Ameen Qudir

Published:
2017-03-12 16:33:26 BdST

৫০ লাখ পর্যন্ত ফাইন, ৩ বছর দন্ড, লাইসেন্স বাতিল :ডাক্তারি পেশার কফিনে পেরেক



ডা. রেজাউল করীম
______________________________

আই এম এ র পশ্চিমবঙ্গ শাখা সাম্প্রতিক পাশ হওয়া ক্লিনিকাল এস্টাবলিশমেন্ট বিল ২০১৭ সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহন করেছে।

বিলটির যে সংক্ষিপ্তসার পাওয়া যাচ্ছে তা থেকে দেখা যাচ্ছে-
-পলিক্লিনিক, ডিসপেনসারী ও হাসপাতাল এই বিলের আওতায় আনা হয়েছে
-১৩সদস্যের একটি বিচারবিভাগীয় ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন এই বিলের আওতাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলির যে কোন ধরনের অভিযোগের তদন্ত করবে।
-চিকিৎসায় অবহেলা প্রমানিত হলে ৩লক্ষ থেকে ৫০লক্ষ পর্যন্ত ক্ষতিপুরণ দিতে হতে পারে

-সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক/চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল হতে পারে
-৩ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড হতে পারে।
-সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলি এই বিলের আওতায় রাখা হয়নি।
বিলের এই ধারা দেখার পর চিকিৎসকদের নিজস্ব সংগঠন এর সমর্থনে গলা মেলাতে পারে এটা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে।

 


"চিকিৎসায় ত্রুটি" বহুকথিত ও বহুচর্চিত এই শব্দবন্ধটির ব্যাপারে বিল কোন আলোকপাত করে নি ।
ত্রুটি নিরূপন কি করে একটা জুডিশিয়াল কমিশন করবে তা স্পষ্ট নয়।
চিকিৎসক কি তার অধিত বিদ্যা প্রয়োগের সময় জুডিশিয়াল কমিশনের পারমিশন নিয়ে কাজ করবে?
আ্যানজিওপ্লাস্টি করতে গিয়ে যদি রক্তক্ষরন হয়ে রোগী মারা যায় তাহলে তা কি অবহেলার আওতায় আসবে? প্রতিটি ইনটারভনশনে মৃত্যুর যে ঝুঁকি থাকে তা অবহেলা কিনা কে ঠিক করবে?

আমাদের দেশের আইন এমনকি খুনের আসামিকেও দোষী প্রমান হওয়ার আগে দোষী বলে চিহ্নিত করে না। কিন্তু চিকিৎসকদের যে ভাবে

পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করছে তা দেখে মনে হচ্ছে, চিকিৎসকরা খুন করার উদ্দেশ্য নিয়ে রোগীর চিকিৎসা শুরু করেছিল- নির্দোষী প্রমানের আগে পর্যন্ত তারা দোষী। সব সভ্যদেশে রোগী মারা গেলে চিকিৎসকরা নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনায় ক্রটিক্যাল গ্যাপ ইন ম্যানেজমেন্ট নিয়ে আলোচনায় ঐক্যমতে পৌঁছনোর চেষ্টা করেন ও সেই অনুযায়ী প্রটোকল পরিবর্তন করেন। প্রস্তাবিত আইনে সবজান্তা কমিশন চেয়ারম্যান সবকিছু নির্ধারন করে দেবেন। তাহলে ম্যানেজমেন্ট প্রটোকলটাও মাকালির থানে বসে আই এম এর কর্তারা ঠিক করে দিন না- আমরা নয় সেটাই এবার থেকে অনুসরন করবো।

 

এইসব সিরিয়াস জিনিস চর্চা আর চর্বিতচর্বন না করে পেশাটা বদলে নেবো ভাবছি। সবচেয়ে মজাদার পেশা অবশ্য রাজনীতি। আপনাকে কেউ ভুলেও জিজ্ঞাসা করবে না আপনার আয় কত। আপনি প্রকাশ্য দিবালোকে লুঠ করবেন, ঘুষ নেবেন, ঘুষের টাকার দামী গাড়ী চড়বেন, সমুদ্রপারে বা সমুদ্রতীরে হোটেল কিনবেন- কেউ প্রশ্নটিও করবে না। জুডিশিয়াল কমিশন বা সুপ্রিম কোর্ট কেউ আপনার কেশ স্পর্শ করতে পারবে না- সাক্ষী জুটবে না। থাকলেও হস্টাইল হয়ে যাবে।
আর একটা ভাল পেশা সাংবাদিকতা- "রাজনীতিকদের একাংশ", "চিকিৎসকদের একাংশ" বা "তথ্যাভিজ্ঞ মহল" আপনাকে সব সময় মসলাদার মাল সাপ্লাই করে যাবে। আপনি শুধু সুন্দর করে রান্না করবেন- একটু টক-ঝাল-মিস্টি-মিস্ট্রি-সেক্স-মিসটিসিজম নিয়ে একটা মিক্সচার বানাবেন। পাব্লিক খাবে ভাল, দেদার বিক্রি হবে আর টিআরপি ও বাডবে। আপনি সাংবাদিককুলে সবচেয়ে নামকরা "গুলমগীর" উপাধি, চাই কি ঠিকমত খেলতে পারলে "অমুক-শ্রী" পদক ও পেতে পারেন।


