Dr. Tarik Ony

Published:
2021-08-22 15:07:08 BdST

চক্র :লাইফ এজ সার্জিক্যাল রেজিস্ট্রার


 

 

ডা. তারিক অনি
রেজিস্ট্রার, সার্জারী
রকহ্যাম্পটন হসপিটাল, কুইন্সল্যান্ড অস্ট্রেলিয়া
____________________

আমাদের এক রোগীর হাঁটুর নীচ থেকে পা কেটে ফেলতে হয়েছে। জীবন রক্ষার্থে, পা পচে গিয়েছিল। সাধারণভাবে এসব রোগী আমরা একদিন পর ই ডিসচার্জ করে দেই, ড্রেসিং এরা নার্সিং ক্লিনিকে করে। পরবর্তীতে রিহ্যাব সেন্টারে এ যায়, কৃত্রিম পা সংযোজিত হয়।

অপারেশনের পর রোগীর একটা মাইনর হার্ট এটাক হল। কার্ডিওলজি টীম রোগীর হার্টে রিং পরাবে, এনজিওগ্রাম করবে এসব তোড়জোড় শুরু করলো।

সমস্যা শুরু এখানেই। আমরা বললাম, হার্ট এটাকের রোগী, সার্জারীর আর কিছুই করার নেই, সব ট্রীটমেন্ট তো এখন তোমাদের, প্লিজ তোমরা কার্ডিওলজী টীম রোগীটি টেক ওভার( সবরকম দ্বায়িত্বভার গ্রহণ) কর। তারা আর সেটা করেনা !

পরবর্তী দুদিন রোগীর সবরকম হার্টের চিকিতসা চললো শুধু টেক ওভার হলো না। রোগী সিসিইউ তে চলে গেল, শুধু রয়ে গেল সার্জারীর আন্ডারে, ওদিকে কার্ডিওলজী কনসাল্ট করে যাচ্ছে প্রতিদিন। আমার সার্জারীর কনসালটেন্ট বিরস বদনে অসহায়ের মত আমার দিকে তাকালো। কারণ হার্টের রোগী সার্জারীর কনসালটেন্টের আন্ডারে বসে আছে! বারবার অনুরোধ করার পর ও তারা গা করেনা। তাদের বেশি কিছু বলাও যায় না, তারা কার্ডিওলজী, সবজান্তা এলিট শ্রেণী।

প্রসঙ্গত বলে রাখি, “গলার স্বর উঁচু করা যাবে না” , এইরকম পলিসির কারণে এই দেশে সব শয়তানিগুলো হাসিমুখে হয়। দেশে হলে ঝাড়ি দেওয়া যায়, এখানে আবার গলার স্বর একটু রুক্ষ হলেই সমস্যা !

আমি কার্ডিওলজী রেজিস্ট্রার( মেয়ে) কে ফোন দিয়ে ভদ্র গলায় বললাম, “দেখো বইন, রোগীর হার্টের সমস্যা, তোমরা প্লিজ টেক ওভার কর। আমাদের এই রোগী নিয়ে আর কিছু করার নেই। ওর পা এর চিকিতসা শেষ অনেক আগেই! ” বইন আমার চেয়ে পলিটিক্যাল। কার্ডিওলজির রেজিস্ট্রার হয়ে আমাকে বুঝিয়ে ফেলল যে কেন হার্টের রোগী আসলে সার্জারীর আন্ডারেই থাকা উচিত!

আমি মনে মনে ভাগ্যকে দুটা গালি দিলাম। এমনিতেই অনকলের রেজিস্ট্রার হয়ে আছি প্যারার উপর। তার উপর এসব উটকো ঝামেলা কার ভালো লাগে। ওদিকে রোগীর একগাদা হার্টের ঔষধপত্র-পরীক্ষাপাতি শুরু হল। টেস্ট যা করে সব ই হার্টের পরীক্ষা। তাদের কিছু কিছু পরীক্ষা ৬ ঘন্টা পর পর করতে হয়, সেটা দেখে আবার ড্রাগ এডজাস্ট করতে হয়! দিনের বেলা আমার ইন্টার্ণ -রেসিডেন্ট কে সে কামলা খাটায়, আফ্টার আওয়ারে আমাকে কল দেয়। রীতিমত অত্যাচার। কিন্তু ওই যে পলিসি, সুন্দর শান্ত গলায় বলি টেক ওভার কর, সে করেনা!

