Dr. Aminul Islam

Published:
2021-07-07 16:26:20 BdST

বিশ্লেষণ সহস্রাধিক চিকিৎসক বদলি: এগুলো কি নিছক পেশাদারিত্বের অভাব না অন্য কিছু!


 

অধ্যাপক ডা. মওদুদ আলমগীর পাভেল
_________________________

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গতকাল বিকেলের এক আদেশে সহস্রাধিক শিক্ষক চিকিৎসককে এই করেনাকালে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে সংযুক্তি বা পদায়ন করা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এটা কল্যানকর মনে হতেই পারে কিন্তু একটু গভীরে গেলেই এতে আমাদের প্রশাসনের অন্তঃসারশূন্যতা ছাড়া আর কিছুই দেখা যাবে না। অনেক ভেবেও কারন বুঝতে পারনি, এগুলো কি নিছক পেশাদারিত্বের অভাব না অন্য কিছু!

- হতে পারে দেশের সকল অফিস আদালত যখন কঠিন বিধিনিষেধে/ লক ডাউনে বা শাট ডাউনে বন্ধ তখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের অফিস করতে হচ্ছে, যখন অন্যুরা এই বৃষ্টিতে বাসায় শুয়ে বসে খিচুড়ি বেগুন ভাজা খাচ্ছেন, এই রাগে।

- হতে পারে পরিমনির ইস্যু যখন প্রায় থিতিয়ে এসেছে তখন একটা চটকদার কিছু উপহার দেবার ইচ্ছে থেকে।

- হতে পারে গৃহবন্দী মানুষদের বাড়তি কিছু বিনোদন দেবার জন্য।

- এমনকি সাতকানিয়ার জসীম কান্ডের পাল্টা শক্তি প্রদর্শনও হতে পারে।

কারন যাই হোক কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেছে ঃ-
- একযোগে এতজন চিকিৎসকের পদায়ন /সংযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কোন যেন তেন আমলার কাজ নয়। ফলে এটা উচ্চতর পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের শোচনীয় পেশাদারিত্বহীনতার পরিচয়।

- চলমান লকডাউন/ বিধিনিষেধের ধারাগুলো তারা প্রনয়ণ/ স্বাক্ষর করেছেন কিন্তু পড়ে দেখেননি। তারা চিকিৎসকদের ৭ জুলাই তাৎক্ষণিক অবমুক্তির কঠিন নির্দেশনা দিয়েছেন কিন্তু সকল গন পরিবহন বন্ধ অবস্থায় একজন মানুষ নতুন কর্মস্থলে কি ভাবে যাবেন তা ভেবে দেখেন নি। কি ভয়াবহ মেধাহীনতা, ভাবা যায়।

