Ameen Qudir

Published:
2017-03-05 21:31:48 BdST

ড্রাইভার আর ডাক্তারদের মিলটা কোথায় বলেন তো: সাংবাদিকের প্রশ্নে ডাক্তারের জবাব


ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ


______________________________

আমার এক স্নেহধন্য সাংবাদিক শরীফুল হাসান ফেসবুকে প্রশ্ন করেছেন “ড্রাইভার আর ডাক্তারদের মধ্যে মিলটা কোথায় বলেন তো?”


বর্তমান বাস্তবতায় তার এ প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক তো বটেই তার চাইতে অনেক বেশি ব্যক্তিগত- সাইকোলজির ভাষায় আমরা যেটাকে বলি ‘ইগো ডিফেন্স মেকানিজম।‘

মাস কয়েক আগে এই অনুজ সাংবাদিকের চিকিৎসক বিষয়ক একটি পোস্টে আমার ডাক্তার বন্ধুদের অসহণশীল মন্তব্যের জেরে তার মধ্যে বাংলাদেশের চিকিৎসক সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যা মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘স্কিমা’ । একটা অতি সাধারণীকরণের সুত্রে তিনি বাংলাদেশের চিকিৎসক বিষয়ে একধরণের বিবমিষাবোধে ভুগছেন।


তিনি একজন অত্যন্ত প্রতিশ্রুতশীল সাহসী সাংবাদিক। আশা করি এই অতিসাধারণীকরণের সূত্রের ভ্রান্তি তার অচিরেই দূর হবে এবং তিনি তার ভাবনার ডানাগুলোকে বিস্তৃত করতে সক্ষম হবেন।

একজন মনোচিকিৎসক হিসেবে আমি তার মনোবেদনা বুঝি- যেদিন মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন প্রধান মিজানুর রহমান ২০১২ সালে চিকিৎসকদের ‘অমানুষ’ বলেছিলেন সেদিন এই মর্মবেদনা আমাকেও রক্তাক্ত করেছিল।

সেসময় মিজানুর রহমানের বক্তব্য আর সেবিষয়ে আমার বন্ধু মশিউল আলমের একটি কলামের প্রতিক্রিয়ায় ‘মানুষ-অমানুষ-নামানুষ’ নামে এটি ছোট্ট প্রতিক্রিয়া আমি লিখেছিলাম এই অনুজ সাংবাদিক এর পত্রিকাতেই।


যাক প্রশ্নে ফিরে আসি- তার প্রশ্নটি পাব্লিক করা , তারপরও তিনটি ডোমেইনের লোকেরা এর জবাব দিতে পারে-
১.ড্রাইভাররা
২.ডাক্তাররা
৩. অপরাপর মানুষরা যারা ডাক্তার আর ড্রাইভারদের কাছ থেকে সেবা (প্রকারান্তরে সেবার নামে নিবর্তন) গ্রহণ করেন।

ড্রাইভিং কিন্তু একটি পেশা। সেবামূলক পেশা। কিন্তু এই প্রশ্নের মধ্যে তাদেরকে একধরণের তাচ্ছিল্য বা হেয় করার একটি নোশন রয়েছে- ড্রাইভারদের সাথে তুলনা করায় আমার বন্ধু চিকিৎসকরা গোস্বা করতে পারেন কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে প্রতিটি পেশাকে সমান সম্মান জানাতে হবে।


হ্যাঁ- কোনো কোনো অপেশাদার ড্রাইভারদের কারণে মানুষের জীবন হুমকীর মধ্যে পড়ে যাচ্ছে- সেটা শুদ্ধিকরণের দাবী রাখে। সংশোধনের সুযোগ রয়েছে। একটি লক্ষ্য পেশাকে ট্রল করাটা শালীনতার পর্যায়ে পড়েনা। উল্লেখিত প্রশ্নটির উত্তরে একজন পেশাদার ড্রাইভার বলতে পারেন- “ড্রাইভারী আর ডাক্তারি দুটোই সেবামূলক পেশা, দুটিই কারিগরী পেশা, দুজনের হাতেই মানুষের জীবন , দুজনকেই সংবেদনশীল হতে হয়, দুটোই থ্যাংকসলেস জব- রোগী বাঁচলে ‘এত টাকা লাগল কেন’- মরলে ‘মরলো কেন’, ডানে গেলে ‘জ্যামে ঢুকলি কেন’ বামে গেলে ‘ঘুরপথে গেলি কেন’ ইত্যাদি”।


এই প্রশ্নে চিকিৎসকরা অসহনশীল মন্তব্য করছেন- ক্ষুব্ধ হচ্ছেন। আসলে অসহনশীলতা নয়, ক্ষুব্ধতা নয়- প্রশ্নকর্তাকে পরিশীলিতভাবে তার ভুল দৃষ্টিভংগিটি ধরিয়ে দেয়া উচিৎ। ব্যক্তিগত রাগ থেকে সৃষ্ট তার এই প্রশ্নটিকে সহজভাবে নিতে হবে। ড্রাইভারদের সাথে তুলনা করায় রাগ করা যাবেনা- ড্রাইভিংও একটি সেবামূলক পেশা।

 

আর অপরাপর সাধারণ মানুষেরা এই প্রশ্নটি দারুণ উপভোগ করছেন- ডাক্তারদের একহাত নিতে করোই খারাপ লাগেনা।


আমাদের পাশ্চাত্য ঘরানার ডাক্তারি কারিকুলাম আমাদের চিকিৎসকদের সামন্ততান্ত্রিক মনোভাব গড়ে তুলতে যতটা সহায়ক মানবিক হতে ততটাই অন্তরায়।

গলদটা গোড়ায়- সংস্কৃতি না জেনে, ইতিহাস না জেনে,সংগীত না বুঝে ,সহনশীলতার চর্চা না করে ডাক্তারের সার্টিফিকেট পাওয়ায় আমরা ভুলে যাই আমরা ‘বিলাতি’ নই, ‘পাকিস্তানী’ নই, আমরা বাংলাদেশের ডাক্তার।


মিজানুর রহমান, শরীফুল হাসানের মত যারা আমাদের সমালোচনা করেন তারা আমাদের নিয়ে মজা করেন, ট্রল করেন, হেয় করেন তারা এতে আনন্দ পান , লাইক আর কমেন্টের বন্যায় পুলকিত হন কিন্তু ভুলে যান আমরা তাদেরই ডাক্তার- আমরাও তাদের মত বাংলার সন্তান।সংশোধনের সুযোগ আছে- উৎকর্ষতার সময় ফুরিয়ে যায়নি- আমাদের ডাক্তারদের যদি মানবিক করতে চান তবে এই লাইকপ্রিয় স্টান্ট প্রশ্নের বদলে সমাধানের পথ খুঁজতে আপনার মেধা আর মননকে বিনিয়োগ করুন।

 

দেশকে ভালোবাসতে চাইলে দেশের মানুষকে ভালোবাসুন। আপনার ড্রাইভারকে ভালোবাসুন-আপনার ডাক্তারকে ভালোবাসুন।
কোনো বিশেষ পেশাকে হেয় করে সেই পেশার মানোন্নয়ন সম্ভব হবেনা। কদিন আগে বসুন্ধরার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরকে প্রচারমাধ্যমগুলো যেভাবে জংগী বানালো তাতে যদি কেউ প্রশ্ন করেন ‘গোয়েবলস আর সাংবাদিকদের মধ্যে মিল কোথায়’ তবে আমাদের সাংবাদিকদের মানোনন্নয়ন সম্ভব হবেনা। তাদেরকে আত্মউপলব্ধির সুযোগ দিতে হবে।

আজকের প্রথম আলোর অন্যতম প্রধান সংবাদ দেশের মানুষের গড় আয়ু গত ৪৫ বছরে বেড়েছে ২৪ বছর। অন্যদিকে একই সময়ে বিশ্বে গড় আয়ু বেড়েছে ১২ বছর। অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি বৈশ্বিক গড়ের দ্বিগুণ। এর খানিকটা দাবিদার কিন্তু ডাক্তাররা।নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন বাংলাদেশে এসে মন্তব্য করেছিলেন, ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য খাতে এগিয়েছে, এখানে মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে (বাসস ২৯ ডিসেম্বর, ২০১১)। ভারতের কংগ্রেসের নেত্রী সোনিয়া গান্ধী বাংলাদেশ সফরে এসে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাস্থ্য-ব্যবস্থাপনা উন্নয়নশীল দেশের জন্য মডেল হতে পারে’ (২৬ জুলাই ২০১১, দৈনিক সকালের খবর)।দারিদ্র সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের এই উন্নয়নকে ল্যানসেট একটি 'প্যারাডক্স' হিসেবে উল্লেখ করেছিল।


বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশে প্রতি এক হাজার থেকে এক হাজার ৫০০ মানুষের জন্য একজন চিকিৎসক থাকা প্রয়োজন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আছে প্রতি ৩৯০ জনের জন্য একজন চিকিৎসক। আর আমাদের দেশে প্রতি চার হাজার জনের জন্য একজন। ১৬ কোটি মানুষের জন্য প্রায় ৫০ হাজার জন।উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আউটডোরে বসা একেকজন চিকিৎসককে ছয় ঘণ্টায় গড়ে এক শর ওপরে রোগী দেখতে হয়।


তার ওপর থানার ওসি সাহেবের কাজের মেয়েকে বাসায় গিয়ে দেখতে হবে, ছাত্রনেতা এসেছেন উপজেলা স্বাস্থ্যকর্তার রুমে, তার ঘাড়ে ব্যথার ওষুধ দিতে হবে, চেয়ারম্যান সাহেব একটি ইনজুরি সার্টিফিকেট চান, পত্রিকার বা চ্যানেলের স্থানীয় প্রতিনিধি এসেছেন, সঙ্গে তাঁর নিজের লেখা অখাদ্য কবিতা বা নেতার জীবনীর বইয়ের ১০টি কপি নিয়ে; সেগুলো নাকি ডাক্তারদের কিনতেই হবে ইত্যাদি।


এই অবস্থার নিরসন করে কিভাবে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা আর চিকিৎসকদের উৎকর্ষ সাধন করতে হবে, কীভাবে চিকিৎসক, সাংবাদিক, ড্রাইভারদের আমার চিকিৎসক, আমার ড্রাইভার, আমার সাংবাদিক ভাবতে হবে সেজন্য সচেষ্ট হতে শরীফুল হাসানকে অনুরোধ করছি।

_______________________________

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ । দেশের জনপ্রিয় কলামিস্ট। কথাসাহিত্যিক ।
সহকারী অধ্যাপক, চাইল্ড এডলোসেন্ট এন্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা ।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়