Ameen Qudir

Published:
2020-03-10 18:42:30 BdST

CoVID-19 : এক অজানা আতঙ্ক! এড়াতে ৯ পরামর্শ



ডা.হিমেল ঘোষ
___________________

২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাস এর মাঝামাঝি সময়।চীনের উহান প্রদেশের একটি
হোলসেল এনিম্যাল,স্নেক ও ফিশ মার্কেটের বেশ কিছু দোকানি হঠাৎ করে
নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন।প্রথমে স্বাভাবিক নিউমোনিয়ার মত মনে করা হয়।কিন্তু
আস্তে আস্তে এটি চীনের মধ্যাঞ্চলীয় এই প্রদেশ ছাড়াও চীনের অন্যান্য
অঞ্চল,পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ যেমন-
হংকং,ম্যাকাউ,ভিয়েতনাম,,সিংগাপুর,তাইওয়ান,থাইল্যান্ড, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ
১০০ টির বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রেও এরোগে আক্রান্ত শত শত
রোগী শনাক্ত করা হয়েছে।প্রথমদিকে দেখা গিয়েছিল যে এসকল দেশের আক্রান্ত
নাগরিকগণ মোটামুটি সবাই চীনের উহান প্রদেশে ভ্রমণ করেছিলেন।কিন্তু পরবর্তীতে
অন্যান্য অনেকেই আক্রান্ত হন যারা উপদ্রুত অঞ্চলগুলি ভ্রমণ করেননি কিন্তু
কোন না কোনভাবে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসেছিলেন।বর্তমানে
এন্টার্কটিকা বাদে সকল মহাদেশেই এই রোগের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে।সবচেয়ে বেশি
সংখ্যায় আক্রান্ত হয়েছে চীন,এরপর বেশি আক্রান্ত দেশগুলি পর্যায়ক্রমে দক্ষিণ
কোরিয়া,ইরান,ইটালি,জার্মানি, ফ্রান্স,স্পেন,জাপান,আমেরিকা,সুইজারল্যান্ড ও
ইংল্যান্ড।উহান প্রদেশে নিউমোনিয়ার মত রোগটি ছড়াতে দেখে গত বছর ৩১ ডিসেম্বর
চীন কর্তৃপক্ষ বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থাকে অবহিত করেন।এরপর গত ১১ জানুয়ারি প্রথম
এ রোগে একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।উৎপত্তিস্থল চীনে এপর্যন্ত ৮০০০০
জন এর উপরে এই রোগে আক্রান্ত বলে চিহ্নিত করা হয়েছে যার মধ্যে ৩০০০জনের
বেশি মানুষ মৃত্যু বরণ করেছেন।চীন সহ আক্রান্ত অন্যান্য দেশ এবং পার্শ্ববর্তী
দেশের সাথে বাংলাদেশের ভাল যোগাযোগ থাকায় এবং বাংলাদেশসহ সার্কভুক্ত
অন্যান্য সব দেশেই এই রোগের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়ায় বাংলাদেশও রোগবিস্তারের
উচ্চ ঝুঁকির মাঝে অবস্থান করছে।গত ৮ মার্চ,২০২০ এ বাংলাদেশে প্রথম ৩ জন এই
রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি পাওয়া গিয়েছে - এর মধ্যে ২ জন ব্যক্তি সম্প্রতি ইটালি
থেকে ভ্রমণ করে ফিরেছিলেন।সারা বিশ্বে এ পর্যন্ত ১১০০০০ জন এর বেশি মানুষ
আক্রান্ত হয়েছেন যার মধ্যে ৩৮০০ জন এরও বেশি লোক মারা গিয়েছেন।অর্থাৎ
mortality rate প্রায় ৩.২%। এই রোগে মৃত ব্যক্তিদের বেশিরভাগই ৫০ বছরের বেশি
বয়স্ক এবং মৃত অধিকাংশ ব্যক্তিই বিভিন্ন ক্রোনিক রোগ যেমন
ডায়বেটিস,কিডনিজনিত জটিলতা,উচ্চরক্তচাপ প্রভৃতিতেও ভুগছিলেন।
শুরুতে বোঝা না গেলেও পরে এইধরনের নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ও মৃত ব্যক্তিদের
শরীরে একটি নতুন ভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে।নতুন এই ভাইরাসটি একটি করোনা
ভাইরাস-সার্স ভাইরাস এর সাথে যার প্রায় ৭০% মিল রয়েছে।ইলেক্ট্রন
মাইক্রোস্কোপের নিচে এই ভাইরাসকে দেখতে মুকুট(crown) বা সূর্যরশ্মির(solar

corona) মত মনে হয় বলে এর নাম করোনা ভাইরাস। নতুন এই করোনা ভাইরাসের নাম
দেওয়া হয়েছে নোবেল করোনা ভাইরাস বা উহান করোনা ভাইরাস বা 2019-nCoV করোনা
ভাইরাস।নতুন এই ভাইরাসটি অনেকটা সার্স ভাইরাসের মতই।সার্স ভাইরাসের
সংক্রমণে ২০০২-২০০৩ সালে চীন ও হংকং এ ৭৭৪ জন এরও বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ
করেছিলেন।ইতোমধ্যে SARS CoV এবং MARS CoV এর মত নোবেল করোনা ভাইরাসও
প্যানডেমিক রূপ লাভ করেছে।নতুন এই নোবেল করোনা ভাইরাস জুনোটিক।অর্থাৎ এই
ভাইরাস আগে পশুপাখিতে রোগ সৃষ্টি করত,এখন mutation ঘটিয়ে মানবদেহেও রোগের
প্রাদুর্ভাব করছে।পূর্বের মার্স বা সার্স করোনা ভাইরাস যথাক্রমে উট ও বাদুড় থেকে
বিস্তার লাভ করলেও এবারের নোবেল করোনা ভাইরাস সাপ থেকে ছড়িয়ে পড়েছে বলে
ধারণা করা হচ্ছে এবং বাদুড় থেকে এই ভাইরাস সাপের শরীরে এসেছে বলেও মনে করা
হচ্ছে।তবে করোনা ভাইরাসটি একইসময়ে উষ্ণ ও শীতল রক্তবিশিষ্ট প্রাণীদেহে
কিভাবে টিকে থাকল,সেটাই এখন রহস্য।ভাইরাসটি একেবারে নতুন বলে এর ভয়াবহতা
সম্পর্কে এখনো বিস্তারিত গবেষণা সম্ভব হয় নি। তাছাড়া ভাইরাসটি মানবদেহে
কতদিন প্রচ্ছন্ন অবস্থায় থাকতে পারে বা কত দ্রুত ছড়াতে পারে বা সুনির্দিষ্ট
চিকিৎসা কি তাও অজানা।তবে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে
এবং সুপ্তিকাল প্রায় ২ সপ্তাহ বলে ধারণা করা হচ্ছে।সম্প্রতি আরো ধারণা করা
হচ্ছে যে ভাইরাসটি আরো মিউটেশন ঘটিয়ে S ফর্ম থেকে L ফর্ম হয়ে আরো
ধ্বংসাত্মক ও বিস্তীর্ণ এলাকায় বিস্তরণকারী হিসাবে পরিবর্তিত হয়েছে - এই
মিউটেটেড রূপই বর্তমানে প্রায় ৭০% CoVID-19 রোগের জন্য দায়ী বলে মনে করা
হচ্ছে।
সাধারণ সর্দি কাশি (Commond cold) সবচেয়ে বেশি হয় Rhinovirus জীবানু দিয়ে,
এরপরই ২য় স্থানে আছে Coronavirus, অর্থাৎ এটি সাধারন সর্দি কাশি/common
cold এর ২য় প্রধান organism.এর মূল Family হচ্ছে, Coronaviridae!এই ভাইরাস
কিন্তু আসলে নতুন আবিস্কার নয়-অনেক পুরোনো গ্রুপের ভাইরাস।যেটা নতুন সেটা
হলো এর নতুন স্ট্রেইন, যেটা অন্যান্য অনেক ভাইরাসের ক্ষেত্রেও এইরকম নতুন
নতুন স্ট্রেইন হয়ে থাকে।
Coronavirus সৃষ্ট মারাত্মক রোগগুলো হলোঃ
1.SARS(Severe acute respiratory syndrome)
2.MERS(Middle east respiratory syndrome)
3.COVID-19(Corona virus disease 2019)
SARS রোগের জীবানু SARS-CoV Strain

