SAHA ANTAR

Published:
2022-04-03 22:31:30 BdST

অটোফেজি সরস উপবাস : বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞান সম্মত ফাস্টিং


ইয়োশিনোরি ওহশোমি

 

ডেস্ক 

অটোফেজি সরস উপবাস। সহজভাবে বললে সজল উপবাস। মুসলমান সম্প্রদায়ের পবিত্র রমজান মাসে অটোফেজি বেশ লেখালেখি করা হয়। তাই
মো. আরিফুর রহমান, শিজুওকা (জাপান) এর লেখা অনন্য একটি লেখা প্রকাশ করা হল।

 

চিকিৎসা বিজ্ঞানে ২০১৬ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন জাপানের অটোফেজি গবেষক ইয়োশিনোরি ওহশোমি। জীবদেহ কেমন করে ত্রুটিপূর্ণ কোষ ধ্বংস করে নিজের সুরক্ষা করে এবং কোষ কীভাবে নিজের আবর্জনা প্রক্রিয়াজাত করে সুস্থ থাকে, সেই রহস্য বের করার কারণে নোবেল পুরস্কার পেলেন এ বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানের ভাষায় এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় অটোফেজি। আর যে জিনটি এই অটোফেজি প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে সেটি শনাক্ত করেছিলেন টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির এ অধ্যাপক।
১৯৬০ সালে বিজ্ঞানীরা প্রথম দেখতে পান, কোষ কীভাবে নিজের ভেতরে একটি বস্তার মতো ঝিল্লি তৈরি করে নিজের আবর্জনা বা ক্ষতিগ্রস্ত উপাদানকে তার ভেতরে আটকে ফেলে। বেলজিয়ামের বিজ্ঞানী ক্রিস্টিয়ান ডে ১৯৭৪ সালে এ লাইসোজম আবিষ্কারের কারণে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তবে সেখানে ঠিক কী ঘটে সেটা তখন বিজ্ঞানীদের জানা ছিল না। বিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওহশোমি পৃথিবীতে সর্ব প্রথম অটোফেজি নিয়ে কাজ শুরু করেন। তিনি লক্ষ্য করেন লাইসোজম শুধু দেহের আবর্জনা বা ক্ষতিগ্রস্ত উপাদান জমা করে রাখে না। এটা রিসাইক্লিং চেম্বার বা নবায়নযোগ্য শক্তিব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে নতুন উপাদান/কোষ তৈরি করে। ইউশিনোরি দেখিয়েছেন, কোষেরা নিজেরাই নিজেদের বর্জিতাংশ বা আবর্জনাকে আটকায়। এরপর সেখান থেকে উপকারী উপাদানগুলোকে ছেঁকে আলাদা করে ফেলে। তারপর ওই দরকারি উপাদানগুলো দিয়ে উৎপাদন করে শক্তি কিংবা গড়ে তোলে নতুন নতুন অনেক কোষ। এ মহৎ কাজ তাঁকে ২০১৬ সালে নোবেল পুরস্কার এনে দিয়েছে।
অটোফেজি প্রক্রিয়াটি আসলে কি? অটোফেজি শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ অটো ও ফাজেইন থেকে। বাংলায় এর অর্থ হচ্ছে—আত্ম ভক্ষণ বা নিজেকে খেয়ে ফেলা। বিষয়টি শুনতে ভয়ানক হলেও এটা শরীরের জন্য খুবই উপকারী। কেননা এটা শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গসমূহকে পরিষ্কার করার একটা প্রক্রিয়া, যা সম্পন্ন হয় কোষীয় পর্যায়ে। শরীরের বিভিন্ন কাজ করার জন্য প্রতিনিয়ত প্রোটিন তৈরি হয় এবং প্রোটিনের কাজটি সঠিকভাবে সম্পন্ন করার জন্য প্রোটিনের গঠনটি অ্যামিনো অ্যাসিড দ্বারা ত্রিমাত্রিক হতে হয়। যদি ত্রিমাত্রিক না হয় তবে প্রোটিনটি শরীরের জন্য ক্ষতিকারক হতে ও নানা রোগের সৃষ্টি করবে।


অটোফেজির প্রক্রিয়া
এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৩০% প্রোটিন সঠিকভাবে সংশ্লেষ হতে পারে না ফলে এদের ধ্বংস করা, শরীর থেকে বের করে দেওয়া কিংবা অন্য উপায়ে কাজে লাগানো জরুরি। কেননা শরীরে এরা থাকলে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হবে। প্রশ্ন হলো, কীভাবে ক্ষতিকারক প্রোটিনকে কাজে লাগানো যায়? আমাদের দেহ অটোফেজির মাধ্যমে এদের কাজে লাগায়। অটোফেজি প্রক্রিয়াটি আমাদের শরীরকে কার্যকরী করে রাখে, দুর্বল অঙ্গাণু থেকে মুক্তি দেয় এবং ক্যানসার কোষ ধ্বংস করে। শরীরে এ প্রক্রিয়া অনুপস্থিত থাকলে ক্যানসার কিংবা নানাবিধ স্নায়বিক রোগ হতে পারে। নোবেল কমিটির মতে, ইয়োশিনোরির গবেষণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ক্যানসার থেকে শুরু করে নানাবিধ স্নায়বিক রোগগুলোর (যেমন ডেমনেশিয়া, পারকিনসন্স) ক্ষেত্রে শরীরে কী ধরনের পরিবর্তন হয় তা বুঝতে তার গবেষণাটি সহায়তা করে। এককথায় বলা যায়, অটোফেজি রোগ প্রতিরোধ করে এবং আমাদের যৌবন ধরে রাখতে সহায়তা করে।
প্রথম জীবনে তিনি রসায়নে গবেষণা শুরু করেছিলেন। রসায়ন তাঁর কাছে আকর্ষণীয় না হওয়ায় তিনি কোষীয় জীববিদ্যায় কাজ শুরু করেন। কিন্তু ভালো ফলাফল না পাওয়ায় এক সময় তাঁকে খুব কঠিন সময় পার করতে হয়েছিল। নতুন একটি ক্ষেত্রে কাজ করা তাঁর জন্য সহজ ছিল না। কিন্তু তিনি ঝুঁকি নিয়েছিলেন। সে জন্য, আজ থেকে ২৭ বছর আগে ইস্ট নিয়ে গবেষণার সময় ইউশিনোরি ওসুমি এই অটোফেজি ব্যবস্থা আবিষ্কার করে ফেলেন। তাঁর মতে, গবেষণায় ভালো ফলাফল আসবে তা কেউ গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারেন না, তবুও গবেষকেরা কাজ করে যান। কারণ তারা গবেষণায় আনন্দ পান ও এই জিনিসটাই গবেষণার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। ২০১২ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি গবেষণায় ঝুঁকি নেওয়া ও ব্যর্থতার গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছিলেন। বিজ্ঞান সফলতা চায়, ব্যর্থতা গ্রহণ করে না, তিনি সে সাক্ষাৎকারে তরুণ গবেষকদের ব্যর্থতায় হতাশ না হয়ে পরবর্তী সুযোগ গ্রহণের উপায় দেখিয়েছিলেন।
জাপানি অধ্যাপক ইয়োশিনোরি, অটোফেজি প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণকারী জিন শনাক্ত করার পাশাপাশি এসব জিনে কোনো সমস্যা হলে কীভাবে রোগ সৃষ্টি হয় তাও দেখান। তাঁর গবেষণার মধ্য দিয়ে স্নায়ুজনিত ওই সব রোগে শরীরে কী ধরনের পরিবর্তন হয়, তা বোঝা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে বার্ধক্যজনিত নানাবিধ রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে এটি যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে। অধ্যাপক ইয়োশিনোরি বলেছেন, অটোফেজি নিয়ে যখন তিনি কাজ শুরু করেছিলেন, তার চেয়ে এখন অনেক বেশি প্রশ্নের উত্তর জানা বাকি। এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা ভবিষ্যতে জানতে পারব। কেননা এখন আর তিনি একা নন। এ পৃথিবীতে হাজার হাজার গবেষক অটোফেজি নিয়ে কাজ করছেন। অটোফেজি প্রক্রিয়ার এ চলমান গবেষণা ভবিষ্যতে আমাদের স্বাস্থ্যসেবায় যে অনেক সুফল নিয়ে আসবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

*লেখক অটোফেজি গবেষক, শিজুওকা ইউনিভার্সিটি, জাপান।

এখানে মুক্ত প্রাণের সৌজন্যে তাদের লেখা একটি অসাধারণ রচনা পাঠকের জন্য দেওয়া হল।  

শরীরকে সুস্থ্য ও কর্মক্ষম রাখতে অটোফেজি একটি কার্যকারী পদ্ধতি। এর জন্য প্রয়োজন ১৩ থেকে ৪৮ ঘন্টার উপবাস বা ফাস্টিং। যা, আমাদের শরীরের আক্রান্ত কোষগুলিকে নির্মুল করে শরীর কে সুস্থ্য রাখতে সাহায্য করতে পারে। প্রাচীন কাল থেকে এখন পর্যন্ত ফাস্টিংয়ের যে পদ্ধতিগুলো প্রচলিত রয়েছে সেগুলো নিয়ে নিচে সংক্ষিপ্ত আকারে আলোচনা করা হয়েছে।

থেরাপিউটিক ফাস্টিং (Therapeutic fasting)

থেরাপিউটিক ফাস্টিংয়ের ব্যাপক প্রয়োগ হয়ে থাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানেরই একটি শাখা ন্যাচারোপ্যাথি মেডিসিন এ। এখানে চিকিৎসার অংশ হিসেবে থেরাপিউটিক ফাস্টিং বা ফাস্টিং থেরাপি চালু রয়েছে । ফাস্টিং থেরাপিকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে শরীর থেকে দূষিত বর্জ্য বের করে দেওয়া এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলার জন্য।

জুস ফাস্টিং

শুধুমাত্র ফল ও শাকসবজির তরল নির্যাস বা রস পান করে ফাস্টিং করাকে জুস ফাস্টিং বলা হয়ে থাকে। এই ধরনের ফাস্টিং চলতে পারে অবস্থা বুঝে ৩ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত। এক্ষেত্রে শারীরিক সমস্যার ধরন অনুযায়ী ফল, সবজী, ভেষজ বা খাদ্যদ্রব্য নির্বাচন করতে হবে। কারন শরীরের বিভিন্ন সমস্যা বা প্রয়োজনের জন্য বিভিন্ন খাবার ভিন্ন ভিন্ন কাজে লাগে।

এবার নির্ধারিত ফল, সবজি অথবা খাদ্যদ্রব্য থেকে নিঃসৃত টাকটা ও সতেজ নির্যাস সংগ্রহ করে নিচের তালিকার নিয়ম অনুযায়ী পান করতে থকাুন। তবে মনে রাখবেন এই ফাস্টিংয়ে কোন রকম ভাবেই প্যাকেটজাত বা প্রিজারভেটিভ সমৃদ্ধ খাবারের নির্যাস ব্যবহার করা যাবেনা। আর শুরু করার আগে অবশ্যই কোন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেবেন।

জুস ফাস্টিংয়ের একটি নমুনা তালিকাঃ

মিল (Meal­­) সময় (Time) জুস (Juice)
ব্রেকফাস্ট সকাল ৮-৯ টা প্রয়োজন অনুযায়ী
স্ন্যাক টাইম I সকাল ১০-১১ টা প্রয়োজন অনুযায়ী
লাঞ্চ বেলা ১২-১ টা প্রয়োজন অনুযায়ী
স্ন্যাক টাইম II দুপুর ২:৩০-৩:৩০ টা প্রয়োজন অনুযায়ী
স্ন্যাক টাইম III বিকাল ৪:৩০-৫:৩০ টা প্রয়োজন অনুযায়ী
ডিনার সন্ধ্যা ৬:৩০টা-৭:৩০টা প্রয়োজন অনুযায়ী
স্ন্যাক টাইম IV রাত ৮-৯ টা প্রয়োজন অনুযায়ী

 

ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং (Intermittent fasting)

বর্তমান সময়ে সবথেকে জনপ্রিয় ও আলাচিত হচ্ছে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং বা সবিরাম উপবাস। এই পদ্ধতিতে প্রথমে দিনের ষোল ঘন্টা খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হয়। এর পরে আট ঘন্টা অন্তর খাবার গ্রহণ করার প্রয়োজন হয়।

তবে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর ক্ষেত্রে এর সঠিক প্রয়োগ খুবই গুরুত্বপূর্ন। কেননা, সঠিক নিয়ম অনুযায়ী ফাস্টিং এর সাথে অনুশীলন না করলে উপকারের চেয়ে অপকারের ঝুঁকি অনেক বেশি থেকে যায়।

ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং পদ্ধতির ইতিহাস প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরনো। প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অনুসারে আমাদের শরীর ৩টি উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত, যথাঃ

  • বায়ু
  • পিত্ত ও
  • কফ

তাই ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং পদ্ধতি শুরু করার আগে ব্যক্তির শরীরে এই ধাতুগুলোর ভারসাম্য নিশ্চিত হওয়াটা জরুরী। কারনঃ

  • শরীরে কফের আধিক্য থাকলে আপনি ষোল ঘন্টা বা তার বেশি সময় ফাস্টিং করবেন। কারন হিসাবে বলা হয় কফের আধিক্যের কারনে খাবার ধীরে হজম হয়।
  • আবার যার শরীরে বায়ুর আধক্য তাদের ক্ষেত্রে ১৪ ঘন্টা বা তার কম সময় ফাস্টিং উচিত। কারণ হিসাবে বলা হয় শরীরে বায়ুর প্রভাব বেশি হলে অধিক সময় পেট খালি থেকে গ্যাস তৈরি হয়ে কষ্ট পেতে পারন।
  • আর শরীরে পিত্ত যাদের বেশি তদের হজম খুব দ্রুত হওয়ায় ষোল ঘন্টার ফাস্টিং যর্থাথ। তবে যাই করুন ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর ক্ষেত্র অবশ্যই বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করে তারপর ফাস্টিং শুরু করুন।

আপনার মতামত দিন:


প্রেসক্রিপশন এর জনপ্রিয়