ডা. রাজীব দে সরকার
Published:2021-06-24 14:15:37 BdST
হাসপাতালের ইন্টার্নী চিকিৎসক আর মিড লেভেল চিকিৎসকদের নিয়ে কিঞ্চিৎ কল্পকাহিনি ও বাস্তবতা
ডা. রাজীব দে সরকার
____________________
(১)
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ইমারজেন্সী এন্ট্রান্সের সামনে এসে থামলো সাকিব ব্রোর গাড়ি।
চোখ ধাঁধানো নীল রঙের Rolls-Royce গাড়িটা সাকিব ব্রো নিজেই চালায়।
হাসপাতালের সামনে একটা ছোট্ট জটলা। সেটা দেখে সাকিব ব্রো গাড়িটা মেডিকেল কলেজের পার্কিং এর দিকে নিয়ে গেলো।
গাড়ি থেকে নেমেই ওর মনে পড়লো, ৩ তলার কেবিন ব্লকের রোগীদের ফলো-আপ দিতে হবে। সাকিব ব্রো এই হাসপাতালের একজন ইন্টার্নী চিকিৎসক। অবশ্য অতি সম্প্রতি বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ, ঘোলাটে এবং দুঃসাহসিক কাজটাও ব্রো সেরে ফেলেছেন।
রোলস রয়েসটা পার্কিং করে ম্যুভিং ওয়াক-ওয়েতে দাঁড়ালো সাকিব ব্রো। কয়েক মুহুর্তে পরেই সে কেবিন ব্লকের সামনে এসে হাজির। কেবিনের সামনে দাঁড়াতেই সাকিবের রেটিনা স্ক্যান শেষে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রোগীর কেবিনের দরজা খুলে গেলো।
কাল রাতে পিত্ত-নালীর অপারেশন হয়েছে রোগীর। অপারেশন করেছেন ইউনিট চীফ প্রফেসর ডাঃ এ. এ. শুভ স্যার।
তিনি অবশ্য এখন দেশে নেই। গত ১৫ দিন ধরেই কানাডার চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দিতে ওদেশে গেছেন। সেখানে বসেই Advanced Da Vinci Robotics এ কাল রাতে এই অপারেশনটা করেছেন তিনি।
প্রতি রাতেই এমন ৪/৫টি অপারেশন হয়ে যাচ্ছে। এ কারনে কোনদিনই সাকিব ব্রো রাত ৯ টার আগে ঘুমাতে যেতে পারে না।
রোগী ব্যাগ গোছাচ্ছেন। এই সকাল বেলাই তিনি চলে যাবেন (মাত্র কয়েক ঘন্টা আগেই যার একটা মেজর সার্জারী হলো!)।
সাকিব ফলো-আপ দিয়ে বেরিয়ে এলো।
সাকিব ব্রো ম্যুভিং ওয়াকওয়ে ঠেঙিয়ে ওর রুমে এসে নরম চেয়ারটায় গা এলিয়ে দিলো। ওর ব্রেকফাস্ট দিয়ে গেছে ডেপুটি চীফ অব স্টাফ মিসেস ময়নার পাঠানো বট-ড্রোন। ৭ ধরনের ফুড আইটেম আর দু ধরণের ড্রিঙ্কস। ইন্টার্নীদের জন্য এর বেশী আইটেম পাঠানো মানা আছে।
সাকিব ব্রেকফাস্ট শেষ করে সিএ ভাইয়ার জন্য ওয়েট করছে।
এই কেবিন-জোন এর সিএ হিসেবে আছেন ডাঃ বি.টি.এস. সাদিক। ডাঃ সাদিক এর আন্ডারে আছেন ৬ জন রোগী। এই ৬ জন রোগীর বাইরে আর কোন রোগীর দায়িত্ব তার না।
পার্কিং এরিয়াতে ড্রাইভ করে ঢুকলেন ডাঃ সাদিক। এসেই দেখলেন তার Tesla Plaid Model S -টা পার্ক করার আর কোন জায়গা নেই।
শেষ স্লটে সাকিবের রোলস রয়েস, ডাঃ লামিয়ার ্ল্যামবোরগিনি আর ডাঃ ফাইয়াজ ব্রো-এর কালো রঙের বুগাট্টি পার্ক করা।
পার্ক-ম্যান রেজাউল এর হাতে গাড়িটা ছেড়ে কিছুটা মন খারাপ করেই ডাঃ সাদিক তার রুমে ঢুকলেন।
তার রুমটা বেশ বড়। নীল কাচে ঘেরা একটা হল রুমের মতো চেম্বার তার। রুমে ছোট ছোট বাল্ব দিয়ে করা রঙধনুর সব রঙের এম্বিয়েন্স।
রুমের শেষটায় একটা টেবিলে ২৫ আইটেম ব্রেক ফাস্ট সার্ভ করা। রুমে ঢুকেই মনটা ভালো হয়ে গেলো ডাঃ সাদিকের।
*
(২)
হাসপাতালের ইন্টার্নী চিকিৎসক আর মিড লেভেল চিকিৎসকদের নিয়ে যে গল্পটা বললাম, তা 'রূপকথা' ছাড়া আর কিছুই না।
কিন্তু মজা হলো, অনেকেই আমাদের এই সব জুনিয়র চিকিৎসকদের জীবন নিয়ে এরকম না হলেও এর কাছাকাছি কোন রূপকথাই ভেবে রাখেন।
জুনিয়র চিকিৎসকদের জীবন বাংলাদেশের সারা জীবনই 'দুর্বিসহ' ছিলো এবং 'দুর্বিসহ'ই আছে।
- জাতি জানে না, আমার অনেক ইন্টার্নী কাজের চাপে সকালের ব্রেকফাস্টটা পর্যন্ত করতে পারে না। করতে পারলেও সেটা 'ঠিক সময়ে' কখনোই না।
- রাত ৯টায় ঘুমিয়ে যেতে পারে, এমন ইন্টার্নী আজ অবধি বাংলাদেশে জন্মেছে কী না, আমি জানিনা। সকাল বেলা ডিউটি করে একই তালে বিরতীহীন ইভিনিং ডিউটি, অথবা, সারা রাত জেগে নাইট ডিউটি করে আবার মর্নিং রোগীর ফলোয়াপ আর রাউন্ড; সব শেষ করে তবেই বিশ্রাম মেলে।
- ইন্টার্নী সিএ-রা এই দেশের কোন হাসপাতালে moving walkway দিয়ে হাঁটে না। অপরিকল্পিত হাসপাতাল ভবনগুলোতে নিজেদের ইউনিটে ভর্তি রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া, কোন প্রসিডিউর করা, রাউন্ড দেওয়া, ফলোআপ দেওয়া, ব্লাড ট্রান্সফিউশন দেওয়া সহ আরো হাজারটা প্রয়োজনে ইন্টার্নী চিকিৎসকদের অনেক গুলো তলা দিনের মধ্যে অনেকবার ওঠানামা করতে হয়।
- সব রোগীদের প্রয়োজন এক না, সব রোগের প্রতিক্রিয়া এক না, সব রোগী একই সময়ে শারীরিক কষ্টে ভোগেন না - তাই আমাদের এই বিভিন্ন তলায় তলায় বার বার ছোটাছুটি বন্ধ হয় না। চোখের সামনে ইন্টার্নীর সময়ে 'পৃথুল' সাকিব ব্রোদের টেলি সামাদ হয়ে যেতে দেখেছি।
- অনেক হাসপাতালে ডাক্তারদের এই কর্মব্যস্ত দিন শেষে খাবার মতো ভালো একটা ক্যান্টিনও নেই। তাতে অবশ্য কারো কিছু এসে যায় বলে মনে হয় না।
- একজন ইন্টার্নী চিকিৎসককে আমরা যতো জন রোগীর দায়িত্ব দেই, অথবা একজন সিএ কে যতোগুলো ওয়ার্ডের দায়িত্ব দেওয়া হয়, সেটা কতোখানি মানবিক, বাস্তবসম্মত ও আদতে কতোখানি রোগীবান্ধব, তা আমরা ভেবে দেখার প্রয়োজন কি এখনো হয় নি?
প্রশ্নগুলো তোলা থাক...
একটা 'আক্ষেপ' দিয়ে শেষ করি।
এমবিবিএস এর মতো কঠোর অধ্যাবসায় এর একটা গ্রাজুয়েশন শেষ করে ১ বছর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্টার্নীশিপ করে যে দক্ষ জনসম্পদ আমরা রাষ্ট্রকে গড়ে দিলাম, ইন্টার্নী শেষ করার পরের দিন রাষ্ট্র তাদের কি দিলো?
>> হতাশা। কর্মহীনতা। অর্থনৈতিক অসহায়ত্ব।
হাইলি স্কিলড একজন ইন্টার্নী চিকিৎসককে একটা সম্মানজনক বেতনে একটা নিশ্চিত ভালো চাকরী দিয়ে আমরা কি তার থেকে আরো ভালো সেবা সমাজের জন্য নিতে পারতাম না?
একজন ইন্টার্নী শেষ করা স্কিলড চিকিৎসক বেকার বসে থাকলে দিন শেষে ক্ষতিটা যে রাষ্ট্রের হয়, সেটা আমরা বুঝি না কেন?
অভিমানী মুখগুলো আকাশে উড়াল দিয়ে অন্যদেশে গিয়ে একটা আলোকিত জীবনের সন্ধান কি পায় না? তবে দেশে 'নয়' কেন?
"একজন জুনিয়র চিকিৎসকের জন্য একটি হতাশাহীন কর্মচঞ্চল মসৃণ স্বচ্ছল জীবন" এই ''রূপকথাটা'' এই দেশে কি কোনদিন সত্যি হবে না?
-
ডাঃ রাজীব দে সরকার
রেজিস্ট্রার
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক,
৩৩ বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন (কেন্দ্রীয় কমিটি)
ইমেইলঃ [email protected]
আপনার মতামত দিন: