Dr.Liakat Ali

Published:
2022-10-06 20:02:13 BdST

আখাউড়াতে নিসার ভাইর ফার্মেসি,কৈ,বোয়াল ,বেগুন ভাজি, বিন্নি ভাত ও  মো. রফির গান


লেখক ডা গুলজার হোসেন উজ্জ্বল

 

ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল
রক্ত রোগ বিশেষজ্ঞ, সঙ্গীত শিল্পী
______________________
এমন সকালে নিসার ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ শুনলাম।

চারদিকে উৎসবের আমেজ। শহরে ছুটি ছুটি গন্ধ। আকাশে শরতের মেঘ। এর মাঝে এক গভীর বিষাদের বাতাস সিধ কেটে আমার বুকের ভেতর কেমন করে যেন ঢুকে পড়ল! নিসার ভাই আর নেই।

নিসার ভাই আমার জীবনের একটি গুরত্বপূর্ণ পর্বের সাথে জড়িয়ে আছেন।

আমি যখন আখাউড়াতে যাই সরকারি চাকরির পোস্টিং নিয়ে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কোন প্রায়ভেট প্র‍্যাক্টিস করবোনা। হাসপাতালের ডিউটির বাকি সময়টা পড়ব আর লিখব। আর ঘুরে বেড়াব। স্টেশনের ভাসমান মানুষদের সাথে গল্প করব। হরিজন পল্লীতে যাব৷ আলী ভাইয়ের সাথে আড্ডা দিব। এসবই।

নিসার ভাইয়ের ফার্মেসিতে একদিন আলী ভাইই আমাকে নিয়ে গেলেন। উদ্দেশ্য হলো নিসার ভাইয়ের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া৷ আমাকে চেম্বারে বসানোর পূর্ব ষড়যন্ত্র ছিল কিনা জানিনা। যাবার পরই নিসার ভাই তার টেবিলের তাকে সাজানো একটা চাইনিজ সিডি প্লেয়ারে পুরনো দিনের হিন্দি গান ছাড়লেন। ইয়ে দুনিয়া কে রাখওয়ালে। মোহাম্মদ রফি।

দুনিয়ার যিনি রাখওয়ালা তিনি তখনই লিখে দিলেন আমার জীবনের এক নতুন পর্বের গল্প। নিসার ভাই ষাটোর্ধ একজন মানুষ৷ তিনি হয়ে গেলেন আমার ভাইবন্ধু। আমি তাঁর ফার্মেসিতে বসা শুরু করলাম। রুগী থাকলে তো রুগী দেখি৷ বাকি সময় বসে বসে গান শুনি৷ নিসা ভাই গান ছেড়ে দেন- তেরে দুয়ারে খাড়া এক যোগী। কিংবা পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি।

এরপর অনেকগুলো বছর। ঢাকায় বদলি হয়ে আসার পরও শুক্রবার করে আমার আখাউড়া যাওয়া চলে। কত প্রিয় মুখের সাথে দেখা মেলে। আমার গন্ডির বাইরের বাউল মনটাকে ভীষণ আশকারা দিতেন নিসার ভাই। মাঝে মাঝে তিতাসে নৌ বিহার করতে যেতাম।রোগী আসলে তিনি রোগীদের বসিয়ে রাখতেন এই বলে " ডাক্তার সাবে নৌকা ভ্রমন করতে গেছে। আপনে বসেন। উনি অন্যজগতের মানুষ। খালি রোগী দেখলেই উনার চলেনা। এইটা আপনাদের বুঝতে হবে। "

আমার প্রতি নিসার ভাইয়ের প্রশ্রয় ও মূগ্ধতা সর্বজন বিদিত। প্রতি শুক্রবার উনার জন্য ছিল বিশেষ দিন। আগের দিন রাত থেকেই শুরু করতেন অস্থিরতা। সকাল বেলা অস্থির পায়চারি করতেন ফার্মেসির সামনে। বারবার রেলস্টেশনের গার্ডকে ফোন দিতেন। "পারাবত ট্রেন কদ্দুর? আইজকা টাইম মত আইবোনি?"

