Ameen Qudir

Published:
2017-02-02 16:20:36 BdST

‘ওঁকে নারী হতে দিন ডাক্তার সাব, ওঁর কষ্ট সহ্য করতে পারছি না : স্ত্রী-সন্তানের আকুতি





সোমা মুখোপাধ্যায়

_____________________


পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স। সাদামাঠা চেহারা। বাংলাদেশের পাবনা থেকে আসা ভদ্রলোক যখন জানিয়েছিলেন, পুরুষ জীবনের খোলস ছেড়ে তিনি নারী হতে চান, বেশ একটু চমকে যান এসএসকেএমের ডাক্তাররা। ভদ্রলোক বিবাহিত। ১৮ ও ১৭ বছরের দুই ছেলের পিতা। এমন ঘোরতর সংসারী, মধ্যবয়সী পুরুষের ওই প্রস্তাবে তাঁরা সাহায্য করতে পারবেন না বলেই জানিয়েছিলেন।

কিন্তু আরিফুল ইসলাম (নাম পরিবর্তিত) দমেননি। কিছু দিন পরেই ফের হাজির। এ বার সঙ্গে স্ত্রী ও দুই সন্তান। তাঁদেরও আকুতি, ‘‘যে ভাবে হোক, অস্ত্রোপচারটা করুন। প্রতি মূহূর্তে ওঁর কষ্টটা আমরা আর সহ্য করতে পারছি না।’’ শুধু মুখে বলা নয়, একেবারে লিখিত আবেদন। আরিফুল নিজে আশ্বাস দিলেন, লিঙ্গ পরিবর্তনের পরেও তিনি ওই বাড়িতেই থাকবেন। স্ত্রী-ছেলেদের দায়িত্ব অস্বীকার করবেন না।

প্রথমে এন্ডোক্রিনোলজি এবং সাইকিয়াট্রি বিভাগের ডাক্তাররা দেখলেন। হরমোনের নানা পরীক্ষা হল। মনোবিদেরা বোঝার চেষ্টা করলেন, আরিফুলের অস্তিত্বের সঙ্কটটা ঠিক কোন জায়গায়।

লিঙ্গ পরিবর্তন হলে সেই সঙ্কট কতটা কাটবে। সবুজ সঙ্কেত এলে শুরু হল ওষুধ দেওয়া। তাতে শারীরিক কিছু পরিবর্তনের সূত্রপাত হল। পোশাকেও বদল আনা হল পরীক্ষামূলক ভাবে। সব ক’টি ধাপ পেরিয়ে আসার পরে সপ্তাহ দুয়েক আগে অস্ত্রোপচার হয়েছে আরিফুলের। মেডিক্যাল বোর্ডে ছিলেন ফরেন্সিক মেডিসিন-এর বিশ্বনাথ কাহালি, এন্ডোক্রিনোলজির সুজয় ঘোষ, ইউরোলজির সন্দীপ গুপ্ত, সাইকিয়াট্রির পার্থসারথি বিশ্বাস এবং প্লাস্টিক সার্জারির বিজয় মজুমদার ও অরিন্দম সরকার।

অরিন্দমবাবু বলেন, ‘‘ঘটনাটা সব অর্থেই ‘ইউনিক’। সাধারণত আরও কমবয়সীরা এমন অস্ত্রোপচারের জন্য আসেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা বিবাহিত নন। স্ত্রী এবং ছেলেরা এসে অনুরোধ করছেন, এটা ভাবা যায় না।’’

নতুন শরীর নিয়ে আরিফুল এখন কলকাতাতেই। দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু মধ্যজীবনে এসে লিঙ্গ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত কেন? মনোবিদদের মতে, বেশির ভাগ সময়েই বয়ঃসন্ধির কাছাকাছি পৌঁছেই বোঝা যায়, নিজের যৌন অস্তিত্ব নিয়ে কেউ স্বচ্ছন্দ কি না। যদি অস্বাচ্ছন্দ্যের বোধ আসেও, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ তাই নিয়েই বাঁচে। বিয়ে-সন্তান নিয়ে জড়িয়ে পড়ে। মনোবিদ অনিরুদ্ধ দেবের কথায়, ‘‘কিন্তু সব দায়িত্ব মিটিয়ে কোনও এক দিন কারও মনে হতেই পারে, এটা তাঁর আসল জীবন নয়। আবার কারও আচমকাও উপলব্ধি হতে পারে। তবে দু’টি ক্ষেত্রেই মানসিক টানাপড়েন মারাত্মক।’’


আরিফুল জানাচ্ছেন, তিনিও কম বয়সেই বুঝতে পেরেছিলেন তিনি আর পাঁচ জন ছেলের মতো নন। বাড়িতে বলার চেষ্টাও
করেছিলেন। কিন্তু মারধর করে তাঁর মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কয়েক বছর পরে বিয়েও হয়। আরিফুল বিবাহিত জীবনে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করেন। ছেলেদের বাবা হন। কিন্তু অস্বস্তিটা থেকেই গিয়েছিল। পরে একদিন স্ত্রীকে খুলে বলেন সব।

পাবনার আধাশহর এলাকায় বাড়ি। আরিফুলের একটা কাপড়ের দোকান আছে। স্ত্রী স্কুলের গণ্ডি পেরোননি। প্রথমটা স্বামীর কথা বুঝতেও পারেননি। কিন্তু ধীরে ধীরে কথা বলতে বলতে বিষয়টা অনেকটা পরিষ্কার হয় তাঁর কাছে।

অনেকটা যেন নবনীতা দেবসেনের ‘বাপ রে বাপ’ গল্পের মতো। ১৯৮১ সালে সে গল্পে স্ত্রীর মতামত নিয়েই তিন সন্তানের পিতা লিঙ্গ পরিবর্তন করিয়ে এসেছিলেন। কী ভাবে তাঁর কর্মক্ষেত্র, পরিবার ক্রমশ তাঁকে তাঁর মতো করেই গ্রহণ করে, তারই বর্ণনা আছে গল্পটিতে। নবনীতা বলেন, ‘‘১৯৭২ সালে নারী হয়েছিলেন জঁ মরিস নামে ইংল্যান্ডের এক ভ্রমণ-লেখক। তাঁরও স্ত্রী, সন্তান ছিল। আমি মরিসের সঙ্গে দেখা করেছিলাম।’’ মরিসকে মরক্কো যেতে হয়েছিল। কারণ ব্রিটেনে ডাক্তাররা বলেছিলেন, ডিভোর্স না করলে হবে না।

বাংলাদেশেও ডাক্তারদের একাংশ রাজি হননি আরিফুলের ব্যাপারে এগোতে। সেই সঙ্গে বিপুল খরচের বোঝাও ছিল। তাই আরিফুলের কলকাতায় আসা। বহু ঝড়-ঝাপটা পেরিয়ে যে কলকাতায় ২০০৩ সালেই পুরুষ থেকে নারী হয়েছিলেন সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। এখন তিনি মানবী। একটি কলেজের অধ্যক্ষ। বললেন, ‘‘মিথ্যার সঙ্গে বসবাস করাটাকেই অনেকে মানিয়ে নেয়। ওই ভদ্রলোক যে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন, পরিবার যে তাঁর পাশে রয়েছে, এটা জেনে ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে, লড়াইটা ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে।’’

লড়াইয়ের বিস্তার সত্যিই বোঝা গিয়েছে আরিফুলের স্ত্রী-ছেলেদের সঙ্গে কথা বলে। আরিফুলের স্ত্রী খুব ভাল করে জানেন, তাঁর নিজের জীবনটা পাল্টে যাবে একেবারে। এবং সেটা মসৃণ নয়। তবু তিনি বলছেন, ‘‘যে যে ভাবে থাকতে চায়, তাকে সে ভাবেই থাকতে দেওয়া উচিত।’’ একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়া দুই ভাই বলছে, ‘‘এর পরে বাবাকে আর বাবা বলে ডাকা যাবে না। বাইরের সমাজে লাঞ্ছনা সহ্য করতে হবে। তবু জেনেবুঝেই আমরা এটা করছি।’’ আরিফুলও জানেন, আত্মীয়-প্রতিবেশীদের থেকে আগেও বড় ধরনের প্রতিরোধ তৈরি হয়েছিল। পরেও হয়তো হবে। ‘‘যখন মেয়েদের পোশাক পরা শুরু করি, তখন রাস্তায় মারধর খেতে হয়েছিল। কিন্তু দমিনি।’’

কিন্তু এই প্রৌঢ় বয়সে নারী হয়ে কি তিনি নতুন করে জীবন শুরু করতে পারবেন? আরিফুল বললেন, স্বাভাবিক ছন্দে যদি প্রেম আসে তো আসবে। না এলেও ক্ষতি নেই। কারণ, আরিফুল যা চেয়েছিলেন পেয়েছেন। নতুন শরীরে মানিয়ে নিতে সময় লাগবে। কেমন লাগছে? আরিফুলের উত্তর, ‘‘খুব শান্তি পেলাম।’’

______________________

লেখক সোমা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা ।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়