MERS রোগের জীবানু MERS-CoV Strain
COVID-19 রোগের জীবানু SARS-CoV-2 Strain
বর্তমানে যে COVID-19 (Corona Virus Disease -2019) রোগটি ছড়িয়ে পড়ছে, এটি হচ্ছে
মূলত SARS-CoV-2 নামক স্ট্রেইন দিয়ে যেটি একটি Coronavirus.
অর্থাৎ এরা সবাই Coronavirus এর বিভিন্ন Strain, যারা হচ্ছে RNA Enveloped
Virus.যেহেতু এরা Enveloped তাই এরা খাবারের সাথে পাকস্থলীতে গিয়ে কোন
ইনফেকশন করতে পারে না।
লক্ষণ: মুখের সংস্পর্শ বা নাকের মাধ্যমে গলার সংস্পর্শে এসে এরা Respiratory
Tract(শ্বাসনালী ও শ্বাসযন্ত্রে) ইনফেকশন করে।এই ভাইরাস সংক্রমণের প্রাথমিক
লক্ষণ হল জ্বর(১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি) ও শুকনা কাশি।এক সপ্তাহের মধ্যে
দেখা যায় শ্বাসকষ্ট।পরবর্তীতে নিউমোনিয়া সহ দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ
বিকল হয়ে যাওয়া সহ মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। দেখা গিয়েছে যে ভাইরাসটি শরীরে
প্রবেশের পর থেকে রোগ লক্ষণ প্রকাশ করতে ৫-১৪ দিন সময় নেয়।এ পর্যন্ত
আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রায় ৩.২% মৃত্যুবরণ করেছেন।
চিকিৎসার ইতিহাসঃ এই COVID-19 এর SARS-CoV-2 জীবানু SARS-CoV এর
মতই।এগুলোর কোন স্পেশিফিক AntiViral Treatment এখন পর্যন্ত আবিস্কার
হয়নি।তবে SARS-CoV যখন 2002 সালে প্যানিক ছাড়িয়েছিলো, তখন যেসব রোগীরা Life
threatened ছিলো তাদের ক্ষেত্রে "Ribavirin Antiviral + Steroid" দিয়ে চিকিৎসার
চেস্টা চালানো হয়।কিন্তু কার্যকারীতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায় নি।
প্রতিকার: গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এটি ৫-১৪ দিন পর্যন্ত সুপ্তাবস্থায় থাকতে পারে,
অর্থাৎ, ১৪ দিনের আগে এরা থার্মাল স্ক্যানে কোন প্রকার লক্ষণ প্রকাশ না করেই
থার্মাল স্ক্যানকে খুব সহজে টেক্কা দিয়ে পার পেয়ে যেতে পারে।যেহেতু এই ভাইরাসটি
এখনো নতুন,এ পর্যন্ত কোন টিকা বা কার্যকরী চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়
নি।শুধু সাপোর্টিভ কিছু চিকিৎসার মাধ্যমে এই ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তিদের শুশ্রূষা
করা হচ্ছে।যেহেতু কোন প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসা নেই, এছাড়াও এটি নিজেই সেরে যায় যদি
বডির ইম্যুন সিস্টেম শক্তিশালী থাকে।সেজন্য সবার Treatment plan হওয়া উচিত,
বডির ইম্যুন সিস্টেমকে স্ট্রং করা।বডির Immunoregulation করে Zinc, Iron &
Vitamin A।তাই সর্দি কাশি জ্বর/ করোনা সন্দেহ হলে নিয়মিত পানি /স্যালাইন পান
করে হাইড্রেশন ঠিক রাখতে হবে এবং এর সাথে Zinc, Iron & Vitamin A
supplementaion ঔষধ নেয়া যেতে পারে।এতে করে আপনার ইম্যুন সিস্টেম ভালো
থাকবে।ফলে বডি নিজেই করোনা প্রতিরোধ করতে কাজ করতে পারবে।

তবে সচেতনতাই এই রোগপ্রতিরোধের উপায়।ভাল করে সাবান-পানি অথবা এলকোহল
বেস্ড হ্যান্ডরাব দিয়ে হাত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময়
মাস্ক পরিধান করে থাকতে হবে।হাত দিয়ে নাক-মুখ ঘষা থেকে বিরত থাকতে
হবে।সন্দেহজনক আক্রান্ত ব্যক্তির সরাসরি সংস্পর্শে আসা থেকে বিরত থাকতে
হবে। মাংস ও ডিম ভাল করে রান্না করে খেতে হবে।বন্য অথবা পোষা প্রাণীর
সংস্পর্শে সাবধানতা অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়।অন্যকে সংক্রমিত করার ঝুঁকি পার
হওয়া পর্যন্ত সংক্রমিত ব্যক্তিকে আলাদা করে রেখে চিকিৎসা দিতে
হবে।এয়ারপোর্ট স্ক্রিনিং করে উপদ্রুত এলাকা থেকে প্রত্যাগত যাত্রীদের চেক
করতে হবে।বর্তমানের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে
CoVID-19 থেকে এড়াতে চাইলে-
১. অপ্রয়োজনীয় কোন জনসমাবেশ এড়িয়ে চলবেন।অযথাই ভীড়ের সংস্পর্শে যাওয়ার
দরজার নেই।
২.গণপরিবহনে এ যেতে হলে বা বাইরে জনসমাগনের সংস্পর্শে যাওয়াই লাগলে
সার্জিকাল মাস্ক বা PM-2.5 মাস্ক ব্যবহার করুন।
৩.বিনা প্রয়োজনে বা কারণ ছাড়া বিদেশে যাবেন না। কোন ট্যুর পরিকল্পনা করে থাকলে
কিছুদিনের জন্য তা বাতিল করুন।
৪.বিশেষ অনিবার্য কারণে বিদেশ ভ্রমণের প্রয়োজন পড়লে অতিরিক্ত সতর্কতা
অবলম্বন করুন।
৫.বাইরে থেকে ঘরে ফেরার পর,হ্যান্ডশেকের পর,হাঁচি-কাশি দেওয়ার পর ভাল করে
সাবান দিয়ে অন্তত ৩০ সেকেন্ড ধরে হাত ধুয়ে ফেলবেন।
৬.যেখানে সেখানে কফ-থুথু ফেলার অভ্যাস ত্যাগ করুন।
৭.হাঁচি কাশি দেওয়ার সময় অবশ্যই রুমাল/ট্যিসুপেপার ব্যবহারকরুন
৮.কারো সামনে মুখের উপর যেয়ে হাঁচি-কাশি দেওয়া থেকে বিরত থাকুনআতঙ্কিত না
হয়ে সতর্কতা অবলম্বন করলে এই ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
৯.বয়স্ক ব্যক্তি কিংবা যাদের পূর্ব থেকেই
ডায়বেটিস,শ্বাসকষ্ট,উচ্চরক্তচাপ,কিডনি জটিলতা প্রভৃতি সমস্যা বিদ্যমান তাদের
প্রতি অতিরিক্ত যত্ন নিতে হবে ও বেশি করে খেয়াল রাখতে হবে।

ডা.হিমেল ঘোষ
এমবিবিএস(ঢাকা মেডিকেল কলেজ),
বিসিএস(স্বাস্থ্য),
মেডিকেল অফিসার,
উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র,ডুমুরিয়া,খুলনা।

আপনার মতামত দিন:


প্রেসক্রিপশন এর জনপ্রিয়