DESK
Published:2024-09-08 09:21:58 BdST
“আমি নরসিংদীর পল্লী চিকিৎসক স্যার”
অধ্যাপক ডা সাকিল আহম্মদ
শিশু বিভাগ, ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ
এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংস্কার ও চিকিৎসা সেবার মানোন্নয়নে গঠিত বিশেষজ্ঞ প্যানেল সদস্য
____________
২০০১ সালের কথা। ঠিক ২৩ বছর আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজে শিক্ষকতা শুরু করি। শিশু বিভাগে গবেষণা সহকারী, রেজিস্ট্রার। কাজ হল ৩য় আর ৫ম বর্ষের ছাত্রদের ক্লিনিক্যাল ক্লাস নেয়া, রুটিন করা, শিক্ষকদের ক্লাসগুলোতে সহায়তা করা, ওয়ার্ড এন্ডিং পরীক্ষা নেয়া। দিনের ক্লাস ছাড়া রাতেও রুটিন করে ক্লাস নিতাম আমরা কয়েকজন। তখন এলিফেন্ট রোডে সবে প্রাকটিসে বসেছি। ১-২টা রোগী আসে। কোনদিন ফাঁকা যায়। এলিফেন্ট রোডের গলি, কাঁটাবনের ঢাল, বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝ দিয়ে রাত আটটা-সাড়ে আটটার মধ্যে হাজির হতাম। রিক্সায়, কিছুটা হেঁটে। ছাত্ররা হাজির। ছাত্রীরাও (না বললে জেন্ডার জটিলতায় পড়ে যাব)। উপস্থিতি প্রায় ১০০ ভাগ। সবাই মনযোগী আর মেধাবী। সেটাই আমাকে উদ্বুদ্ধ করত ওদেরকে যথাসাধ্য শেখাতে। উত্তরায় বাসা ছিল। ফিরতে রাত হয়ে যেত। তারপরও ভালই লাগতো শিক্ষার্থীদের সান্নিধ্য। ২০০৫ সাল পর্যন্ত কাটিয়েছি চমৎকার সময়।
২০২৩ সালের প্রথম দিকে। বিসিপিএস-এর কাউন্সিলর নির্বাচন করছি। ভোট চাইতে সম্ভবত একটা প্রাইভেট হাসপাতালে গেছি। সন্ধ্যে বেলা। রোগী দেখার সময়। ভোট চাওয়ারও সময় সেটা। কি একটা জটিলতা! বাইরে এটেন্ডান্ট ভ্রু কুঁচকে তাকাচ্ছে। রোগী বের হতেই দরজা ঠেলে ঢুকে গেলাম। ডাক্তার সাহেবও তড়াক করে দাঁড়িয়ে গেলেন। “স্যার। ভোটের জন্য?” চেনার চেষ্টা করছি। “আপনাকে চাইতে হবে না। নাম আমি আগেই দেখেছি“ কিছুক্ষণ তাকিয়ে চিনতে পারলাম- আমার ঢামেক-এর ছাত্র। নাম ভুলে গেছি। আকারে খানিকটা গোলগাল হয়েছে। সালাম করার জন্য এগিয়ে আসছে দেখে জড়িয়ে ধরলাম। বলল- স্যার, আপনার মনে আছে রাতে পড়াতে আসতেন।“ মাথা নাড়ালাম। “আমার বাসা মিরপুর ১০-এ ছিল। আপনার ক্লাসের জন্য দিনে হস্টেলে থেকে যেতাম। ক্লাস করে বাসায় রাতে ফিরতাম। বাসে করে।“ শিক্ষক জীবনের এই আজীবন মনে রাখার মতো প্রাপ্তি আমার চোখে প্রকাশ হওয়া কোনমতে হাত দিয়ে ঢাকলাম। আরও কি জানি বলছিল- তখন আর শুনতে আর পাইনি। কোন কথাও গলায় আর আসেনি- “তোমার অনেক রোগী অপেক্ষা করছে। যাই।“ তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে পড়লাম। সেদিন আর ভোটের প্রচার করিনি। এমন স্বর্গীয় আনন্দের পর আর মর্ত্যের ভোট চাওয়ার কি দরকার!!