আমি চাঁপা কলা পছন্দ করি। উনি একছড়ি চাঁপা কলা এনে রাখতেন। সাথে আরো যেসব ফল খেতে পছন্দ করি, আনাতেন। নাবিস্কোর ম্যাজেন্টা রঙের প্যাকেটের বিস্কুট। কোথা থেকে আনাতেন কে জানে? দুপুরে কৈ মাছ, বোয়াল মাছ, বিন্নি ভাত, বেগুন ভাজি, গরুর ভুনা আরো কত কি? একেকটা শুক্রবার উনার জন্য ছিল মেজবানী। উনার স্ত্রী পুত্রদেরকেও তটস্থ করে রাখতেন। আয়োজনে যেন ত্রুটি না হয়। আমি প্রতিবারই বলতাম নিসার ভাই এত কিছু কেন করেন? উনি কপট অভিমান করে বলতেন " এইডা কইয়েন না। আপনে আমার ভাই না? "

সন্ধ্যায় ট্রেনে ওঠার আগে উনি আবার গান বাজিয়ে দিতেন। আমি যেসব মানুষদের পছন্দ করতাম তাদের ডেকে এনে হাজির করতেন৷ রেল ক্রসিংয়ের আশেপাশের কিছু শ্রমজীবি মানুষ, পিঠা বিক্রেতা, দই বিক্রেতা, জুতার কারিগর এদের ডেকে আনতেন। এরাও এসে দুটা আদাব সালাম দিয়ে কিছু চিকিৎসাপাতি, স্যাম্পল ওষুধ নিয়ে যেতেন৷ আর ভালবেসে তাদের স্ব স্ব সামগ্রী তোফা হিসেবে দিয়ে যেতেন৷ নিসার ভাই নিজেই এদের ডেকে এনে মিছেই আবার দাবড়ানি দিতেন। "হইছে হইছে, অহন যাও। ট্রেইনের টাইম হইয়া যাইতেছে। ডাক্তার সাব অহন একটু রেস্ট নিব। তোমরা যাও। "

সব কিছুর পেছনেই আমি নিসার ভাইয়ের ভালবাসাটা খুব টের পেতাম, আর ভেতরে ভেতরে কৃতজ্ঞতায় নুইয়ে পড়তাম। আখাউড়ার অনেক ডায়াগন্সটিক সেন্টারের আধুনিক চেম্বারের অফার ত্যাগ করে আমি নিসার ভাইয়ের সেই ছোট্ট ফার্মেসিতেই কাটিয়ে দিয়েছি জীবনের একটা বড় সময়।

আখাউড়ার চেমবার বন্ধ করার পরও বিপদে আপদে যোগাযোগ করতেন। আমি তাঁকে আমার আত্মীয় বলেই গণ্য করতাম। তাঁর ছেলে পান্থকেও আমি বিশেষ স্নেহ করি।

আব্বা যেদিন মারা গেলেন। খবর পেয়ে নিসার ভাই আমাদের গ্রামের বাড়িতে একটা বাইক নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। আজ নিসার ভাইও চলে গেলেন৷ আমি আখাউড়া যেতে পারলাম না।

নিসার ভাইয়ের বয়স সত্তুর হয়েছিল সম্ভবত। আরো কিছুদিন থাকতেই পারতেন। হৃদযন্ত্রের আকস্মিক ছন্দপতন তাঁর জীবনকে থামিয়ে দিল। আমার একজন কাছের মানুষ চলে গেলেন। যার কাছে আমার আমৃত্যু ভালবাসার ঋণ। কণা মাত্র শোধ করা হলোনা।

মাঝে মাঝে ভাবি, কতটা অকৃতি অধম আমি! কিছুই দিতে পারিনা। কেবল ভাগ্যগুনে নিয়েই গেলাম।

নিসার ভাই, ভাল থাকবেন। দেখা হবে।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়