- তারা একবারও ভাবেন নি যে হাসপাতালের এতগুলো চিকিৎসককে প্রত্যাহার করলে সেই হাসপাতাল চলবে কি করে, সহানুভূতি জানিয়ে গায়ের জামা দান করলে পুরুষের ইজ্জত কিছুটা টিকে থাকে কিন্তু প্যান্ট- অন্তর্বাসের দিকে হাত বাড়ালে পরিস্থিতি কি দাড়ায় সে ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন।
- সবার সামনে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে তাঁরা ব্রজলাল কলেজ আর মেডিকেল কলেজের পার্থক্য জানেন না। ওনাদের ধারনা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন, সার্জারী, গাইনী, চক্ষু, নাক-কান-গলা বিভাগের অধ্যাপকরা সপ্তাহে একদিন চক-ডাস্টার নিয়ে ক্লাসে ঢুকে একঘন্টার বক্তৃতা দিয়ে সারা মাসের বেতন নেন। আর এখন তো হরিলাল কলেজ বন্ধ তাহলে বাছাধন নাটোর, চাপাই,ফেনী, কুড়িগ্রাম হাসপাতালে গিয়ে করোনার চিকিৎসা দাও। ঐসব মহাজ্ঞানীরা এটাও জানেন যে ঐসব বিষয়ের শিক্ষকদের অফিস কক্ষটিও যুগ যুগ ধরে হাসপাতালের ভেতরই, কলেজে তাদের বসার জায়গা অব্দি নেই, তা না হলে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের সেবা সংক্রান্ত বিষয়ের শিক্ষক চিকিৎসককে কি ভাবে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সংযুক্তির আদেশ জারি হতে পারে ?
-এরা জানেন না, এনাটমি, ফিজিওলজি, ফার্মাকোলজির শিক্ষকরা ইন্টার্নি শীপের পর এক ঘন্টার জন্যও হাসপাতালে পদায়িত হন না। এই করোনাকালে প্রায় প্রতিদিনই অন লাইনে ক্লাস নেন, নিয়মিত পরীক্ষা নেন,এছাড়াও এখন দেশের সকল মেডিকেল কলেজে বেসিক সায়েন্সের শিক্ষকদের রয়েছে চরম সংকট। এরা চিকিৎসা সেবা কার্যক্রমের সাথে মোটেও জড়িত নন। যদি এমন দূর্যোগ সময় আসে তাহলে অধ্যক্ষরাই তাদের সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে সংযুক্ত করতে পারবেন এরজন্য আবদুল গনি রোডের আদেশের প্রয়োজন হবে না।
- মৃত চিকিৎসকদের প্রতি এরা কতটা নির্মম তার প্রমান এই আদেশ, ডা.জীবেশ আর ডা. শামীম গত বছর করোনায় মৃত্যু বরন করেছেন, এ আদেশ তাদেরও পরিত্রাণ দেয়নি। করোনা যোদ্ধা মৃত চিকিৎসকদের তালিকাও তাদের নথিতে নেই। ভেবে দেখুন আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কতটা অন্তঃসারশূন্য, কতটা অসম্মান তাঁরা ঔ চিকিৎসক পরিবার আর তাদের প্রিয়জনকে করেছেন, তাঁরা ভাবতেই পারবেন না। মাননীয় আমলা,একবার নিজেকে ঐ জায়গায় দাঁড় করিয়ে চিন্তা করুন।
- এরা জানেনা, পিসিআর ল্যাব কারা পরিচালনা করেন,এরা জানেনা ওয়ার্ডে করেনা চিকিৎসার সাথে কারা জড়িত, এরা জানেনা করোনা রোগীর ল্যাবরেটরী পরীক্ষা কাদের করতে হয়, এরা জানেনা করোনা রোগীর সিটি স্ক্যান রিপোর্ট কাদের দায়িত্বে, অথচ এরাই আঠারো কোটি মানুষের স্বাস্থ্যের মন্ত্রনালয় চালান, নইলে কোভিড হাসপাতালে মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে পিসিআর রিপোর্ট করা মাইক্রোবায়োলজির শিক্ষক এই তালিকা থেকে বাদ যান না, বাদ যান না করেনা চিকিৎসায় দিন রাত একাকার করা মেডিসিনের শিক্ষক বা প্যাথলজির শিক্ষক কিম্বা সিটি স্ক্যানের রিপোর্ট করা রেডিওলজির শিক্ষকরাও এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন। ওরা এটাও জানেনা যে,সার্জারী -গাইনীর চিকিৎসকরা করেনাকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও করেনা আক্রান্ত রোগীর পাশাপাশি অন্য রোগীদের সেবা দিয়ে একই সাথে কোভিড আর নন কোভিড হাসপাতাল সচল রেখেছেন।
- জানা মতে চিকিৎসক স্বল্পতায় ভোগা সদর হাসপাতালে তত্ত্বাবধায়করা চিকিৎসক নার্স সংকটের সমাধান চেয়েছিলেন, যাতে চব্বিশ ঘন্টার রোস্টার ডিউটির কোয়ারান্টাইন জনিত ঘাটতি পূরন হয়। এনাটমি ফিজিওলজি বা নাক কান গলার অধ্যাপক তাঁরা চান নি ।
- আর কত বলবো, আমরা জানি এটাই আমাদের আমলাতান্ত্রের বেস্ট পারফর্মেন্স, আমাদের সয়ে গেছে। কিন্তু ধরা যাক, এউ আদেশের প্রেক্ষিতে বিবিসি, সিএনএন না হয় বাদ দিলাম কিন্তু হিন্দুস্তান টাউমস বা আনন্দবাজার একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তাহলে সবার সামনে এদেশের প্রশাসন, করোনা চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নিয়ে কি ধারণা হবে!
- বাইরের কথা বাদ দিলাম, দেশে দুচারজন বর্তমান বা প্রাক্তন আমলা যাঁরা নিয়মের টুকটাক জানেন তাঁরা তাদের এইসব অর্বাচীন সহকর্মীদের জন্য কতটা বিব্রত হবেন, সেটা ভেবে আমাদের খারাপ লাগতেই পারে।
কিন্তু ভয়টা সেখানেই, যখন করোনার এই দুঃসময়ে মেধা আর পেশাদারীত্বের সর্বোত্তম উৎকর্ষতা প্রয়োজন তখন এধরণের আদেশ জন মানুষকে কতটা ভীত করতে পারে ধারণা করতে ভয় হয়।

আমরা জানি এসব কথায় কিছুই আসবে যাবে না, এদেশের আমলাতান্ত্রিক ধরন আর শক্তি আমাদের অজানা নয়, এরা ছাগলের যেমন জরিমানা করতে পারে তেমনি কর্ম স্থলে যাওয়া চিকিৎসকও এদের কাছে ছাড় পায় না, বিএসএমএমইউ এর পরিচয়পত্র দেখালে এরা ঢাকা মেডিকেলের পরিচয় পত্র দেখতে চায়।
এরা নিজেদের জনগনের সেবক দাবী করেন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে এক লহমায় সহস্রাধিক চিকিৎসক নিয়ে ছেলে খেলা করে করোনা আর নন করেনা চিকিৎসা তছনছ করার ভয়ংকর আদেশকে জনস্বার্থ বলে চালিয়ে দেন কিন্তু সৎসাহস নিয়ে জনগন আর গণমাধ্যমের সামনে আসতে ভয় পান।
এই দুঃখের মধ্যে একটা পুরনো গল্প মনে পরলো, আমার এক বন্ধুর বাবা আমার বন্ধুকে তাজা মাছ কি ভাবে চিনতে হয় সেই তালিম দিতে গিয়ে, কানকো লাল কি না দেখতে বলে বিপদে পড়েছিলেন, আমার বন্ধু বাজারে গিয়ে জীবন্ত শিং মাছের কানকো দেখতে গিয়ে কোন বিপদে পরেছিল সেটা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। এদেশের আমলাতন্ত্রের অবস্থা আমার সেই বন্ধুর চাইতেও খারাপ।এতদিন শুনেছি " লেজে গোবরে"- কল্পনায় গোবর মাখা গরুর পশ্চাৎদেশ দেখতে পেতাম। এখন আবার সেই দৃশ্য কল্পনা করতে চাই না, যদি গরুর লেজে গোবরের জায়গায় মানুষের " মুখে গোবরে কল্পনা করতে হয়। আল্লাহ মাফ করুন, তেমন কিছু যেন না হয়।

দেশের করোনাকালে সকল সীমাবদ্ধতা মেনে চিকিৎসকরা যখন জীবন বাজী রেখে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তাদের আত্মমর্যাদা আর মনোবলকে বার বার আঘাত করার এই চেষ্টা নেয়াহেতই কি কাকতালীয়?

অসঙ্গতির কথা বলে আদেশ স্থগিত করেছেন, প্রত্যাহার করেন নি। আপনারা এমনই, প্রচন্ড ইগো সমস্যায় কাতর।আপনারা অন্যায়কে অসংগতি বলেন, অজ্ঞানতায় এতটুকুও বিব্রত হন না। গত দেড় বছরে আপনারা যতগুলো মর্মান্তিক বিনোদন দিয়েছেন তাতে আগামীতে আপনারা এর চাইতেও নিম্ন রুচির বিনোদন নিয়ে যে হাজির হবেন সে ভবিষ্যতবাণীর জন্য রকেট সায়েন্স জানতে হয় না।

-

অধ্যাপক মওদুদ আলমগীর পাভেল
অধ্যাপক (সার্জারী), টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ, বগুড়া
প্রাক্তন অধ্যক্ষ
শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ, বগুড়া এবং দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ, দিনাজপুর; এবং
সাবেক সভাপতি, সোসাইটি অব সার্জনস অব বাংলাদেশ।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়