১৯৭২ সালে পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তির পর ইংল্যান্ডগামী বিমানে বঙ্গবন্ধু ইন্দোনেশিয় সাংবাদিকের সাথে কার্ড খেলায় জিতেছিলেন। ওই সাংবাদিক এর আগে চুরি করে খেলছিল, বাকিদের হারিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু বুদ্ধিমান বঙ্গবন্ধু খেলতে এসেই তাদের সাথে জিতে যান। এপ্রসঙ্গে পরবর্তীতে প্রশ্ন করা হলে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “যখন তুমি ভালো মানুষের সাথে খেলবে তখন ভালো মানুষের মত খেলবে। তবে তুমি যদি বদমাশের সাথে খেল, তবে তোমাকে তার চেয়েও বড় বদমাশ হতে হবে।”

আমি বুঝলাম অস্ট্রেলিয়ার শয়তানের সাথে খাঁটি বাঙালি বদমায়েশি না করলে হবেনা। আমি নতুন তরিকা ধরলাম। ফাইলে লিখলাম, রোগীর “পা সংক্রান্ত” যেকোন সমস্যায় সার্জারী কে ফোন করতে, “বুকে ব্যাথা সংক্রান্ত” সব সমস্যার জন্য কার্ডিওলজী কে ফোন করতে। আমি আমার ইন্টার্ণ রেসিডেন্ট কেও তাই শিখিয়ে দিলাম।

কাজ হল। ওয়ার্ড থেকে নার্স ফোন দেয়, রোগীর ক্যানুলা লাগবে।
- ক্যানুলা দিয়ে কি হার্টের মেডিসিন দিবে নাকি সার্জারীর মেডিসিন?
- হার্টের মেডিসিন।
- প্লিজ কল কার্ডিওলজী রেজিস্ট্রার

রোগীর ব্লাড রেজাল্ট এসেছে। ড্রাগ এডজাস্ট করতে হবে।
- কি টেস্ট ? ও এপিটিটি? ওসব হার্টের টেস্ট। আমরা এসব বুঝিনা, প্লিজ কল কার্ডিওলজী টীম।

রোগীর আবার বুকে ব্যথা করছে …
- অবশ্যই কল কার্ডওলজী!

রোগীর পেপারওয়ার্ক লাগবে…
- কল কার্ডিওলজী …

রোগীর অপারেশনের পা ও ব্যাথা করছে!
- আপাতত প্যারাসিটামল দাও। পোস্ট-অপারেটিভ পেইন, গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। কাল-পরশু দেখবো !

গত তিনদিন তোমরা(সার্জারী টীম) রোগী দেখোনি, কোন নোট ও লিখ নাই…
- আমাদের আর কোন প্ল্যান নাই। দু সপ্তাহ পর সেলাই কাটতে জিপির কাছে গেলেই হবে। বাই দ্য ওয়ে, কল কার্ডিওলজী …

কিন্তু রোগী তো তোমাদের আন্ডারে…
- ও আচ্ছা। থাকুক তাহলে। পাবলিক সীট, সমস্যা কি ?

চতুর্থদিন কার্ডিওলজী রেজিস্ট্রার নিজেই কল করলো,
- তারিক, তোমাদের রোগীটিকে গতকাল আমরা টেক ওভার করেছি, তুমি কি এক লাইন ডকুমেন্ট করবে যে সার্জারীর আর কোন কাজ নেই ?
- কে বলেছে কাজ নেই !! অলরেডী তার রিহ্যাব ফেজ শুরু হয়ে গেছে। আমি রিহ্যাব রেজিস্ট্রারকে বলেছি হাসপাতালে রেখে ব্যয়াম করাতে …. ওদের রিহ্যাব করাতে মোটামুটি সপ্তাহখানেক লাগে জানো তো… তুমি ওদের সাথে কথা বল, তোমরা দুজন মিলে পরবর্তী প্ল্যান ঠিক কর …. ( মিষ্টি করে হাসলাম)

আমি নিশ্চিত কার্ডিওলজী রেজিষ্ট্রার আমাকে মনে মনে খাঁটি তিনটা গালি দিয়েছে। কারণ রিহ্যাব মেডিসিন এক বিভীষিকার নাম। তারা ধীর গতির, রিহ্যাব দ্রুত হয়না, অনেক সময় লাগে। তাদের কাছে দুই-চার সপ্তাহ কোন ব্যাপার ই না। তাদের রাউন্ড/ টেক ওভার হয় ই সপ্তাহের মাত্র এক দিন। কোন রোগী রিহ্যাবে ঢোকা মানে রীতিমত মাসখানেকের ধাক্কা। কার্ডিওলজী এখন এই রোগী নিয়ে আটকে যাবে রিহ্যাবের ফাঁদে !! রিহ্যাব দ্রুত টেক ওভার করার আগেও রোগী এক-দুই সপ্তাহ তাদের ঘাড়ে এমনিতেই বসে থাকবে।

মনে মনে ভাবছিলাম “Karma is a bitch”. আপাতত কার্ডিওলজী তার দুষ্টুমির ফল পাচ্ছে, আমি আনন্দ পাচ্ছি! তবে আমি নিশ্চিত পাকেচক্রে এই রোগী আবার কোন ও না কোনভাবে একদিন ঠিকই আমার ঘাড়ে এসে পড়বে ! এ এক চক্র ….

লাইফ এজ সার্জিক্যাল রেজিস্ট্রার।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়