ডেস্ক

Published:
2022-03-08 18:39:43 BdST

এম বি বি এস,  (এফসিপিএস), এমডি  : এই  নিন লম্বা স্ট্যাটাস


লেখক

 

ডা. মৃণাল সাহা
_______________

(১)

ফাইনাল প্রফ সামনেই। সবার পড়াশোনা তখন তুঙ্গে। আমি তখনো টিউশানীতে ইস্তফা দিতে পারিনি। রাত ১২ টায় রুমে আসি, রাত একটায় বই নিয়ে বসি, ভোর পাঁচটায় ঘুমাই। দেশ দুনিয়ায় কি হয় না হয় আমার কানে কিছুই আসে না। হোসাইন, মিশু, সাইলু ওদের সাথেই যাবতীয় বাতচিত। এর মাঝেই চলতে থাকে উথুর সুপার হিট ডায়লগ, ছুলির এসকন, মিঠুর দুষ্টামী, প্যাকটরের সভাপতি ভাষণ, গুতুর রিল্যাক্সেশান। হুটহাট রাত দুপুরে নারুর রুমে গিয়ে গুতাগুতি করে ওকে খেপানো ছিলো চরম বিনোদন। নজমুদ্দিনের সাথে আড্ডা, মিজানের বামাখাস, সবুজ এর ধড়কন কিম্বা কিশোর কুমারের গান আর হিরোর সুভা হো গ্যায়ি মামু ছিলো বাড়তি পাওনা!

সেকেন্ড প্রফ থেকেই রাত দশটা বাজলে আমাকে আর হোসাইনকে অনির্বাণ স্যার হারিকেন দিয়ে সারা হোস্টেল খুঁজে বেড়াতেন। বারবার ফোন দিয়েও আমাদের রিচ করতে না পেরে বিরক্ত হওয়া তার অভ্যেসে পরিনত হয়ে গিয়েছিলো। বিতশ্রদ্ধ হয়েও বিনা বেতনে আমাদের দুই ভাইকে পড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা ছিলো অনির্বানের। আমাদের মঙ্গল কামনায় এহেন দয়াশীল বন্ধুর ফ্রি ডেমো দেয়ার প্রাণপন চেষ্টাকে আমরা এখনো কুর্ণিশ করি। এমন আন্তরিকতা এই যুগে ভাবা যায়? আর আমি এতই ফাউল যে, স্যারের সাথে দেখা হলে পা উঁচু করে লাত্থি স্টাইলে স্যালুট দিতে আমি একটুও কার্পণ্য করতাম না ( এখনো করি, আজীবন করে যাবো)। 

(২)

তখন আমার পড়ার টেবিল জুড়ে থাকতো এস এস সি/ এইচ এস সি এর বই আর ভর্তি কোচিং এর শীট।  ফাইনাল প্রফের আগে বুকের নীচে বালিশ দিয়ে রাত দুপুরে পড়াশোনা আর সকালে ঘুম থেকে উঠতে না পারাটাকেই রুটিন বানালাম। মাঝে মাঝে লাইব্রেরিতে গেলে রাতে আর পড়াশোনা হতো না, সেদিন আড্ডা চলতো। ভালোই ছিলাম তখন। দুই প্রফে কপাল গুনে পাস করে গেলেও ধরা খেয়ে গেলাম ফাইনাল প্রফে। পরীক্ষার আগের রাতে আয়েশ করে ডেভিডসনের সাইকিয়াট্রিক ডিজিজের ক্লিনিক্যাল ফিচার পড়ার মত বিলাসিতা করলে কি পাস হয়? এবার আর ঘুঘু বাঁচলো না, লাস্ট মোমেন্টে এসে ধরাটা খেয়েই গেলাম!

আমার এখনো মনে পড়ে ফাইনাল প্রফে আমাকে যখন স্যার বললেন, এসাইটিক ফ্লুইড এক্সুডেটিভ না ট্রাঞ্জুডেটিভ, আমি উত্তর দিয়েছিলাম এক্সুডেটিভ! একটা রিউম্যাটোলক্যাল ডিজিজের নাম জানতে চাইলে বলেছিলাম, " রিউম্যাটিক ফিভার"!  ফলে, মহাসমারোহে মেডিসিনে ফেইল!

(৩)

এম বি বি এস পাস করে প্রথম ভেবেছিলাম গাইনী অথবা এনেস্থেশিয়া পড়বো। ইন্টার্নীতে সব ওয়ার্ড ভালো লাগলে যা হয় আর কি! আমার পোস্ট গ্র‍্যাজুয়েশান এর ভর্তি পরীক্ষায় একেক বার একেক সাবজেক্ট চয়েস দেখে বন্ধুরা হাসতো আর বলতো এইবার কি দিবি?

সার্জারীতে ট্রেনিং করলাম, এফ সি পি এস পার্ট-১ দিলাম, ধরাও খেলাম। ট্রেনিং ছাড়তে হলো সাব সেন্টারে পোস্টিং এর জন্য। ধুম ধাম ওটি করে বেড়াই, খারাপ কি? হঠাৎ মনে হলো, ক্রিটিক্যাল কেয়ার পড়ি, তারপর, সিউর হলাম সাইকিয়াট্রিস্টই হবো! সার্জারীর উপর একরাশ অভিমান জমলেও ওটি এসিস্ট করার লোভ আমি মনে হয় কোনদিনই ছাড়তে পারবো না। অতঃপর, মেডিসিনে আসার দুঃসাহস করলাম। কেন, কিভাবে, আমার জানা নেই, সত্যি জানা নেই। শুধু ভেবেছিলাম দেখি না কি হয়, মেডিসিনে সিট বেশী আছে চান্স পেলেই খুশী থাকবো, পাস না করলে নাই। আই ই এল টি এস করা আছে কানাডা তো চলেই যাবো। তখন আমি উপজেলায় চরম ব্যস্ত, রাতে দুই তিন ঘন্টা ঘুমাই আর হাঁটার বদলে দৌঁড়ে দৌঁড়ে রোগী দেখি। সেই সাথে যুক্ত করলাম আল্ট্রাসনোগ্রাফির প্র‍্যাক্টিস, ক্যারোল এম রুমাক হয়ে গেলো ভালোবাসার টেক্সটবুক। সত্যি বলতে কি আমি আল্ট্রাসনোগ্রাফি করা ভীষন এনজয় করি। মেডিসিন, সার্জারী, গাইনী সব জ্ঞান এখানে যেন এক হয়ে মিশে যায়। একদিন অভিমান করে সিদ্ধান্ত নিলাম জেনারেল ক্যাডারে বিসিএস দিয়ে এডমিন অফিসার হবো। আনফর্চুনেইটলী সেটা আর হয়ে ওঠা হয়নি কারন আমার বি সি এস এর প্রথম চয়েস বোকার মত মেডিক্যাল সায়েন্স দিয়ে রেখেছিলাম।

(৪)

সারাদিনের চেম্বারের ব্যস্ততাকে টা টা বাই বাই দিয়ে আমি মোবাইল অফ করে চলে গেলাম ঢাকা। একমাসের প্যাকেজ হাতে নিলাম, দিন রাত আমি আর কিছু বুঝি না শুধুই পড়ি আর কাঁদি, আরে আমি তো কিছুই পারি না। এরপর যখন ঘুমের মাঝে পড়া শোনা স্বপ্ন হয়ে দেখা দিতে শুরু করলো, আমার যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো। এ যাবৎকালে আমি যখনই এক্সাম এর আগে এক্সাম নিয়ে ভীতিকর স্বপ্ন দেখেছি, আমি ধরে নিয়েছি আমি পাস করবো আমার প্রিপারেশান হচ্ছে, এটাই আমার ইন্ডিকেটর ছিলো। যথারীতি এক্সাম এর দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাংগে মাঝ রাতে উঠে বসি, একটু পড়ি আবার ঘুমাই। এভাবেই চট্টগ্রাম মেডিকেলে আসা।

সার্জারীর ট্রেনিং নিয়ে মেডিসিনে আসলাম, আমি তো কিছুই জানি না। প্রথম ব্লক ফাইনাল, আমার ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। সব কিছু আমার মাথার উপর দিয়ে যায়, আমি আড়ালে গিয়ে কাঁদি। স্যারদের সামনে আসি না, আমাকেও কেউ চেনে না। রাজীব স্যার এর অশেষ দয়ায় আমি একটা ব্লকে পার পেয়ে গেলাম, ফলে আমার মধ্যে একটা স্পিড কাজ করলো। কিভাবে কিভাবে যেন রোগীর বেডের কাজ আমি শেষ করে ফেলতাম। একটা দিনও আমার জানা মত আমি মেডিকেলে যাওয়া মিস করিনি। এই দিকে বাবা অসুস্থ্য, ওইদিকে ফ্ল্যাটের কাজ, আর আমি ফেইজ এ এর নাদান রেসিডেন্ট। এরপর একে একে ব্লক শেষ হলো, প্রায় সব ব্লক ফাইনালেই কোন মতে পাস অথবা রি এক্সামিনেশান। ভাবলাম ফেইজ এ শেষ হলেই, ইমিগ্রেশানে কানাডা ফুরৎ দিবো, তখন পর্যন্ত আই ই এল টি এস এর ব্যান্ড ৭ অর্জনই আমার অহংকার। ফেইজ এ চলে এল, এলিজিবল হলাম, প্রথমবার ফেইজ এ ফেইল!

আবার আগের থিওরী, সব কিছু বন্ধ করে ঢাকা গমন। বিএসএমএমইউর লাইব্রেরি আমাকে কখনোই হতাশ করেনি। আমি টানা দুইমাস লেগে থাকলাম। সাথে ছিলো বন্ধু জাকির, আমাকে সেই একটা ব্রেক থ্রু দিলো। অনেক কিছুই বুঝি না, জানি না। কিভাবে কিভাবে যেন পাস করে গেলাম। পাস করার পর আমার মনে হলো আরে আমিও তো পারি। কোত্থেকে যে এত কনফিডেন্স আসলো কে জানে, ফেইজ বী তে আবার চট্টগ্রাম এসে শুরু হলো আমার মেডিসিন শেখা। সত্যি বলতে কি, তখন থেকেই একটু একটু ভালোবাসা। এরপর সারাদিনই ওয়ার্ডে থাকতাম, আমি নাইট ডিউতে পারত পক্ষে ঘুমাতাম না, ডিউটি রুমের লম্বা চেয়ার হেলান দিয়ে শুয়ে থাকতাম ক্রিটিক্যাল পেশান্ট আসলেই দৌঁড়। ইন্টার্নদের সাথে আমার ভীষন জমে গেলো, ওদের পড়াতে পড়াতেই আমিও শিখতাম নতুন নতুন বিষয়। সুযত পাল স্যারের অতিমাত্রায় আদর আমাকে কনফিডেন্সের তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলো। একের পর এক পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশ, থিসিস এর কাজ সময় কোথায়?

এরপর থিসিস উত্রে গেলাম। দিন যায় এক্সাম দেই, চট্টগ্রাম ছেড়ে সিলেট। এর মধ্যে কোভিড। ঢাকা - চট্টগ্রাম - সিলেট - নোয়াখালীর চেম্বার। এই চক্রে সপ্তাহ কিভাবে যায় আমিও জানি না। এক বার, দুইবার, ফেইল আর ফেইল!ভেবেছিলাম হয়তো আর পারবো না, এখন আর পরীক্ষার আগে স্বপ্নও দেখি না, সব কিছু কেমন যেন। কনফিডেন্স লেভেল জিরো। এনশাদ স্যার এর সাথে মাঝে মাঝে কথা হতো। ভাবা যায় উনি আমার সাথে ফোনে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলেছেন বেশ কয়েকবার। একজন শিক্ষক তার একজন ছাত্রের জন্য এমন করতে পারেন আমার জানা ছিলো না। আমার কোভিডের সময়ও চট্টগ্রাম মেডিকেল আমাকে সেই সাপোর্টটাই দিয়েছিলো যা আমি কোনদিন ভুলবোনা।

তারপর ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করলাম। ফেইস বুক বন্ধ। মিশুর বাসায় গিয়ে দরজা বন্ধ করে একটা কঠিন পড়া দিলাম, ২৪ ঘন্টা খাও দাও পড়ো। ফেল যখন করলাম নূর বিশ্বাসই করতে পারলো না। এরপর যখন পরাণকে রুমমেট হিসেবে পেলাম ভাবলাম হয়তো কপালে ভালো কিছু আছে। অপর্ণা ফোন দিয়ে শুধু বলতো অনেক পড়া হয়েছে, ওয়েট ফর দ্যা পাস। কিছুদিন পর সোলায়মান ভাই আসলেন রুমে। তারপর সুদিন। এক্সাম দিয়ে ঠিক করলাম এই শেষ আর এক্সাম দেবো না, আসলে শরীরেরও একটা ক্লান্তি আসে, তাই না?

অবশেষে পাস হলো, আমি, সুদিন, পরান, সোলায়মান ভাই, রনি ভাই, সবাই উত্রে গেলাম, একসাথে চলার যাত্রাটা অবশেষে সফল হলো। ফাইনাল প্রফে মেডিসিনে সাপ্লি খেয়ে ঈশ্বরের অশেষ কৃপায় মহাকাব্যিক এম. ডি ( ইন্টারনাল মেডিসিন) পাস হলো। ধৈর্য্য আর ঈশ্বররের কৃপা থাকলে কি না হয়?

এই দীর্ঘ পথ চলায় যারা সাথে ছিলেন সবাইকে আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। এত এত মানুষের নাম লিখে শেষ করা সম্ভব না, আমার পরিবার চিরকালই অনেক বড়! ফেইসবুকে থ্যাংকস গিভিং আমার পছন্দ নয়, আমি কল করেই সবাইকে সুংবাদটা জানানোর পক্ষে। আর ফেইসবুকের এই পোস্টটা শুধুই আমার ফেইসবুকে ফিরে আসার একটা বার্তা।

আশীর্বাদ চাই, এগুতে চাই অনেক দূর। সবার জন্য শুভ কামনা।

#শুরুর_গল্প

একটা চাবির রিং এর ছবি জুড়ে দিলাম। কোন এক রিপ্রেজেন্টেটিভ ২০১৮  সালে অতি উৎসাহী হয়ে আমাকে এটা গিফট করেছিলেন। আমি লজ্জায় পড়ে গিয়েছিলাম, নীরবে লুকিয়ে ফেলেছিলাম চাবির রিং, কিচ্ছু বলতে পারিনি শুধু জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলেছিলাম আমি তো পাসই করিনি। তিনি বলেছিলেন, অবশ্যই পাস করবেন। গত চারবছর আগলে রেখেছিলাম, পরীক্ষার পর তাকিয়ে দেখতাম আর চাবির রিং টায় হাত বুলাতাম। আজ আর এটা পোস্ট করতে কোন বাঁধা নেই। যিনি গিফট করেছেন তার প্রতি কৃতজ্ঞতা।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়