“স্যার, আপনার বাসার ঠিকানাটা দেন। আমি পল্লী চিকিৎসক“। সেহেরী খেয়ে ঘুমিয়েছি। ভাঙ্গা ঘুমে দ্বিধান্বিত কণ্ঠ- “কে?”
“আমি নরসিংদীর পল্লী চিকিৎসক স্যার”।
“অসীম, কি-রে কেন ফোন করছিস”! আমার ছাত্র, এখন নরসিংদী সদর হাসপাতালের গাইণী বিভাগের জ্যেষ্ঠ্য কনসালটেন্ট। নিজেকে পল্লী চিকিৎসক বলে- পাশ করার পর থেকে জেলা আর উপজেলায় কাটাচ্ছে বলে।
“আপনার বাসায় আসবো। ঠিকানাটা দিন।“ দিলাম। দিন কয়েক আগে আমার ছেলে তার প্রথম বেতনের টাকা দিয়ে মিষ্টি নিয়ে এসেছিল। সেটা নিয়ে একটা আত্মকথণ দিয়েছিলাম ফেসবুকে। লেখাটা পড়ে অসীম লিখেছিল- নরসিংদীর মিষ্টি খাওয়াবে। ভেবেছিলাম লেখার জন্য লেখা। কিন্তু না। নিজেই হাজির- শুধু দুই প্রকার মিষ্টি না। সাথে নিয়ে এসেছে এক বোতল মাঠা (আমার পছন্দের)। “আপনাকে তো আর তেল দিতে পারিনি কোনদিন, তাই ঘি দিচ্ছি।“ এক বয়াম ঘি। কি আর বলবো- আবেগ এখানে কথা বলতে দেয়না।
তার চেয়ে বরং অসীমের কথা বলি। কে-৫১ এর ছাত্র। ২০০১ সালে ইন্টার্নী ছিল। সারাক্ষণ হাসপাতালেই থেকেছে তার প্রশিক্ষনকালীণ এক বছর সময়ে। তখন তার শিশু বিভাগে প্লেসমেন্ট। একদিন সকালে এসে বলল-রাতে ২৩টা সেলাই দিয়েছি স্যার”। সারারাত ইমারার্জেন্সীতে কাজ করেছে। ২৩ জন কাটা-ছেড়া রোগীর স্টিচ দিয়েছে। সকালে উঠেই চলে এসেছে শিশু বিভাগে কাজ করতে। এই ডেডিকেশনের গল্পটা শুনিয়ে আমার ছাত্রদের প্রায়ই বলি-- ইন্টার্নীশিপ শেখার সময়- যা পার শিখে নাও। পরে তো কেউ তোমাকে এভাবে শেখাবে না। শেখার সুযোগও দেবে না।
অসীম নরসিংদীতে থেকে শুরু করেছে- গাইনেকলজিক লেপারোস্কপী। হিস্টেরস্কোপী- জরায়ুর ভিতরে এন্ডোস্কোপ দিয়ে রোগ পরীক্ষা করা। পেট না কেটে, ছিদ্র না করে জরায়ুর ভিতরে অপারেশন করা- টিউমার, জরায়ুর ভিতরে পর্দা কাটা, পলিপ অপসারণ। আমাকে জানালো নরসিংদীতে হিস্টেরস্কোপীক অপারেশন ৪০০-এর মত করেছে আজতক। ঢাকায় ৮-৯টা সেন্টারে এবং ৪টা বিভাগীয় শহরে এই হিস্টেরস্কোপী হয়। ছোট জেলা শহরে অসীম শুধু যে অপারেশন করে তাইই নয়। কিছুদিন হল একটা প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করেছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ জনের মতো স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এই প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের নানা যায়গায় রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
আমরা পারিনি। কিন্তু আমার ছাত্ররা তো দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এর চেয়ে আনন্দের আর কি থাকতে পারে একজন শিক্ষকের! কি দেবো তাকে- আমার আজীবন শিক্ষক আমার আদর্শ- আমার বাবার আত্মজীবনী বই দিলাম।
পুনঃ মিষ্টি আর মাঠা বেশ স্বাদের। কিছু লোকজনকে দিয়েছি। ছাত্রের এমন ভেট অন্যকে কিছু না চাখাতে দিলে কি হয়!!
shakildr@gmail. com
আপনার মতামত দিন: