Ameen Qudir

Published:
2017-03-06 22:18:24 BdST

আশ্বাসে বিশ্বাস নেই : সুবিধা চাই না, আমাদের অধিকার চাই




সুমন হুসাইন, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ
_______________________________

আমার কিছু কথা । যদিও ছোটমুখে কথাগুলো একটু বেশিই বড় শোনাবে । তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী । তবে আমার কিছু ক্ষোভ - রাগ - ঘৃণা - কষ্ট আছে । এ ঘৃণা আমার দেশের প্রতি না, জনগণের উপরও না । এ রাগ আমার প্রফেশনের মানুষদের উপরই ।

আমাদের ডাক্তারদের চলমান আন্দোলন কি একটা ইস্যুতে ছিলো ? বগুড়া মেডিকেলের চার ইন্টার্নের অন্যায়ভাবে যে বহিঃষ্কারাদেশ দেওয়া হয়েছে - তা প্রত্যাহারের জন্য ছিলো শুধু ?
অনেকের কথায় তাই মনে হচ্ছে ।

এর আগেও যতগুলো আন্দোলন হয়েছে স্বাস্থ্য সেক্টরের অসামঞ্জস্যতার বিরুদ্ধে , সেইগুলোতেও একইভাবে ফাটল সৃষ্টি করা হয়েছে ।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আন্দোলন করেছে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ । কিছু আছে 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি ' স্টেজে আর বাকি যারা আছে তারা আছে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞায় ।

কেউ স্বাচিপের নিষেধাজ্ঞায় - কারণ সে স্বাচিপে যে নেতাকে মেইনটেইন করেন । তার নেতার নিষেধ, যে, যেও না এসব আন্দোলনে । এটা মন্ত্রীর বিরুদ্ধে, সরকারের বিরুদ্ধে । করা যাবে না । চুপ থাকো ! দেখতে থাকো !

আবার যারা ছাত্রলীগ করে, তারাও বাঁধা একটা সীমাবদ্ধতায় , সরকারদলীয় রাজনীতি করে সরকারের মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কথা বলা - এটা তো রাষ্ট্রদোহী কাজ ! এতে রাজনীতি থাকবে? বড় হওয়ার সিঁড়িটা তো বন্ধ হয়ে যাবে ! তাই চুপ থাকো ! দেখে যাও কি হয় !

এই সীমাবদ্ধতাটা, এই যে ভয়, এই যে ক্ষমতার লোভ - এই একটা কারণেই বিগত আন্দোলনগুলো ব্যর্থ হয়েছে ।
সব বাধা মেনে, সকল রাজনীতির ঊর্ধ্বে গিয়ে যারা নিজের অধিকারের কথা ভেবে যারা আন্দোলন করেছে - তাদের বিভিন্ন তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে । বিরোধীদল, বামদল, জামাত-শিবির ট্যাগ ! কিন্ত তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শেরই সৈনিক ।

এভাবেই আগ্নেয়গিরির মতো ফুলে উঠা আন্দোলনও নিভে গেছে ।

ডাক্তাররা কোণঠাসা হয়েছে, হচ্ছে । এবং একমাত্র এই রাজনীতির কারণেই ।
আমি বলবো - রাজনীতিই ডাক্তারদের আজকের এই দূরবস্থার কারণ । যে রাজনীতি আমাদের সমস্যার সমাধান করবে, যে রাজনীতি আমাদের উত্তরণের পথ হওয়ার কথা ছিলো - সেই রাজনীতির কাছেই আমরা জিম্মি ।
সাংবাদিক নয়, জনগণ নয়, মিডিয়া নয়, মন্ত্রীও নয় - আমরা আমাদের রাজনীতির কাছে জিম্মি । ভেবে দেখুন ভালোমতো । উত্তরটা তাই আসবে । আমাদের মূলা ঝুলানো রাজনীতিই আমাদেরকে খোঁড়া করে রেখেছে । এই রাজনীতির টোপ দিয়েই - ডাক্তারদেরকে ইউজ করা হয় ইচ্ছামতো, তাদেরকে দিয়ে পা চাটানো হয় , আবার পা চাটানো শেষ হয়ে গেলে এই ডাক্তারদেরকেই মুখোমুখি করে দেওয়া হয় জনগণের ।
এই রাজনীতির কারণেই - আমরা ডাক্তাররা নিজেরাই নিজেদের শত্রু । একটা মেডিকেল ছয়টা গ্রুপিং কিংবা তারও বেশি । টাকা পয়সা নয়, জমি-জমা নিয়ে নয়, ব্যক্তিগত শত্রুতাও না, গার্লফ্রেন্ড কিংবা বউকে নিয়েও না - আমাদের শত্রুতার কারণ আমাদের রাজনীতি । আমরা সবাই বুঝি এটা । আবার এই রাজনীতিই আমাদের ডাক্তারদেরকে মুখোমুখি করছে সাধারণ জনগনের । মন্ত্রী করছে জনগণের সমর্থন পাওয়ার জন্য, চিকিৎসক নেতা করছে এমপি হওয়ার জন্য, এমপি করছে মন্ত্রী হওয়ার জন্য, সাংবাদিক করছে পত্রিকার কাটতি বাড়াবে বলে ।
সো, আল্টিমেট কনডম এই সাধারণ ডাক্তাররাই ।

ভেবে দেখুন । এ দায় জনগণের না । এ দায় রাষ্ট্রের, এ দায় সরকারের, এ দায় প্রশাসনের । আর সবচেয়ে বড় দায় - আমাদের নিজেরাই । কারণ - আমরা পা চাটতে চাটতে
" ঘেউ পা চাটা " হয়ে গেছি । আমাদের পা চাটতে অনেক মজা লাগে, আমরা এতটাই আহাম্বক হঢে গেছি যে - নিজের আত্নসম্মানের দাম নাই আমাদের কাছে । আমরা নিজেরাই নিজেদের সবচেয়ে বড় শত্রু । " আমরা ইউনাইটেড, আমরা সবাই এক " - বলে যতই আমার চিল্লাই, আমরা তো আসলে এক না । আমাদের ডালে ডালে, পাতায় পাতায়, শিরায় উপশিরায় বিভক্তি । আমরা কেউ কারো ভালো দেখতে পারি না ।

ঠিক এই সুযোগটা নেয় আমাদের রাজনীতি । তখন থার্ড ক্লাস, ফোর্থ ক্লাসের মানুষের রাজনীতি দিয়ে পরিচালিত হতে হয় আমাদের । আমরা তাদের পা চাটি । সমাজের সবচেয়ে শিক্ষিত শ্রেণী, অভিজাত শ্রেণী, যাদেরকে সবাই দ্বিতীয় ঈশ্বর বলে ডাকে - সেই ঈশ্বররা স্বয়ং যখন তাদের পা চাটে । আর কি চাই তাদের ? আমার মনে হয় ওরা নিজেরাও হাসাহাসি করে - ডাক্তাররা এত বোকাচোদা ক্যানো? ওদের পেছনে তো নাই ই, সামনেও নাই !

যাহোক, যা বলছিলাম - আমাদের আন্দোলনের ইস্যু একটা ছিলো না । আমাদের দাবি শুধু একটা মেডিকেল কেন্দ্রিক না । আমাদের দাবি সকল ডাক্তারদের নিরাপদ কর্মক্ষেত্র নিশ্চিতকরণ , ডাক্তারদের ন্যায্য সম্মান নিশ্চিতকরণ, প্রস্তাবিত স্বাস্থ্যসেবা আইনের যে ধারাগুলো আমাদের জন্য হুমকিস্বরুপ - তাহা রহিতকরণ ছিলো । বগুড়া মেডিকেলের ইন্টার্নদের ব্যপারটা আমাদের জন্য ছোট্ট একটা ইস্যু ।
সো, সেখানকার বহিষ্কারাদেশ যদি তুলে নেওয়া হয় ও , সেটা আমাদের বিজয় অবশ্যই । তবে, আমাদের আন্দোলনের শেষ এখানেই নয় । ছোট্ট একটা শুরু মাত্র ।

আমাদের এ আন্দোলন ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য অনেক পায়তারা চলছে,যা আগেউ চলেছে ।

প্রথমত, তারা অনেক বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াবে । যাতে আন্দোলনকারীরা ডিমরালাইজড হয়ে যাবে । আন্দোলনের গতি কমানোর জন্য - অনেকসময় গুজব ছড়াবে, যে দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে । কিংবা নেতারা বসতে চায়, কথা বলতে চায় প্রতিনিধিদের সাথে । এই এখান থেকেই শুরু হয়ে গেলো আসল গ্যাঞ্জাম । নিজেদের মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন আসবে, ও লিড দিচ্ছে কেন? ও কেন এত মিডিয়ার ফোকাসে চলে যাচ্ছে? নিশ্চয়ই শালা ফুটেজ খাওয়ার ট্রাই মারছে । ওকে দাবাও সবাই মিলে । শুরুটা এভাবেই হবে !
এবং পেছনের কলকাঠি নাড়বে কিন্ত তারাই । Divide & Rule খেলা খেলবে তারা !
দ্বিতীয়ত, যেকোন আন্দোলন খুব বেশি দিন চলে না । আস্তে আস্তে ঝিমিয়ে আসে । তাই তারা বিভিন্ন বাহানা দিয়ে, প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাইম খেতে থাকবে । আর আন্দোলন ঝিমাতে থাকবে । কোনো আন্দোলনই নরম নরম কথা বলে হয় না তাই । আন্দোলন হতে হবে ঝড়ের মতো । হয় আজই না হয় কোনদিনই না । উদাহরণটা, তবুও দিই - যেমনটা করেছে পরিবহন শ্রমিকেরা । অনেক সুশীলামি করবেন, ওদের ক্লাস আর আপনার ক্লাস নিয়ে বক্তৃতা ঝাড়বেন । তবে, ওরাই আসল শিক্ষিত, যে ওরা নিজের অধিকার বুঝে, আন্দোলন করে কিভাবে নিজের অধিকার আদায় করতে হয় তা বুঝে । আপনি বুঝেন না । অশিক্ষিত, স্পাইনলেস - আপনিই, কারণ আপনি নিজের অধিকার বুঝেন না ।

তৃতীয়তা - সমন্বয় । সারা বাংলাদেশে আলাদা আলাদাভাবে কর্মসূচি দিয়ে খুব বেশি লাভ নেই । এসব কেউ দেখেনা । সারা বাংলাদেশে একযোগে কঠোর কর্মসূচি দিন । ঢাকাতে কঠোর আন্দোলনের ডাক দিন । দুইঘন্টা রোড অফ করুন, আর দুইঘন্টা সব ধরণের সার্ভিস দেওয়া অফ করুন - ইন্টার্ন, মিডলেভেল, বড় ডাক্তার, ছোট ডাক্তার , আউটডোর, ইনডোর, ইমার্জেন্সি সব বন্ধ করুন । কয়েক ঘন্টার জন্য অশিক্ষিত হয়ে যান, কয়েক ঘন্টার জন্য কষ্ট হলেও মনুষ্যত্বহীন হয়ে যান, রোগী মরলো না বাঁচলো ভুলে যান - দেখবেন অধিকার কিভাবে আদায় হয় । চাপে না পড়লে রাষ্ট্র কখনো অধিকার দ্যায় না । শান্তিপূর্ণভাবে কোনো আন্দোলন হয় না ।