তিন নম্বর যেটি করতে পারেন তাহল- রম্য রচনা। আই এম এর সিরিওকমিক অবস্থান দেখে তিন নম্বর পেশাটাই সবচেয়ে উপযুক্ত হবে বলে মনে হয়।প্রাত:স্মরনীয় গুরুসদয় দত্ত মহাশয় তখন ব্রতচারী করে বেশ নামটাম করে ফেলেছেন। মানুষটি কাউকে না বলতে বা কারো কোন তিক্ত সমালোচনা করতে পছন্দ করতেন না। তার কাছে বহু মানুষ দেখা করতে আসতেন কিন্তু তারচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল "বই"। বাঙালী মানেই কবি, সাহিত্যিকে - নেহাত একটা ইয়েটস নেই বলে নোবেলটা পাওয়া হয় না। তা যাক, চাদ্দিক থেকে গুচ্ছের বই তার বাড়ীতে আসতে লাগল- সবাই চায় তিনি একটা প্রশংসাসূচক কিছু লিখে দিন।ঝানু আই সি এস একটা ভাল ফন্দি বার করলেন। তিনি একটি মুসাবিদা ছাপিয়ে রেখেছিলেন- " আপনার পুস্তক পডিয়া হাস্য/অশ্রু সম্বরন করিতে পারি নাই। আমি আপনার উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি কামনা করি"। বইয়ের বিষয় বস্তু অনুসারে তিনি অপ্রয়োজনীয় শব্দটি কেটে দিতেন। কখনো সখনো যে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে পড়তো না তা নয়, তবে তা খুব কম ই ঘটতো। আই এম এর ভাগ্য ভাল যে এক্ষেত্রে মুখ্য রচয়িতা একজনই। লেখার মুসাবিদাও মন্দ নয়- শব্দ বিপর্যয়? তা নিপাতনে সিদ্ধ বলে ধরে নিন...


২.

অনেকে আমাকে ব্যক্তিগতভাবে ফোন করে ও মেসেজ করে ক্লিনিকাল এস্টাবলিশমেন্ট বিল নিয়ে আলোচনার জন্য কনভেনশন ডাকার কথা বলছেন। খুব স্পষ্টভাবে বলতে চাই ডাক্তারদের পিঠ মাটিতে ঠেকে গেলে তারা রেগে গিয়ে খুব হুঙ্কার ছাড়েন, কিন্তু বর্ষণটা গর্জনের তুলনায় হয় নামে মাত্র। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখেছি অনেক অর্থ, শ্রম আর সময়ের বিনিময়ে সংগঠন গড়ে ওঠে তারপর দাস-মনোভাবাপন্ন কোন হোমডাচোমডা তাকে বিক্রি করে নিজের রাজনৈতিক আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। ২০০৯ র বামপন্থী বিরোধী অবস্থান নিয়ে গন-কনভেনশন করেছিলাম। অনেকে জানেন তার কি পরিনতি হয়েছিল। তাই সাধু সাবধান।


রাজনৈতিক মত-নিরপেক্ষ চিকিৎসকদের নিজস্ব একটা জায়গা দরকার প্রধানত তিনটি কারনে-
১. সারা পৃথিবী জুড়ে যারা স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেন তারা মনে করেন যে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠায় চিকিৎসকদের বড় ভূমিকা আছে। তারা, এ বিষয়ে রাজনীতিকদের শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করতে পারেন। সুরক্ষিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার প্রধানতম উপাদান এবং চিকিৎসকরাই সেখানে নেতা। তাই, তাদের নিরপেক্ষ, বাস্তব ও বৈজ্ঞানিক অবস্থান জরুরী। ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যা সেখানে তাদের ক্ষুদ্র রাজনৈতিক, ধর্মীয় ব ঐ ধরনের কোন গৌন পরিচিতি তাদের মতপ্রকাশের অবাধ স্বাধীনতার প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। সাংগঠনিক কাঠামোয় তার সম্ভাবনা অনেকাংশেই নির্মূল হয়।

২. চিকিৎসকদের সত্যিকারের সমস্যা ও তার সমাধান চিকিৎসকরাই সবচেয়ে ভাল বুঝবেন। কোন রাজনৈতিক নেতার পক্ষে সেটা বোঝা অসম্ভব।
৩. নানাকারনে, প্রধানত: রাজনীতিকদের আশ্রিত কিছু চিকিৎসক ও অসাধু কিছু চিকিৎসকের কল্যানে তারা সমাজের মূল স্রোতের কাছে তাদের পূর্বতন শ্রদ্ধার আসন হারিয়েছেন। এমন একটি সংগঠন প্রয়োজন যারা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে অনমনীয় দৃঢ মনোভাব নেবে।


এ রকম যে কোন উদ্যোগ যে কেউ নিলে আমি নির্দ্ধিধায় তাদের সঙ্গে যেতে রাজি। কিন্তু রাতের অন্ধকারে সরকারের সব অশুভ উদ্যোগে নিজের টিপছাপ দিয়ে, সাধারনের কাছে নিজের নিরপেক্ষ ইমেজ বিল্ডিংয়ের জন্য সভা ডেকে, আগে থেকে তৈরী করা ডকুমেন্টকে লেজিটিম্যাসি দেওয়ার প্রচেষ্টা যারা করছেন তাদের সাথে থাকবো না। নতুন যুবকরা এগিয়ে এসে নেতৃত্ব দিক, তাহলে যদি কিছু পরিবর্তন হয়।

___________________________

ডা. রেজাউল করীম । বাংলা র প্রখ্যাত লোকসেবী চিকিৎসক। সুলেখক। সুপন্ডিত।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়