কিছু এলোমেলো কথাঃ-
আজ আউটডোরে বসে একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতা হল। অনেকদিন বাদে। আমার পাশের চেয়ারে বসেছিল আমাদের হাউসস্টাফ DrSahanur Mondal। আমার ছোট পুত্রের চেয়েও বয়সে ছোট। আল আমিন মিশন, পরে মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা।

 

এক ছোটোখাটো ওষুধ কোম্পানির সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ এসেছেন দেখা করতে। আউটডোরে প্রচণ্ড ভিড়। কোনওক্রমে ঠেলেঠুলে তাঁর কোম্পানির প্রোডাক্ট বলে চলে যাবেন। তার মধ্যেই দু'খানা করে ডটপেন নামিয়ে রাখলেন আমার আর সাহেনুরের সামনে। তিনি চলে যাবার অনেকক্ষণ পর লক্ষ্য করলাম, আমি যদিও ওই সস্তা পেন দু'টোকে পকেটস্থ করেছি অনেক আগেই, সাহেনুরএর সামনের পেন দু'টো টেবিলে পড়েই আছে। আমি ওকে আলগোছে মনে করালাম। ও বেশ দৃঢ় ভাবে আপত্তি জানিয়ে বলল, না স্যার, ও' জিনিস আমি নিই না।


এইখানে জনান্তিকে একটা কথা জানাই।
আমি, শুধু আমি কেন অনেক ডাক্তারই ওষুধ কোম্পানিদের দেওয়া পেন, সস্তা বা দামী যাই হোক ব্যবহার করে থাকি। ব্যাপারটা এতই স্বাভাবিক মনে হয় যে অন্য প্রশ্ন মনে জাগেনি। আসলে দীর্ঘদিনের অভ্যাস তো! পেনের রিফিল ফুরিয়ে গেলে নতুন রিফিল ব্যবহার না করে নতুন পাওয়া পেন ব্যবহারই দস্তুর যে'খানে।
যার পর নাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করাতে সে বলল, পেনটা ব্যবহার করলে যারা দিল তা'দের প্রতি একধরণের বাধ্যবাধকতা জন্মে যায় বলেই সে ও'গুলো নেয় না। তা' আমি যখন ব্যবহার করি, আমি চাইলে ও'গুলো নিয়ে নিতে পারি।
নিতামও হয় তো। পাশের টেবিলে বসা ডিএনবি পিজিটির পেনের রিফিল ফুরিয়ে যেতে, সে পেন দু'টি নিয়ে আমাকে ভারমুক্ত করল। সাহেনুরের এই যে আচরণ এ'টাকেই সম্ভবত বলে 'অপরিগ্রহ'। কারওর কাছ থেকে কারণে বা অকারণে কিছু না নেওয়া।


এই অপরিগ্রহের এক অনন্য উদাহরণ ছিলেন বুনো রামনাথ। যাঁর স্ত্রী দারিদ্রের জন্য শোনা যায় ভাতের সাথে স্রেফ তেঁতুল পাতার ঝোল দিতেন স্বামীকে, মাঝে মাঝেই।
তো একদিন এক রাজপুরুষ রামনাথকে শুধোলেন,
মহাত্মন, আপনার কি কোনও অনুপপত্তি আছে।
অভাব অর্থে অনুপপত্তি বলতে চেয়েছিলেন তিনি। বুনো রামনাথ যেহেতু অন্য জগতের মানুষ, তিনি অনুপপত্তি বলতে বুঝলেন অমীমাংসীত।
কিন্তু তাঁর তো অধীত বিষয়ে অমীমাংসীত কিছুই নেই। সবিনয়ে সেই কথা জানালেন রাজসমীপে। এই হচ্ছে যথার্থ অপরিগ্রহ। যা মনে পড়ল আমার পুত্রসম সাহেনুরের আচরণে।
যাই হোক, এই প্রসঙ্গে আধুনিক সময়, অপরিগ্রহ আর তৃতীয় বিশ্বের চিকিৎসক সমাজ সম্বন্ধে কিছু বলি। স্বজাতীয় সমব্যবসায়ীদের কাছ থেকে যৎপরোনাস্তি ভর্ৎসনা পেতে পারি জেনেও এই ঝুঁকিবহুল আলোচনাটিতে ঢুকছি।
আদতে, যা পাওয়ার কথা নয়, সে'টি নেওয়া, যাকে কাঁচা কথায় বলে উৎকোচ নেওয়া তার প্রতি আগ্রহের ব্যপারটা, যুগে যুগে সত্যি।
এই লোভ, বিজ্ঞাপিত বিপননের বাজারে যেমন একটা কিনলে একটা ফ্রি সেই জাতীয় নানান অফারে সুপরিব্যপ্ত।


বোফর্স বা সারদা নারদার মত বৃহৎ ব্যাপারের কথা থাক, অফিস কাছারিতেও এই উৎকোচ ব্যাপারটা যে দাবীর পর্যায়ে চলে গেছে সে তথ্য অতি প্রাচীন। তা লোকালয় পুড়বে আর দেবালয় বেঁচে যাবে এ'রকমটা তো হয় না। কাজেই অতি পবিত্র প্রাণরক্ষা(?)কারী ডাক্তারি পেশাটিও এই দহনে যথোপযুক্ত ভাবেই আক্রান্ত।
যে'খানে বড়ই বাজার বাজার গন্ধ। অর্থাৎ একদিকের পণ্য বা পরিষেবা বিক্রেতা মানে ওষুধ কোম্পানি, ল্যাবরেটরি বা নার্সিং হোম নিদেন পক্ষে সার্জেন (যাঁর কাছে রোগী পাঠাবেন জেনারেল প্রাকটিশনার,) সবাই মিলে টোপ ঝুলিয়ে রেখেছে অন্যদিকের দহনোন্মুখ পেশাজীবিটির দিকে।


অনেক ক্ষেত্রেই মধ্যবিত্ত পশ্চাৎপট থেকে উঠে আসা প্রাণীটি নিজেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হবে।
(বলে রাখি এ'খানে,আমার চেনা বহু ডাক্তার এই বাজারি খেলায় যুক্ত নন। তাঁদের নাম আলাদা করে উল্লেখ করব না।)
আর যদি মধ্যবিত্ততার লজ্জাবরণটি না থাকে? তবে তো পোয়া বারো।
এই যে বিদেশে পঁচিশ ত্রিশ লক্ষ টাকা থেকে শুরু করে স্বদেশেই প্রায় কোটি টাকা খরচ করে প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ থেকে এক একটি মেডিকেল গ্রাজুয়েট বেরোচ্ছেন, তাঁদের তো যে কোনও প্রকারে সেই প্রাথমিক পুঁজির বিনিয়োগটি উদ্ধার করতে হবে। তাই তাকে সরাসরি (না না ডটপেনের মত ছুটকো উৎকোচ নয়), টাকা, হ্যাঁ টাকাই নিতে হবে ওষুধ কোম্পানি বা ল্যাবরেটরির থেকে। বিয়ের সময় মেয়ের বাবাকে চাপ দিয়ে নিতে হবে পণ।
আর সেই সাথে চলবে দেদার আনুষঙ্গিক।। প্রমোদ ভ্রমণ। এমনকি মদ্যপান বিরোধী ফাইভ স্টার বৈজ্ঞানিক আলোচনা চলবে… ফলোড বাই ককটেল ডিনার।
চেম্বারে কেউ দেবে দামী গ্যাজেট, পাল্লা দিয়ে অন্যতর উপহার অন্য কেউ।
অপেক্ষাকৃত ছোট মাপের যারা, তারা পাবে প্রেশারকুকার, ডিনারসেট, চিনেমাটির কাপ।
আর এতদিন এই পেশায় থেকে সলজ্জে স্বীকার করি, এই সব পেতে পেতে ক্রমে ভালোও লাগবে। ওই যে, পাওয়ার কথা ছিল না অথচ পাচ্ছি। অভ্যেস হয়ে গেলে মনে হবে, পাওয়ার তো কথাই। সবাইই তো পায়। মাঝ থেকে ঝাঁঝরা হয়ে যাবে মধ্যবিত্ত মেরুদণ্ড।
এইখানে পৌঁছে, আমাকে একটু দম নিতে দিতে হবে। প্রকৃত নিরপেক্ষ সেজে বলতে হবে, হ্যাঁ ইঞ্জিনিয়ারও টেন্ডারে বা বিল পাশ করিয়ে, হ্যাঁ শিক্ষকও পাঠ্যবই বিক্রি করিয়ে, প্রশ্ন ফাঁস করে, আইনের সাথে যুক্তরাও নানা আইনি কেনাবেচায়। আর ইয়ে হ্যাঁ, অবশ্যই রাজনীতির লোকেরাও বটেই তো… ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই বলাটুকু না বললে?
থাক সে' কথা। আপনি বুঝি শুনেছিলেন, কাক কাকের মাংস খায় না? খায়। লেজে চাপ পড়লে সাপ সাপকে ছোবলও মারে।
এককালে চিকিৎসাবিজ্ঞানী হবার স্বপ্ন দিয়ে শুরু করে পরে যে চিকিৎসাবৃত্তিধারীও হল না, হয়ে গেল চিকিৎসাব্যবসায়ী, সেই মানুষটি হলাম আমি।
আপাতত এই লেখাটির দায় স্বীকার করে কাচের ঘরে বসে ঢিল ছুঁড়েছি, এই অপরাধে ছোবল খাওয়ার জন্য বসে থাকলাম। সঙ্গে থাকল সাহেনুরের মাঝে যে প্রত্যয় দেখলাম, সেই অভিজ্ঞতা। কোনওদিন এই ছেলে পালটে যাবে কি না, সে'টা সময় বলবে। কিন্তু তা'তে আজকের দেখাটা মিথ্যে হয়ে যাবে না।
ওর সাথে আমার মতের অমিল প্রচুর। বিশ্বাস ভাবনায় এক সমুদ্র ফারাক। তবু ও অন্তত একটি ক্ষেত্রে তাই হতে পেরেছে, আমি যা হতে পারিনি।
হতে হয় তো চাইওনি।

____________________________

ডা. অরুণাচল দত্ত চৌধুরী , কবি , সুলেখক।

আপনার মতামত দিন:


ক্যাম্পাস এর জনপ্রিয়