Ameen Qudir

Published:
2017-03-13 00:37:38 BdST

এক দুর্ভাগা দেশের এক দুর্ভাগ্যের গল্প বলি



ডা. জামান অ্যালেক্স
__________________________

 

আঁধারের কাব্যঃ

১.....

এক দুর্ভাগা দেশের এক দুর্ভাগ্যের গল্প বলি....

এক যে ছিলো ডাক্তার।এক সরকারী মেডিকেল কলেজ থেকে বিভিন্ন সাবজেক্টে অনার্স মার্ক নিয়ে প্লেস করে তিনি MBBS পর্ব চুকিয়েছিলেন।পরবর্তীতে স্বল্পতম সময়ে কার্ডিওলজীতে MD ও কমপ্লিট করলেন।জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের জার্নালে অলরেডী ডাক্তার সাহেবের ২১ টি পাবলিকেশনও আছে.....

ডাক্তার সাহেব তার এই একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড সঙ্গে করে এক ইউনিভার্সিটিতে Assistant Professor পদে আনন্দচিত্তে পরীক্ষা দিতে গেলেন।আনন্দ বেদনায় রূপান্তরিত হলো। পাঁচজনকে নেয়া হলো, তাকে হাসি দিয়ে বিদায় জানানো হলো.....

যে পাঁচজনকে নেয়া হলো তাদের কারো একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড আমার গল্পের ডাক্তারের মত শক্তিশালী নয়।যে পাঁচজনকে নেয়া হলো তাদের সম্মিলিত পাবলিকেশনের সংখ্যা আমার গল্পের নায়কের অর্ধেক....

জিজ্ঞেস করেছিলাম-আপনাকে নেয়া হলো না কেনো?

হতাশ কণ্ঠে তিনি উত্তর দিয়েছিলেনঃ' তাদের পলিটিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড ছিলো, আমার নেই.....'

২....

এক ছাত্রনেতা একবার আমার এক প্রিয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিকে আঙুল তুলে বলেছিলো -'এখানে যাদের পোস্টিং তাদের সবাই কোনো না কোনো ভাবে পলিটিক্যালি লিঙ্কড্ এবং পলিটিক্যালি হেল্পড্'.....

আমি বিশ্বাস করি নাই।বছরের পর বছর যে ছাত্রনেতার সাথে বই-খাতার কোনো সম্পর্ক নাই, ক্যান্টিনে বসে সিগারেটের ধোঁয়া উড়ানোই যার কাজ-তার কথা বিশ্বাস করা কোনো কাজের কথা না।"ছাত্রনেতা" শব্দে 'নেতা'র আগে 'ছাত্র' শব্দটি আছে।আগে সঠিকভাবে ছাত্র হতে হবে, পরে নেতা হওয়া যেতে পারে, তার কথাকেই আমি দাম দেই, "নেতাছাত্রে"র কথা গোণায় না ধরলেও আমার চলবে .....

সরকারী চাকরী করতে এসে ভুল ভাঙলো, দেখলাম সেই "নেতাছাত্রে"র কথা মিথ্যা না।একেক সরকারী কর্মকর্তার একেক শীর্ষস্থানীয় সরকারী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পোস্টিং হয়--এ পদায়ন করে দেবার জন্য তারা ফেসবুকে তাদের পলিটিক্যাল বিগ-ব্রাদারকে ট্যাগ করে আনন্দচিত্তে ধন্যবাদ জানান।কি নগ্ন স্বজনপ্রীতি এদেশে চলে! কি নির্লজ্জ এদের ধ্যান-ধারণা! কতটা হীন হলে একটা অপরাধ করার পরও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা সেটা নিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেন! আশ্চর্য!

এই স্বজনপ্রীতিতার জন্য আমাদের দেশে '৭১ এ রক্তগঙ্গা বয়েছিলো? যে মাটিতে লক্ষ মুক্তিসেনা ঘুমিয়ে আছেন--এ স্বজনপ্রীতি দেখার জন্য তারা আত্মাহুতি দিয়েছিলেন? এ কোন্ সমাজ আমরা গড়ে তুলছি?

৩....

একটি ব্যাপার ক্লিয়ার করা প্রয়োজন ।স্পষ্ট ভাবেই বলছি-আমি রাজনীতি করার বিরুদ্ধে না।আমি বিশ্বাস করি- রাজনীতি ব্রিলিয়ান্টদেরই করতে হবে। "স্বাধীনতা তুমি বটের ছায়ায় তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীর
শানিত কথার ঝলসানি-লাগা সতেজ ভাষণ।"-- লাইনগুলো আমার অত্যন্ত পছন্দের একটি কবিতার অংশ.....

কিন্তু সে রাজনীতি হতে হবে নিজের দেশের কল্যাণে, নিজের পোস্ট বা পদবীকে টিকিয়ে রাখার জন্য নয়, কিংবা যোগ্য লোককে বাদ দিয়ে অযোগ্য লোকের চাকরী পাইয়ে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার জন্য নয়.....

নিজের বুকে হাত দিয়ে আমরা কি বলতে পারবো যে আমরা রাজনীতিকে নিজের সুবিধার জন্য ব্যবহার করিনি? এটা কি আমাদের করার কথা ছিলো?

রাজনীতি যারা করেন তাদের প্রয়োজন ছিলো মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং নামক সৃজনশীল সেক্টরগুলোতে একটি ন্যায়সঙ্গত সিস্টেম গড়ে তোলা-যেখানে প্রত্যেকে তার যোগ্যতা অনুযায়ী ট্রিট হবেন, প্রত্যেকের পদমর্যাদা বা পোস্টিং নির্ধারিত হবে তার নিজের যোগ্যতার মাধ্যমে। সেটিই হতে পারতো সত্যিকারের দেশপ্রেমের নোটেশন।এই সেক্টরগুলোতে যারা রাজনীতি করেন তারা কি সেই পরিবেশ কখনো তৈরি করতে চেয়েছেন? আমরা কি এতটা উচ্চতায় নিজেদের তুলতে পেরেছি?

এই সৃজনশীল সেক্টরগুলোতে যারা রাজনীতি করেন আমি তাদের ব্রিলিয়ান্ট বলেই জ্ঞান করি।এই ব্রিলিয়ান্ট রাজনীতিবিদদের মাঝে কি একজনকেও আমরা পাবো না যিনি সৎ সাহস নিয়ে এই অসুস্থ সিস্টেম পরিবর্তনে এগিয়ে আসবেন?আর কত অপেক্ষা আমাদের করতে হবে? আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও কি একই বিষাক্ত পরিবেশে বড় হবে?

রাজনীতির ছত্রছায়ায় থেকে আমরা যারা আজকে পদপদবী বাগিয়ে নিচ্ছি, অযোগ্য হওয়া স্বত্তেও যোগ্যকে হটিয়ে চাকরী ছিনিয়ে নিচ্ছি--তারা কি সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বাস করেন? আপনারা কি তাই মনে করেন যে বঞ্চিতদের দীর্ঘনিঃশ্বাস সৃষ্টিকর্তার নিকট পৌছায় না? "প্রত্যেককে তার নিজস্ব মুদ্রায় হিসাব দিতে হবে"--একথাটা আমরা ভুলে যাই কেনো?......

৪....

"তলাবিহীন ঝুড়ি"-যে দেশকে বলা হতো, সে দেশ এখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বানায়.....

দেশ আগাচ্ছে, সন্দেহ নাই।তবে সে আগানোটা অনেকটাই স্ট্রাকচারাল, মূল্যবোধে আমরা পেছনে যাচ্ছি।দেশের সৃজনশীল গোষ্ঠীর বিভিন্ন অংশের পদায়নে আমরা স্বজনপ্রীতিতার যে কালো স্বাক্ষর রেখে চলছি তার ফল কিন্তু শুভ নয়।আজ থেকে বছর বিশেক পর একটি ওয়েল স্ট্রাকচারড্ এন্ড ইকুয়িপড্ কান্ট্রির নেতৃত্ব থাকবে কিছু অযোগ্য লোকের হাতে।কাজেই দেশের অগ্রগতি কিন্তু একটা পর্যায়ে এসে থেমে যাবে......

দেশে পদ্মা সেতু হচ্ছে।জিডিপি বাড়বে ১ থেকে ১.৫ পয়েন্ট, আশাব্যাঞ্জক খবর।যদি এর সাথে স্বজনপ্রীতি বন্ধ করে ইনটেলেকচুয়াল সেক্টরগুলোতে নির্মোহভাবে যোগ্য ব্যাক্তিকে পদায়ন করা যেতো, তবে জিডিপির পয়েন্ট কত বাড়তো বলে আপনার মনে হয়? আমরা কি বুঝতে পারছি সেইভাবে আগানোটাই আমাদের জন্য আদর্শ ছিলো?

৫....

একটি গল্প দিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম।গল্পের শেষাংশ বলি....

রাতে হসপিটালে ডিউটি করছিলাম।গল্পের নায়ক আমাকে ফোন দিলেন.....

জানালেন দেশের বাইরের কয়েকটি হসপিটালে নক্ করে রেখেছিলেন।মালয়েশিয়ার এক আধাসরকারী হসপিটাল থেকে তার সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে।এদেশে গল্পের নায়ক কনসালটেন্ট পোস্টে রয়েছেন।মালয়েশিয়ার হসপিটাল তার একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড ও পাবলিকেশনের সংখ্যা দেখে ঐদেশে তাকে Associate Professor পোস্টে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। Assistant Professor হবার দৌড়ে তার দেশ তাকে ছুড়ে ফেলেছে, অন্য দেশ তাকে কুড়িয়ে নিয়ে যত্ন করতে চাইছে। How pathetic!......

কথোপকথনের শেষ অংশটুকু আপনাদের শোনাইঃ

--কনক, চলে যেতে বলছো?
--হুম, Rotten system এর যাঁতাকলে পিষ্ট হবার কারণ দেখিনা
--কিন্তু দেশ ছেড়ে চলে যেতে যে কষ্ট হয়....

এদেশ থেকে এক নক্ষত্রের পতন ঘটবে, দেশ তার এক যোগ্য সন্তানকে হারাবে।দেশ ছেড়ে তাকে চলে যেতে বলতে আমারও তো কষ্ট হয়।আপনাদের কষ্ট হয় না?.....
__________________________

ডা. জামান অ্যালেক্স । দেশের জনপ্রিয় প্রতিভাবান মহৎ কথাশিল্পী।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়