Ameen Qudir

Published:
2017-03-16 18:27:05 BdST

ডাক্তার: যাকে ইচ্ছা করলেই মারা যায়, লাথি দেওয়া যায়, লাঠি দিয়ে পিটানো যায়


 

 

 


ডা. তারিক রেজা আলী
____________________________

 

 

 

 

কি দেখতে পাচ্ছেন এই ছবিতে? একজন মাঝবয়সী মানুষ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তার চোখ সুদূরে প্রসারিত। সে চোখে রাগ নেই, ক্ষোভ নেই, ভালবাসাও নেই, আছে শুধু সীমাহীন শূন্যতা।


একেবারে সঠিক হলো না বর্ণনা। উনি আসলে মানুষ নন, উনি একজন ডাক্তার, বাংলায় আরেকটা গালভরা প্রতিশব্দ আছে, চিকিৎসক।

আমার কানে ইদানীং এই প্রতিশব্দটা শোনায় একটা গালির মতো, মনে হয় বরাহ শাবক, আরো সুন্দর ভাবে বললে একটা চারপেয়ে পশু।


এমনই পশু যাকে ইচ্ছা করলেই মারা যায়, লাথি দেওয়া যায়, লাঠি দিয়ে পিটানো যায়, ছুরি দিয়ে কিংবা কাঁচ দিয়ে হাত কেটে দেওয়া যায়, চাই কি হত্যাও করা যায়। কোন বিচার হয় না। তার প্রজাতির অন্য পশুরা কোন প্রতিবাদ করে না। তারা নিজেদের দৈনন্দিন মানব সেবার ব্রত নিয়ে ব্যস্ত থাকে, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে বড় বড় প্রবন্ধ উপস্থাপন করে, ছাত্র পড়ায় কিংবা কিভাবে আরো কম খরচে স্বাস্থ্যসেবা জনগনের দোরগোড়ায় পৌঁছানো যায় তা নিয়ে দিনব্যাপী ওয়ার্কশপ করে।

এই যে পশুটাকে দেখছেন, ওর নাম মুনীর। ওর বাম চোখ লাল হয়ে আছে, বাম চোয়াল ফুলে আছে, ব্যথা আর প্রদাহ কমানোর জন্য সে ঠান্ডা জলের বোতল গালে চেপে ধরে আছে।

এই মুনীর ছিল ছাত্র জীবনে আমার সহযোদ্ধা। মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার পাশাপাশি আমরা সবাই চিন্তা করতাম কিভাবে এ দেশ থেকে রক্তের অভাব দূর করা যায়। কিভাবে গরীব অসহায় মানুষকে ঔষধ সরবরাহ করা যায়। কিভাবে কর্ণিয়ার অভাব জনিত অন্ধত্ব দূর করা যায়। বাংলাদেশে এখন যে মানুষ স্বেচ্ছায় রক্ত দান করতে ভয় পান না, নিজের আত্মীয়-বন্ধুর প্রয়োজনে নিজে রক্ত দেন, তা কি এক দিনে হয়েছে?

আমি নিজে নিউমার্কেট ওভার ব্রীজের নীচে সন্ধানী কর্মী হিসাবে আগে রক্ত দিয়েছি, আরো অনেক কর্মীকে রক্ত দিতে দেখেছি। এর পর আমরা মাইকে ঘোষণা করতাম, দেখুন, আমরা রক্ত দিয়েছি, আমাদের কোন ক্ষতি হয় নি, এবার আপনারাও রক্ত দানে এগিয়ে আসুন।

এরকম আরো কত কাজ করেছে মুনীর। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত আমরা তর্ক করতাম, সংবিধানের একটা শব্দ পরিবর্তন বা সংযোজনের জন্য কত ভাবে যুক্তি, পাল্টা যুক্তি দিতাম।


সব জায়গাতেই মুনীর ছিল শান্ত, ধীর-স্থির। যুক্তি ছাড়া কোন কথা আমি মুনীর কে বলতে শুনি নি কখনো। কোনদিন কারো সাথে হাসি মুখ ছাড়া অথবা উচ্চস্বরে কথা বলতে দেখিনি, শুনিনি।কতবার যে সে এই দেশের মানুষের জন্য নিজের রক্ত দান করেছে। ছাত্রজীবন শেষে সে আজকের পর্যায়ে অর্থাৎ নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে কত পরিশ্রম করেছে, কত রাত নির্ঘুম থেকেছে, সে কথা আর বলতে ইচ্ছা করছে না।

এখন সেই মুনীর কে তার সন্তান অথবা ভাতিজা অথবা ছোট ভাই এর বয়সী কতগুলো অসভ্য, অশিক্ষিত, বর্বর তারই কর্মক্ষেত্রে তারই অফিসকক্ষে ঢুকে প্রহার করেছে। আমরা প্রতিবাদ হিসেবে এক ঘন্টা কর্মবিরতি পালন করেছি আর মানব বন্ধন করেছি। ধিক্ আমাদের। আজ মুনীর কে মেরেছে, কাল আমাকে মারবে, নিশ্চিত থাকুন হে প্রিয় সংগ্রামী চিকিৎসক নেতা, পরশু কিন্তু আপনাকেও মারবে। তখনো কিন্তু আমরা জ্ঞান চর্চা করব, আর করব নিজেদের মধ্যে মারামারি, কাদা ছোড়াছুড়ি।

______________________________


লেখক ডা. তারিক রেজা আলী Assistant Professor, Retina. at Bangabandhu Sheikh Mujib Medical University

আপনার মতামত দিন:


বিএসএমএমইউ এর জনপ্রিয়