Dr.Liakat Ali

Published:
2022-05-28 20:11:11 BdST

"শিক্ষা" ও " স্বাস্থ্য""অনুৎপাদনশীল খাত আপনাকে বাঁচাতে পারবে না "


এক অনুষ্ঠানে লেখক ডা. সুকুমার সুর রায় । ছবি সংগৃহীত


ডাঃ সুকুমার সুর রায়

___________________________________

"শিক্ষা" ও " স্বাস্থ্য " এই দুইটি খাত আমাদের দেশে অনুৎপাদনশীল খাত হিসেবে চিহ্নিত।
এই দুইটি খাতের উৎপাদনশীলতা তাৎক্ষণিকভাবে পরিমাপযোগ্য নয়।

কৃষিখাতে এই বছর কত লক্ষ টন বেশি ধান উৎপাদিত হয়েছে তা সবাই তাৎক্ষণিকভাবে জানতে পারে। অথবা জনতা ব্যাংক গত অর্থবছরে কত মুনাফা করেছে তাও জানা যেতে পারে।
কিন্তু শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য এই দুইটি খাতের আয় তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায় না ।
ফলে সবার ধারনা এই দুইটি খাতে শুধুই টাকা ঢালতে হয় ( (? জনগনের টাকা বাহুল্য খরচ) কিন্তু কোন লাভ হয় না।

এই দুইটি খাতের লাভ দৃশ্য মান না হলেও লাভ যে কিছু আছে তা সবাই মুখে মুখে স্বীকার করেন বটে, কিন্তু অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করেন না।
যেহেতু এই দুইখাতে বিনিয়োগের ফলাফল তাৎক্ষণিক দৃষ্টিগোচর হয় না তাই জনগন এবং সরকার কেউই এই দুইখাতের উন্নয়নে যথেষ্ট বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হন না।

পক্ষান্তরে রাস্তাঘাট, ব্রিজ কালভার্ট, সুউচ্চ ভবন নির্মানে বেশ উৎসাহ দেখা যায়। কারন এইগুলি দৃশ্যমান উন্নয়ন সহজেই জনগনের দৃষ্টিগোচর হয় এবং সরকারও আঙ্গুল তুলে দেখাতে পারে। বিরোধী দলকেও খোঁচা মারা যেতে পারে।

সংক্ষিপ্ত আকারে শিক্ষা খাতের আয় নিয়ে কথা বলা যাক।

আমাদের দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দুইটি মাত্র প্রধান পথ আছে --

১) তৈরি পোশাক রপ্তানি - বাৎসরিক আয় প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার।

২) বিদেশে কর্মরতদের পাঠানো রেমিট্যান্স -বাৎসরিক আয় প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার।

★রেডিমেড গার্মেন্টস শিল্পে কাজ করে প্রায় ৫০ লক্ষ অদক্ষ শ্রমিক।
এই শিল্পেই উচ্চপদে, টেকনিক্যাল পদে কাজ করে হাজার হাজার বিদেশি ভদ্রলোক যারা লক্ষ লক্ষ ডলার আমাদের দেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছে।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা যদি উন্নততর হত, তাহলে এই হাজার হাজার দক্ষ ও টেকনিক্যাল পদে আমাদের লোকেরাই কাজ করত, লক্ষ লক্ষ ডলার দেশের বাইরে চলে যেত না।

★ আমাদের পদ্মাসেতুর নির্মাণ কাজ করেছে বিদেশী কোম্পানি।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা যদি উন্নত হত তবে আমাদের দক্ষ জনশক্তি ও আমাদের নিজস্ব কোম্পানি পদ্মাসেতুর নির্মাণ কাজ করত, আমাদের বিলিয়ন ডলারের সাশ্রয় হত।
আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে তা আশা করা বাতুলতা মাত্র।

★ আমাদের এক কোটি রেমিট্যান্স যোদ্ধা দেশের বাইরে আছেন যারা গড়পড়তা অদক্ষ শ্রমিক।
এদের পাশাপাশি যদি আমরা আরো দশ লক্ষ শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করতে পারতাম তাহলে আমাদের রেমিট্যান্স প্রবাহের হার এক লাফে দ্বিগুণ বেড়ে যেত।

কিন্তু তা এখন সম্ভব নয় ভবিষ্যতেও সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।

অনুৎপাদনশীল ' শিক্ষা ' খাতে আমাদের বরাদ্দ খুবই কম।
ফলে বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ে দুনিয়ার এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের তালিকায় আমাদের একটি বিশ্ববিদ্যালয়েরও নাম খুঁজে পাওয়া যায় না।
জ্ঞানী গুনি বিজ্ঞানী তৈরিতো দুরের কথা সেখানে তৈরি হচ্ছে তোষামোদি চাটুকারের দল।
যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ হওয়ার কথা কোভিড ১৯ এর ভ্যাকসিন আবিষ্কারের গবেষণা, সেখানে তারা নির্লজ্জের মত বানাচ্ছেন হ্যান্ড স্যানিটাইজার! ব্র‍্যাভো!!

এবার আসি আরেক অনুৎপাদনশীল খাত " স্বাস্থ্য " খাত সম্পর্কে দুই এক কথা বলার জন্য।
স্বাস্থ্য খাতের আয় তাৎক্ষণিকভাবে দেখা যায় না ।
তবে মাপার জন্য একধরনের দাঁড়িপাল্লা ব্যবহার করা হয়, এগুলিকে স্বাস্থ্য সূচক বলে, যেমন - ১। শিশু মৃত্যুর হার, ২। মাতৃমৃত্যুর হার, ৩। গড় আয়ু ইত্যাদি ।
এই গুলির লাভ কি চোখে দেখা যায়?
তাহলে একটু বুঝিয়ে বলি --
ধরুন আপনার ৫ বছরের ছেলেটি কঠিন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত।
এখন দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যদি অত্যন্ত ভাল হত , সময়মত টিকা দেওয়ার কারনে, সময়মত আধুনিক চিকিৎসা লাভের কারনে আপনার এই ৫ বছরের ছেলেটি ওপরওয়ালার ইচ্ছায় জানে বেঁচে গেল।
( শিশু মৃত্যুর হার কম)
এখন এই মরে যাওয়া বাচ্চাটি বেঁচে ওঠার পর ৬ বছর বয়সে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে শিক্ষা বিভাগের হাতে হস্তান্তর করা হলো।
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যদি উন্নত ও অত্যাধুনিক হয়, তাহলে আমরা আশা করবো প্রাইমারি, সেকেন্ডারি, হায়ার সেকেন্ডারি পার হয়ে আপনার ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দোরগোড়ায় পৌছে গেল। সেখান থেকে বৈজ্ঞানিক হয়ে বের হয়ে ছেলেটি মাসিক দশ লক্ষ টাকা বেতনে ' গুগলে ' চাকরি করতে চলে গেল।
২৫ বছর বয়সে চাকুরীতে যোগ দিয়ে আপনার বৈজ্ঞানিক ছেলেটি ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত চাকুরী করে অবসরে গেল।
এখন একটি হিসাব করা যাক, সে ৩৫ বছরে কতটাকা ইনকাম করেছে -- ১০ লক্ষ *১২* ৩৫ = ৪২ কোটি টাকা।
এখন ৪২ কোটি টাকার ২ কোটি টাকা আপনি গার্ডিয়ান হিসাবে পাবেন।
বাকি ৪০ কোটি টাকা সমান দুই ভাগ করে ২০ কোটি টাকা স্বাস্থ্য বিভাগকে এবং অপর ২০ কোটি টাকা শিক্ষা বিভাগকে দিয়ে দিন। আপনি গার্ডিয়ান হিসাবে মন খারাপ করবেন না। কারন আপনার প্রায় মৃত ছেলেটিকে স্বাস্থ্য বিভাগ বাঁচিয়েছে এবং শিক্ষা বিভাগ তাকে বৈজ্ঞানিক বানিয়েছে!
একটি চীনা প্রবাদ আছে - " যদি স্বল্প মেয়াদি লাভ চাও তাহলে ধান চাষ করো, মধ্যমেয়াদী লাভ পেতে চাইলে গাছ লাগাও, আর যদি দীর্ঘমেয়াদি লাভ চাও তাহলে সন্তানকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তোল। "

★আমরা যদি যথেষ্ট বিনিয়োগ করে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নত ও আধুনিক করতে পারতাম তাহলে প্রতি বছর ৪ বিলিয়ন ডলার বিদেশে চিকিৎসার নামে পাচার হত না।
আমাদের শিল্পপতিরাও এখানে বিনিয়োগ করে অন্তত নিজেদের প্রয়োজনেও আধুনিক হাসপাতাল বানাতে পারত। তাহলে অন্তত সামান্য আইসিইউ এর অভাবে হাজার কোটি টাকার মালিকের জীবন হয়তোবা বেঘোরে নাও যেতে পারত ( হায়াত মউত ওপরওয়ালার হাতে) ।
মনে রাখতে হবে, আমরা যতই উন্নয়নের ঢাকঢোল পিটাই না কেন, বাংলাদেশে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ জিডিপির মাত্র - ১.৯৯ %।
এবং স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ------ ২. ২৭ %।

দুইটিই দক্ষিন এশিয়ার অন্য দেশগুলির তুলনায় সর্বনিম্ন।
( সূত্র- https://www.data.worldbank.org) ।

উল্লেখ্য " টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার" নির্ধারিত ১৭ টি লক্ষ্যমাত্রার ৩ ও ৪ নম্বরটি হলো যথাক্রমে 'শিক্ষা' ও ' স্বাস্থ্য '।
সকল খাতকে সমান গুরুত্ব দিয়ে বরাদ্দ ও যথাযথ উদ্যোগের মাধ্যমে ' টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা এবং একটি সার্বজনীন বসবাস উপযোগী দেশ গড়ে তোলা সম্ভব।
"শিক্ষা "ও "স্বাস্থ্য " খাতকে "অনুৎপাদনশীল খাত" বিবেচনা করে অবহেলায় ফেলে রাখলে বাঁচার সম্ভাবনা যথেষ্ট কম।

____ ডাঃ সুকুমার সুর রায়।।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়