ডেস্ক

Published:
2021-04-21 17:27:46 BdST

" এই সময়টাতে অনেক চিকিৎসকের মত আমারও মানসিক চাপ বাড়ছে"


ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল 

রক্ত রোগ বিশেষজ্ঞ 

প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী 

---------------------------------------------

করোনাকালীন এই সময়টাতে অনেক চিকিৎসকের মত আমারও মানসিক চাপ বাড়ছে৷ আশংকাজনকভাবে বাড়ছে।

নিজে আক্রান্ত হবার ভয়, পরিবারের সদস্যরা আক্রান্ত হতে পারে সেই ভয়, আক্রান্ত হলে চিকিৎসা পাবো কিনা, আদৌ সিট পাব কিনা, আক্রান্ত হলে মরেও যেতে পারি ইত্যাদি নানারকম ভয়।

গত একবছরে পরিচিত, ঘনিষ্টবন্ধু, নিকটজন, এমনকি পরিবারের সদস্য মারা গেছেন। সেই বেদনার চাপ তো আছেই। সংক্রমন ও মৃতের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অনেকেই নিয়ম মানছেন না। এর সবই মানসিক চাপ বাড়াচ্ছে।

এর সাথে যুক্ত হয়েছে কর্তৃপক্ষের নানারকম অসংবেদনশীল আচরণ ও সিদ্ধান্ত। রাষ্ট্রের উর্ধতন পর্যায় থেকে কোনরকম ন্যুনতম সহানুভুতিসম্পন্ন অভিবাদন না পাওয়া স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে আমাদের এই মানসিক চাপ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। চিকিৎসা বিষয়ে নেটিজেনদের তীর্যক মন্তব্য, হাসপাতাল অব্যবস্থাপনা নিয়ে ডাক্তারদের ইংগিত করে কথা বলা এসবও আছে।

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা যেখানে চিকিৎসকদের হয়রানি করা হচ্ছে সেসব ঘটনাও মনকে আরো বেশি ভারাক্রান্ত করেছে। বাড়তি সম্মান আমরা চাইনি। অন্তত পথে ঘাটে আমাদের নির্বিঘ্নে যেতে দিলেও মনটা ভাল থাকে।

এলিফ্যান্ট রোড কান্ডে যে ম্যডাম পালটা ধমক দিয়েছেন, গালাগাল করেছেন, তিনি করেছেন তার ব্যক্তিগত ক্ষ্মতার দাপটে। তাঁর পরিবারে মন্ত্রী আছে। নিজেও অনেক কিছু। এলেবেলে লোক তো আর বিএসএমএমইউতে চাকরি করেনা। কিন্তু আমি তো এলেবেলে লোক। আমার চৌদ্দগুষ্টিতে কোন পাওয়ার ফুল লোক নেই। আমার কি হবে?

সমস্যা হলো আমার তো যেহেতু এসব ক্ষমতার একটিও নাই। যেকোন দিন পথ আটকে আমাকেও দুটো তীর্যক কথা শুনিয়ে দিতে পারে পুলিশ। অশুদ্ধ উচ্চারণে বলতে পারে আপনার মুভমেন্ট পাস কই? আপনি কি আসলে ডাক্তার? নাকি নীলক্ষেত থেকে আইডি কার্ড নিজে বানাইছেন? আপনার মত কত শাহেদ দেখলাম!

গত বছর চেম্বারে যাবার পথে এমন করে বলেছিল " এই প্যানডেমিকে ডাক্তারদের প্রায়ভেট প্র‍্যাক্টিসেও যাওয়া লাগে"!! উত্তর কি দিয়েছি তার চেয়ে বড় কথা এই যে বলেছে এটাই তো আমাকে আহত করবার জন্য যথেষ্ট। অথচ আমিই ছিলাম আমার সেই হাসপাতালের একমাত্র ডাক্তার যে প্যানডেমিকের পিক টাইমেও অফিসের পর প্রতিদিন চেম্বার করেছে। এমনকি জুনিয়র ডাক্তাররা প্রয়োজনে কল করলে সাথে সাথে গিয়ে ট্রায়াজেও পেশেন্ট দেখে সিদ্ধান্ত দিয়েছি।

