Saha Suravi
Published:2025-03-09 09:25:37 BdST
"মেয়েরা আবার ইএনটি-তে সার্জারী করবে!""ফাঁকি দেবার জন্য অসুস্থতার বাহানা করছে মেয়েটা"
অধ্যাপক ডা শাকিল আহমেদ
---------------------
“মেয়ে যখন- তুমি স্ত্রীরোগের চিকিৎসকই হও।“ পরিবারের সকলের পরামর্শ। মিটফোর্ড থেকে ইন্টার্নী শেষ করেছে- মেডিসিন আর সার্জারী নিয়ে। ১৯৯৯ সালে। গাইনী করেনি। নিজের ইচ্ছে ইএনটিতে ক্যারিয়ার করার। পরিবারের মতামত মেনে শাহলা ফুফুর (অধ্যাপক শাহলা খাতুন)কাছে বিএসএমএমইউ-তে গাইনী বিভাগে কিছুদিন কাজ হল। মাসখানেক পর সে পথ থেকে ইস্তফা। ইএনটি পড়বো। দেশে তখনও ইএনটি-তে এফসিপিএস/এমএস করেননি কোন নারী। দু'একজন ডিপ্লোমা করেছেন। এই ফিল্ডের বাকী সকলেই পুরুষ। ১৯৮১/৮২ সালে এফসিপিএস চালু হবার পর থেকে গত ২০ বছরে সরকারী নারী চিকিৎসকদের কেউই বিসিপিএস-এর অঙ্গনে পা বাড়াননি। বিসিএস পাশ করে হবিগঞ্জের সাব-সেন্টারে বাধ্যতামূলক দু'বছর কাজ করার ভেতর এফসিপিএস (ইএনটি) প্রথম পর্ব পাশ করে ফেলল। শুরু হল নিজের কলেজে- মিটফোর্ড হাসপাতালে প্রশিক্ষণ। একদিন দেখি হাসপাতাল থেকে আগেই বাসায় চলে এসেছে। মুখটা অন্ধকার। -কি হয়েছে?” -অপারেশন থিয়েটারে অসুস্থ বোধ করছিলাম। স্যার বললেন মেডিসিন বিভাগে চেকআপের জন্য যেতে।” "মেয়েরা আবার ইএনটি-তে সার্জারী করবে! ওটি করবে না তো; ফাঁকি দেবার জন্য অসুস্থতার বাহানা করছে মেয়েটা।" মেডিসিনের অধ্যাপক মহোদয় সেদিন তাঁর সামনেই আরেক সহকর্মীকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন। নারী হয়ে নিজেকে শল্য চিকিৎসক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার যুদ্ধের শুরুটা সেইদিন থেকেই। ভাবলাম- আচ্ছা, পুরুষ হিসাবে আমাকে কি এমন বলেছে কেউ!- নাহ বলে নি।” বিরুদ্ধ স্রোতের সাথে লড়াই করতে করতেই একদিন সে সরকারি চিকিৎসকদের মধ্যে ইএনটি-তে প্রথম নারী হিসাবে এফসিপিএস হিসেবে পাশ করল। তারপর সময়ের পরিক্রমায় আজকে নাক-কান-গলা বিষয়ে দেশের প্রথম নারী অধ্যাপক । পথটা সহজ ছিল না মোটে। পুরুষযন্ত্রের সাথে বিগত ২০-২১ বছর এই যুদ্ধ করতে হয়েছে নিয়তই এবং অনেকটা একাকী-। সাক্ষী হিসাবে দু'একটা সংযোজন না দিলে অপূর্ন থেকে যাবে- একাডেমিক কাজে সুযোগ পাওয়া ছিল, না পাওয়ার মতোই। লেকচার ক্লাস কালে-ভদ্রে দেয়া হতো। সহযোগী অধ্যাপক এবং ইউনিট প্রধান হয়েও কোন ছাত্রকে থিসিস গাইড করতে দেয়া হয়নি দীর্ঘ পাঁচ বছরের বেশী সময় (সহযোগী অধ্যাপকদের গাইড হবার নিয়ম থাকা সত্বেও)। সোজা বলে দিয়েছে- "তোমাকে গাইড হতে দেবো না। অধ্যাপক যদি হতে পারো, তখন দেখা যাবে।" এমন কি তাঁর সংশোধন করা ছাত্রের থিসিস প্রটোকল নিয়ে গেছে। অনেক সময় কম জনবল নিয়ে কাজ করতে হয়েছে; দেয়া হয়নি জনবল। এতোসব তাচ্ছিল্যে আর পথ আগলানতে দমে যায়নি কখনোই। ব্যতিক্রম দু'একজন শিক্ষক হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছিলেন পরম যত্নে। নাক-কান-গলার ক্যান্সার সার্জারী হচ্ছে এই সাবজেক্টের সবচাইতে জটিল আর বিপদজনক অপারেশন। সকল ইএনটি সার্জনই করেন না এই ধরনের অপারেশন। চুল পরিমাণ এদিক ওদিক হলেই ছিন্ন হতে পারে বড় কোন ধমনী বা নার্ভ। পরিণতি- প্যারাল্যসিস থেকে মৃত্যু। একেকটা অপেরেশন করতে কখনো লেগে যায় ৭-৮ ঘণ্টা। এ বিষয়ে নিজেকে দেশের একজন দক্ষ সার্জন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে নিজেকে। পেশাগত, কাজ, প্রকাশনা আর বৈজ্ঞানিক উপস্থাম্পনা করেছে দেশে বিদেশে। কাজ করছে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ আইন-২০০৬ সংশোধন/পরিমার্জন জাতীয় কমিটির বিশেষজ্ঞ সদস্য হিসাবে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় দায়িত্ব দিয়েছে শিশুদের বধিরতা দূরীকরণের জন্য- ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট প্রোগ্রামের প্রকল্প পরিচালক হিসাবে।
আমি কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেছি পুরুষতন্ত্রের ভেতর দিয়ে তাঁর বন্ধুর যাত্রায় দৃঢ় হিরণ্ময়তা। "অনেক নারী চিকিৎসক এখন এগিয়ে আসছে ইএনটি পড়তে। পাশ করেছে। ভালো করছে। তারা যখন বলে- ম্যাম, আপনাকে দেখেই আমার এখানে আসা-। সেটাই আনন্দ-প্রাপ্তি। তখন সকল তিক্ততা ভুলে যাই মূহুর্তে। তবে সাথে আমাকে এটা বলতেই হবে এই যাত্রায় কয়েকজন শিক্ষক দু'হাত বাড়িয়ে এগিয়ে দিয়েছেন বলেই এতদূর আসতে পেরেছি। আজীবন কৃতজ্ঞতা আর শ্রদ্ধা তাঁদের প্রতি।"
আজ বিশ্ব নারী দিবসে আমার সহধর্মিনী অধ্যাপক ডাঃ হুসনে কমর ওসমানীকে এই দেশের নারী চিকিৎসকদের নতুন পথ দেখানোর জন্য নারী-সাহসীকা আমি বলতেই পারি। এই কথনে কেউ যদি খানিক পক্ষপাতিত্ব আছে মনে করেন, সত্যের খাতিরে তা কবুল করবো। আর তোমাকে বলবো- এগিয়ে যাও।
০৮, মার্চ, ২০২৫। রাত ১১:২৫।
আপনার মতামত দিন: