Ameen Qudir

Published:
2018-02-01 20:07:37 BdST

হাসপাতালের জীবন : তের গেছে; এসেছে তেত্রিশ: সে বাঁচতে চায়


 

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের একটি ওয়ার্ডের ছবি । রোগীর সেবায় সদা অতন্দ্র ।

 


ডা.গুলজার হোসেন উজ্জ্বল

_____________________________


ভ্রমণ আনন্দের রেশ কাটেনি এখনো। দেশে এসেই শুরু হয়েছে রোজকার ভ্রমণ। হাসপাতালের ডিউটি। আজ নাইট ডিউটি করতে এলাম। রাতের হাসপাতাল রাতের রেলস্টেশন বা বিমান বন্দরের মত। এক ধরণের নেশা আছে এখানে। কিছু মানুষ ঘুমায়। কিছু মানুষ জেগে থাকে। কেউ কেউ অহেতুক ব্যস্ত। উপর নিচ করে ক্রমাগত। রোজকার ভ্রমণ শেষে রাহা খরচের হিসাব মেলায়।

হাসপাতালে জীবন তার বিচিত্র রঙগুলি মেলে ধরে। বর্ষা কালে পেখমধরা ময়ুরের মত।

রোগ শোক আছে, এর ভেতরেও আছে জীবনের রসকান্ডের কৌতুহল উদ্দীপক রহস্যময় শেকড়বাকড়।

ওয়ার্ডে ব্লাড ক্যান্সারের জন্য কেমো নিচ্ছে এমন এক তরুনী রোগী ফোনে কথা বলছে।
ফোনের ও প্রান্তে যিনি আছেন তাঁর কথা শোনা যাচ্ছেনা। তবে আন্দাজ করা যাচ্ছে সেটা বলাই বাহুল্য।

- আপনে কে?
ও প্রান্তে কেউ কথা বলছে কিন্তু শোনা যায়না।
-পরিচয় দ্যান।
-
-পরিচয় নাই তে কথা বলেন ক্যান?
-
- পরিচয় না দিলে ফোন কাইটা দিমু। আমি অপরিচিতের সাথে কথা কইনা।
-
-কাটমু, আমার যখন ইচ্ছা হইব কাইটা দিমু।
-
- আপনে কালকে রাত্রেও ফোন দিছেন।
-
- হুম, ডিস্টার্ব তো হয়ই। অচেনা মানুষ ফোন দিলে আমার ডিস্টার্ব মনে হয়।
-

মেয়েটা ফোন কাটেনা, কথা চলে। আমি দূরে সরে যাই। আমি চাই এই কথোপকথন চলুক। দূর থেকে মেয়েটির মুখের অভিব্যক্তি দেখি। মেয়েটির মুখ হাসি হাসি। বিরক্তির লেশমাত্র নাই।

হাসপাতালে জীবানুর মত এরকম অসংখ্য গল্প ঘুরে বেড়ায় আমাদের অলক্ষে। গল্পগুলি অদৃশ্য কিন্তু প্রবলভাবে ক্রিয়াশীল। অসংখ্য আনন্দ, বেদনা, পরাজয়ের গল্প থাকে। আজ সকালে এক রোগী চলে গেছে ছুটি নিয়ে। খরচ করবার মত টাকা বেই। তের বছরের ছেলেটা বুঝতে পারছে সবই। বুঝতে পারছে তার কঠিন অসুখ হয়েছে। বাবা মা এই চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে পারবেনা তাও সে বুঝে গেছে। ছেলেটির মা খুব অনুরোধ করছে ওকে যেন আমরা ছুটি দিয়ে দেই। কোন পরীক্ষা নিরীক্ষা যেন আরর না করি। নেহায়েত হত দরিদ্র মানুষ। ছুটি দেব সিদ্ধান্ত ফাইনাল, তবু ভাবলাম কিছু একটা দেই। যাবার আগে দুটো ইঞ্জেকশন- অন্তত বিনা চিকিৎসার চেয়ে এটা ভাল। নিজের জন্য সান্ত্বনা।

ছেলেটির মা আমার এই তৎপরতায় ভীত হয়। আবার কোন চক্করে পড়বে কে জানে। ওষুধের ফর্দ নিয়ে ভয়। সূদের উপরে টাকা এনেছিল। সেই টাকা শেষের দিকে। হাতজোড় করে বলল " বাবা আংগোরে ছুটি দিয়া দেন, মুখে খাওয়ার ওষুধ লিখি দেন। বাড়িত নিয়া খাবামু"।
ছুটি লিখার জন্য ফাইল নিলাম। কৃতজ্ঞতায় বিগলিত হয়ে হাতে টাকা গুজে দিল।

 

এখানে ভর্তির জন্য মানুষ হাত জোড় করে। এই মহিলা ভর্তি ক্যান্সেল করার জন্য হাতজোড় করছে। ছেলেটা অনেক দূরে কোথাও দৃষ্টি রেখে ভেজা চোখে অপলক তাকিয়ে আছে। ওর বয়স তের বলে মনে হয়না তখন। মনে হয় অনেক বয়স ওর। রোগটাকেও মনে হয় আমার জ্ঞাত সীমানার চেয়েও বেশি জটিল। দারিদ্রের চেয়ে বড় অসুখ আর কি আছে?

বিছানাটি খালি নেই, খালি থাকেনা আসলে। তের বছরের জায়গায় একটি তেত্রিশ বছর এসেছে। একজন পরিণত যুবক। সে বাঁচতে চায়। তাঁর প্রস্তুতি আছে।
..............................

ভ্রমণ আনন্দের রেশ কাটেনি এখনো। দেশে এসেই শুরু হয়েছে রোজকার ভ্রমণ। হাসপাতালের ডিউটি। আজ নাইট ডিউটি করতে এলাম। রাতের হাসপাতাল রাতের রেলস্টেশন বা বিমান বন্দরের মত। এক ধরণের নেশা আছে এখানে। কিছু মানুষ ঘুমায়। কিছু মানুষ জেগে থাকে। কেউ কেউ অহেতুক ব্যস্ত। উপর নিচ করে ক্রমাগত। রোজকার ভ্রমণ শেষে রাহা খরচের হিসাব মেলায়।

হাসপাতালে জীবন তার বিচিত্র রঙগুলি মেলে ধরে। বর্ষা কালে পেখমধরা ময়ুরের মত।

রোগ শোক আছে, এর ভেতরেও আছে জীবনের রসকান্ডের কৌতুহল উদ্দীপক রহস্যময় শেকড়বাকড়।

ওয়ার্ডে ব্লাড ক্যান্সারের জন্য কেমো নিচ্ছে এমন এক তরুনী রোগী ফোনে কথা বলছে।
ফোনের ও প্রান্তে যিনি আছেন তাঁর কথা শোনা যাচ্ছেনা। তবে আন্দাজ করা যাচ্ছে সেটা বলাই বাহুল্য।

- আপনে কে?
ও প্রান্তে কেউ কথা বলছে কিন্তু শোনা যায়না।
-পরিচয় দ্যান।
-
-পরিচয় নাই তে কথা বলেন ক্যান?
-
- পরিচয় না দিলে ফোন কাইটা দিমু। আমি অপরিচিতের সাথে কথা কইনা।
-
-কাটমু, আমার যখন ইচ্ছা হইব কাইটা দিমু।
-
- আপনে কালকে রাত্রেও ফোন দিছেন।
-
- হুম, ডিস্টার্ব তো হয়ই। অচেনা মানুষ ফোন দিলে আমার ডিস্টার্ব মনে হয়।
-

মেয়েটা ফোন কাটেনা, কথা চলে। আমি দূরে সরে যাই। আমি চাই এই কথোপকথন চলুক। দূর থেকে মেয়েটির মুখের অভিব্যক্তি দেখি। মেয়েটির মুখ হাসি হাসি। বিরক্তির লেশমাত্র নাই।

হাসপাতালে জীবানুর মত এরকম অসংখ্য গল্প ঘুরে বেড়ায় আমাদের অলক্ষে। গল্পগুলি অদৃশ্য কিন্তু প্রবলভাবে ক্রিয়াশীল। অসংখ্য আনন্দ, বেদনা, পরাজয়ের গল্প থাকে। আজ সকালে এক রোগী চলে গেছে ছুটি নিয়ে। খরচ করবার মত টাকা বেই। তের বছরের ছেলেটা বুঝতে পারছে সবই। বুঝতে পারছে তার কঠিন অসুখ হয়েছে। বাবা মা এই চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে পারবেনা তাও সে বুঝে গেছে। ছেলেটির মা খুব অনুরোধ করছে ওকে যেন আমরা ছুটি দিয়ে দেই। কোন পরীক্ষা নিরীক্ষা যেন আরর না করি। নেহায়েত হত দরিদ্র মানুষ। ছুটি দেব সিদ্ধান্ত ফাইনাল, তবু ভাবলাম কিছু একটা দেই। যাবার আগে দুটো ইঞ্জেকশন- অন্তত বিনা চিকিৎসার চেয়ে এটা ভাল। নিজের জন্য সান্ত্বনা।

ছেলেটির মা আমার এই তৎপরতায় ভীত হয়। আবার কোন চক্করে পড়বে কে জানে। ওষুধের ফর্দ নিয়ে ভয়। সূদের উপরে টাকা এনেছিল। সেই টাকা শেষের দিকে। হাতজোড় করে বলল " বাবা আংগোরে ছুটি দিয়া দেন, মুখে খাওয়ার ওষুধ লিখি দেন। বাড়িত নিয়া খাবামু"।
ছুটি লিখার জন্য ফাইল নিলাম। কৃতজ্ঞতায় বিগলিত হয়ে হাতে টাকা গুজে দিল।

এখানে ভর্তির জন্য মানুষ হাত জোড় করে। এই মহিলা ভর্তি ক্যান্সেল করার জন্য হাতজোড় করছে। ছেলেটা অনেক দূরে কোথাও দৃষ্টি রেখে ভেজা চোখে অপলক তাকিয়ে আছে। ওর বয়স তের বলে মনে হয়না তখন। মনে হয় অনেক বয়স ওর। রোগটাকেও মনে হয় আমার জ্ঞাত সীমানার চেয়েও বেশি জটিল। দারিদ্রের চেয়ে বড় অসুখ আর কি আছে?

বিছানাটি খালি নেই, খালি থাকেনা আসলে। তের বছরের জায়গায় একটি তেত্রিশ বছর এসেছে। একজন পরিণত যুবক। সে বাঁচতে চায়। তাঁর প্রস্তুতি আছে।

_____________________________

 

 

Image may contain: 1 person, outdoor

 

 

ডা.গুলজার হোসেন উজ্জ্বল । সুরশিল্পী । কথাশিল্পী।

আপনার মতামত দিন:


বিএসএমএমইউ এর জনপ্রিয়