লকডাউনে শয়ে শয়ে রোগী আসেনা। তবু চেম্বারে বসে থেকেছি যেন এই দুঃসময়ে কেউ এটুকু বলতে না পারে যে "সুদিনে তো খুব ছিলেন। আজ দুর্দিন বলে আমাদের ছেড়ে পালিয়েছেন৷" হ্যাঁ আমারও মৃত্যু হতে পারতো। মনের এই বিপরীতমুখী দ্বন্দ্বের কারণে আমি মানসিকভাবে তখন দুঃসময় পার করেছি। সেটি এখনো বহাল আছে।

অর্থাৎ সার্বিক পরিস্থিতিতে অনেকের মত আমারও মানসিক স্বাস্থ্য ভাল নেই। দেখতেই পাচ্ছেন প্রতিদিনই অনেক রাত অব্দি জেগে থাকি। আমি তো কালে ভদ্রে রাত জাগতাম। মূলত ঘুম কাতুরে ছিলাম। কিন্তু এখন উলটো। ঘুম আসেনা!

এরকম সময়ে মানসিক চাপ কমাতে আমি যেটা করি লেখালেখি, গানবাজনা, বই পড়া - বাড়িয়ে দেই। কিন্তু এবার এসবেও কাজ হচ্ছেনা। বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, জ্বর জ্বর লাগা এসব উপসর্গ লেগেই আছে। আদতে এগুলোর সবই মানসিক চাপ জনিত।

তাই কিছুদিন হলো মানসিক চাপ কমানোর ওষুধ ধরেছি। গতবারও এরকম সময়ে কিছুদিন এ জাতীয় ওষুধ খেয়েছিলাম। উপকারও পেয়েছি। তবে উল্লেখ করা দরকার যে এর আগে কখনই খাইনি বা খাওয়ার দরকার পড়েনি।

আমি নন কোভিড হাসপাতালে চাকরি করি। তার উপর বিশাষায়িত কাজ করি। সেখানে মাঝে মাঝে কোভিড পজিটিভ রোগী পাই। যারা কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে কাজ করছেন, সারাক্ষণ এই যুদ্ধে লড়ছেন তাদের কি অবস্থা একবার ভাবুন?

সমাজের কোথাও কোন সহানুভুতি, সংবেদনশীলতার চিহ্ন নেই। একবছরের উপর হয়ে গেল, সমাজের অন্য পেশাজীবিরা প্রনোদনা পেয়েছে, শুধু ডাক্তাররা পায়নি। অর্থ আমার চাই বা না চাই, এই চিত্র দেখে মনের মধ্যে এই সংবাদটি পৌছেছে যে " হে ডাক্তার গুলজার, রাষ্ট্র তোমাদের কি চোখে দেখে, বুঝছ?

এরকম পরিস্থিতিতে রাস্তাঘাটে পুলিশ আর ম্যজিস্টেট অসংবেদনশীল ভংগিতে দায়িত্বপালনের নাম করে কোন ডাক্তারের দিকে অবজ্ঞা ছুড়ে দিলে মেজাজ ঠিক থাকেনা। আমি জানিনা কাল আমাকেও এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয় কিনা।

আপনারা সবাই ভাল থাকুন। লকডাউন উপভোগ করুন। জাজমেন্ট উপভোগ করুন। সবকিছুতে অপিনিওন দিন। ফেসবুকে লিখে প্রচুর লাইক ও দোজাহানের অশেষ নেকি কামাই করুন। এই প্রত্যাশা রেখে আজ এখানেই শেষ করছি।

দোয়া করবেন আমার জন্য। দোয়া করবেন যেন ইনসমনিয়া থেকে শীঘ্রই মুক্তি পাই। আপনারাও ভাল থাকুন।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়