ডেস্ক

Published:
2021-10-17 20:11:36 BdST

মর্মান্তিক "জীবনের শেষ লেখায় মেধাবী চিকিৎসক লিখে গেছেন 'হাজার হাজার পড়া বাকী', 'সব মিথ্যা, All are lie"


 

ডেস্ক
_________________

জানুয়ারিতে এফসিপিএস এ বসার কথা ছিল। তারপর মর্মান্তিক মৃত্যু। এক নবীন মেধাবী চিকিৎসকের অকাল প্রয়াণে চিকিৎসক মহলে তোলপাড় ও গভীর শোক ছায়া।
কেন এই অকাল প্রয়াণ!!
চিকিৎসক ও জনস্বার্থ কর্মী ডা সাদিয়া কবির ফেসবুকে এক লেখায় বিষন্নতা ভরা এক লেখা লিখেছেন।

ডা সাদিয়া কবির লিখেছেন,
একটা ছেলে গতকাল রাতে সুইসাইড করেছে। সিলেট মেডিকেল কলেজের ছাত্র। জানুয়ারিতে এফসিপিএস এ বসার কথা ছিল। সুইসাইড নোটে সে লিখে গেছে 'হাজার হাজার পড়া বাকী', 'সব মিথ্যা, All are lie'। আমি জানি এই অবধি পড়ার পর পর-ই আপনারা শুরু হয়ে গেছেন ভাবতে যে 'বেশি বেশি ঢং, ডাক্তারি আর মানুষ পড়ে না' বা কেউ কেউ বলছেন 'পারবি না তো পড়তে গেলি কেন?'.... জ্বি এই আপনাদের মত মানুষগুলোর জন্যই আসলে সুইসাইডটাকে অনেকের কাছে সহজ সমাধান মনে হয়।

আজকে আমি আমার মেডিকেল জীবনের গল্প লিখবো। সারাজীবন প্রথম সারির ছাত্রী ছিলাম। মেধাতালিকায় থেকেই আমি চান্স পেয়েছিলাম দেশের প্রথম সারির একটি সরকারি মেডিকেলে। মেডিকেলের বইপত্র কিনে আনা মাত্রই তা খুলে আমি আমার সমস্ত ইন্টারেস্ট হারিয়ে ফেলি। শুধু মনে হয়েছিল এই পড়া আমার জন্য না। যাহোক, গেলাম হোস্টেলে। বাড়ির বড় মেয়ে,অতি আহ্লাদী, হোমসিক , হোস্টেলের জঘন্য খাবার, গনরুম তারুপর শুধু গানের মত মুখস্ত করে হড়বড় করে উগড়ে দেয়া পড়াশুনা - আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি পুরোপুরি। প্রতিটি দিন আমার মনে হত যন্ত্রণা। রোজ দিন গুনতাম কবে শেষ হবে। আমি বরাবরই মুখস্থ বিদ্যায় ভীষণ দুর্বল। আমি বুঝলে সেটা নিজের মত বলতে পারি কিন্তু গড়গড় করে মুখস্থ করে তা আবার গড়গড় করে বলে পাশ করা আমার পক্ষে নিতান্ত অসম্ভব ছিল। দূর্ভাগ্যবশত হুবুহু সংজ্ঞা বা কারণ, লক্ষণ সবগুলো টানা না বললে প্রায় ক্ষেত্রেই টিচাররা সন্তুষ্ট হতেন না। এই না পারার ডিপ্রেশনের দুষ্টচক্রে পড়ে আমি দিন দিন আরও খারাপ অবস্থায় যেতে থাকি। ফিফথ ইয়ারের আগে অবধি একমাত্র ফিজিওলজি, প্যাথোলজি আর ফার্মাকোলজি ছাড়া আমার আর কিচ্ছু পড়তে ভালো লাগতো না। যেহেতু আমি খুব ভালো ডেলিভারি দিতে পারতাম না তাই আমার বন্ধু সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। ভালো ছাত্রী না বলে তেমন কেউ খুব আগ্রহ করে মিশতো না উলটো নানান বাঁশ টাশ দিতো, হাসাহাসি করতো, খোঁচাও দিতো। ফোর্থ ইয়ারের শেষে এসে আমার পড়াশুনার প্রদীপ নিভতে নিভতে প্রায় নিভেই যাওয়ার ঠিক আগে একবার দপ করে জ্বলে ওঠে কমিউনিটি মেডিসিনের বিল্লাহ স্যারের আবর্তে। কীভাবে কীভাবে যেন আমি স্যারের নানান কাজের সাথে জড়িয়ে গেলাম। লিটারেচার খোঁজা, রিভিউ করা, নতুন নতুন এবস্ট্রাকট পড়া, ডেটা এক্সট্রাক্ট করা, কখনো কখনো রাইট আপ, আর প্রতিনিয়ত স্যারের অনুপ্রেরণা - জীবনে কিছুটা গতি দিলো। তখন মনে হত যে না বোধ হয় এই যাত্রায় টিকে যাবো। ইন্টার্নশিপের সময় স্যারের কাছেই বেসিক রিসার্চ মেথোডোলজি আর বায়োস্ট্যাটিস্টিক্সের একটা বেসিক কোর্স করার সময় দেখি আরেহ, এতো পড়াশুনা না বরং এ আরেক স্বর্গ, আমি তো এর খোঁজেই ছিলাম। এর পরপর-ই সিদ্ধান্ত নেই এই জীবনে যা করবো এই সাব্জেক্টেই। তখনও অবশ্য আমার ব্যাচমেটরা অনেকেই আমাকে নিয়ে মজা করতো, হাসাহাসি করতো, পেছনে পেছনে টিটকারি দিতো, আরও কত কী!! আমার এখনো মনে পড়ে খুব ভালো ছাত্রী না বলে আমার সাথে বোনস কিনে তা আবার ক্যান্সেল করেছিল আমারই এক ব্যাচমেট। আমার সাথে রুমে কে থাকবে, থাকলে পড়া হবে না এ অবধি আমি শুনেছি। যাক সেসব সোনালী অতীত। এসব অতীত মনে পড়লে একদিকে হাসি পায় আরেকদিকে এও মনে হয় সারাজীবন এমনকি মাস্টার্সেও বৃত্তি নিয়ে পড়া আমি শুধুমাত্র দুলাইন গড়গড়িয়ে বলতে না পারায় কত কি সয়েছি। হায় রে আইটেম, হায় রে ভাইভা, হায় রে ডেফিনিশন.....

তবে কি দিন সবার সমান যায় না। প্রতিনিয়ত বাজে ছাত্রীর তকমা পেয়েও আমি জানতাম আমি আসলে বাজে ছাত্রী নই। ব্যাচমেটদের তাচ্ছিল্যের পরেও আমি বিশ্বাস করতাম আমি একদিন উঠে দাঁড়াবো। আজকে আল্লাহর ইচ্ছায় আমার ক্ষুদ্র জীবনে এমবিবিএস এর পর আমি বলার মত অনেক কিছুই পেয়েছি। আমার এমফিল, এমপিএইচ দুটোই প্রায় শেষের পথে। এক্টায় আবার ছোটোখাটো এওয়ার্ড পাওয়ার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি আমি সামনে আরও অনেকটা পথ হাঁটবো যদি আল্লাহ আমার তাকদীরে তা রাখেন। জীবনে কিছু করতে পারবো কিনা এই নিয়ে সন্দেহ করা অনেকেই আজকাল দেখি চাকরি বাকরির জন্য সাহায্য চায়, কেউ কেউ বেশ গর্ব করে, বাহবা দেয়, মুখস্থ বলতে পারতাম না যে স্যারদের সামনে তাদের দুই একজন গর্ব করে বলেন 'আমার ছাত্রী' তবে হ্যাঁ কেউ কেউ এখনো হাসে, মুখ বেঁকিয়ে বলে ডাক্তার হয়ে এসব কি কাজ করে বেড়ায়। রোগী দেখে না, বিসিএস দেয় না। ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে কি আমার এই লেখাটা আসলে এই আপনাদের জন্যই। মানুষকে তুচ্ছ করার আগে একবার হলেও ভাবুন যাকে তুচ্ছ করছেন তাকে কেন তুচ্ছ করছেন? অথবা আপনি যাকে পড়াশুনা, ক্যারিয়ার বা জীবন নিয়ে এত তুচ্ছ করছেন এমনকি হতে পারেনা সেই মানুষটার হাতে এগুলো কোনোটাই নেই।সব প্রেশার সবাই নিতে পারেনা। সব পড়া, সব ক্যারিয়ার সবার জন্যেও না। তাই যে একটু পিছিয়ে পড়ছে তাকে সারাক্ষন পিছিয়ে পড়া নিয়ে কথা না শুনিয়ে বরং তাকে নতুন পথ খুঁজতে সাহায্য করুন। এমনতো হতেও পারে সেই পথটাই হয়ত শুধু তার জন্যে স্রষ্টা সৃষ্টি করেছেন।

"যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখো
পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন.....!! "

 

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়