চাপে ফেলুন, দেখবেন জনগণ সোজা, সাংবাদিক সোজা, মন্ত্রী সোজা, রাষ্ট্রও সোজা । একবার শুধু আপনারা আপনাদের সামর্থ্যটা দেখান । তারপর দেখেন, কোন রোগী দুর্ব্যবহার করার সাহস পায়, কোন মন্ত্রী ছাগলামি করার সাহস পায় , কোন সাংবাদিকের কলমে কত জোর সব টের পেয়ে যাবে সবাই । আপনার অভাব টের পাওয়ান সবাইকে, তাহলে সবাই আপনার মূল্য বুঝবে ।

আর সবচেয়ে Important ব্যপার, কেউ টোপ খাবেন না । আপনার স্বাচিপ নেতা, বিএমএ নেতা, ছাত্রলীগ নেতা আপনাকে বলবে, অলরেডি বলছেও হয়তো - " মন্ত্রীর বিরুদ্ধে আন্দোলন মানে তো সরকারবিরোধী তার মানে রাষ্ট্রদ্রোহী ! আমরা সরকারদলীয়, সো এ আন্দোলন করা যাবে না ! "
দয়া করে এই ভুলটা করবেন না । কিসের রাজনীতি, যেখানে আপনার কোনো নিরাপত্তা নেই? কিসের রাজনীতি যেখানে আপনার কোনো আত্নসম্মান নেই ? কিসের রাজনীতি যেখানে, আপনার অস্ত্বিত্ব নিয়েই প্রশ্ন ?

বিএমএ, স্বাচিপ এগুলো কাদের সংগঠন? কাদের ঘাড়ে পা রেখে তারা রাজনীতি করেন ? তাদের রাজনীতির হাতিয়ার কারা? আমরাই তো !
যে বিএমএ র প্রধান কাজ - সর্বস্তরে চিকিৎসকদের অধিকার নিশ্চিত করা, ডাক্তারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা - এতসব ঘটে যাচ্ছে , সেই সেন্ট্রাল বিএমএ কি উদ্যোগটা নিয়েছে? সারাদেশে তোলপাড় চলছে - একটা কথা বলেছে বিএমএ?

কেন বলে না ? শুনুন, ডাক্তার রাজনীতিতে বেনিফিটেড হয় ওই টপ লেভেলের কিছু নেতারাই, যাদেরকে আপনারাই বানান । আর বাকি সবাই জাস্ট ইউজড হই, আর কিছু না !
আজ তাদের রাজনীতি বাঁচানোর জন্য, তারা আপনাদেরকে বলবে আন্দোলন করো না । আপনি তার কথায় আন্দোলন করবেন না ।

মন্ত্রী খুশি আপনার নেতাদের উপর, সরকার খুশি । তারা তরতর করে উপরে উঠে যাবে, কেউ বা এমপি হবে, মন্ত্রীও হবে !

আর আমি? আপনি?
আমাদের কি হবে? আমরা মার খাবো আগের মতই । আপনার সহকর্মী বোনকে কদিন পরে রাস্তায় ফেলে ধর্ষণ করা হবে , আপনার সহকর্মী ভাইকে মেরে ফেলা হবে - ডাঃ অমিত, ডাঃ মুরাদ, ডাঃ সুমনের মতো করে। পথে ঘাটে মার দেওয়া হবে যেমন কুকুর দেখলে সবার ঢিল দিতে ইচ্ছে করে তেমন করে । আর আপনার নেতারা? আপনার বিএমএ? স্বাচিপ? কি করবেন?
সোজা উত্তর - এখন যা করছেন, তাই!

তাই, আপনারটা আপনারই করতে হবে । এবার যদি না হয়, আর কোনদিনই না । আন্দোলনটা হোক আমাদের সবার, একযোগে সারাদেশে । আমরা সুবিধা চাই না, আমাদের অধিকার চাই ।

 

______________________________

 

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়