Dr. Aminul Islam

Published:
2020-10-24 00:01:05 BdST

" সোনার হরিণ "মেরে ফেলার ওষুধ


ডাঃ সুকুমার সুর রায়

____________________________



 মেরে ফেলার ওষুধ ।

অবশেষে সুফিয়া বেগম তার স্বামীর সাথে ডাক্তারের কাছে আসতে রাজি হয়েছেন।
ডাক্তারের কাছে এসেছেন বটে, কিন্তু কোন কথাই তিনি বলছেন না।
ডাক্তারের কোন প্রশ্নেরই তিনি জবাব দিচ্ছেন না, স্বামী বেচারা নানাভাবে তাকে বলছেন তার সকল শারীরিক সমস্যা , মানসিক সমস্যা ডাক্তারের কাছে অনুপুঙ্খ তুলে ধরার জন্য, কিন্তু সুফিয়া বেগম নির্বাক, নিরুত্তর।
ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছেন যেন কোন এক সুদুর অতীতের দিকে! বর্তমানের কোন কিছুই তাকে স্পর্শ করছে না। ভবিষ্যতের কোন স্বপ্ন সাধের বিন্দুমাত্রও অবশিষ্ট নাই তার চোখের তারায়। মনের গভীরে কীএক ভয়ানক ব্যাথায় বাকরুদ্ধ হয়ে আছেন পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী একজন গৃহিণী', একজন মা' 'সুফিয়া বেগম'।
অনেক পিড়াপিড়ি করেও সুফিয়া বেগমের মুখ থেকে একটি কথাও বের করা গেলো না।
পঞ্চাশ বছর বয়স্ক হারুন মিয়াঁ , সুফিয়া বেগমের স্বামী- বলতে শুরু করলেন - "বেশ কিছুদিন হল সুফিয়া বলছেন তার বুক ধড়ফড় করে, বুকের ভিতর চাপ ধরে আসে, রাত্রে একদম ঘুম হয় না, কিছুই ভাল লাগে না, সংসারের সকল কাজকর্ম থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন, চুপচাপ বসে থাকেন, নিরবে চোখের জল ফেলেন, আর ফ্যাল ফ্যাল করে উদাসভাবে তাকিয়ে থাকেন।"
"কতদিন থেকে এই লক্ষন গুলো দেখা যাচ্ছে?" - ডাক্তার জানতে চান, এর কারনই বা কি!
সুফিয়া বেগম এই পর্যায়ে ক্ষীন কন্ঠে বলে ওঠেন - " মাইর‍্যা ফ্যালানোর ওষুধ নাই?"....
ডাক্তার বুঝতে পারেন, সুফিয়া বেগম মারাত্মক বিষণ্ণতা রোগে আক্রান্ত, তারই বহিঃপ্রকাশ - মৃত্যুচিন্তা!
বাড়াবাড়ি রকমের বিষণ্ণতায় আক্রান্ত মানুষেরা আত্মহননের পথ পর্যন্ত বেছে নেয়। তারা ডাক্তারের কাছে এসে মরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে, বেঁচে থাকার সুনির্দিষ্ট কোন কারন তাদের অবশিষ্ট থাকে না, তাই তারা ডাক্তারের কাছে মরনের ওষুধ চায় -।
এই ব্যাপার গুলো ডাক্তারের জানা এবং এধরনের কথা শুনতে ডাক্তারেরা সাধারণত অভ্যস্ত।
তাই সুফিয়া বেগমের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে ডাক্তার তার স্বামী হারুন মিয়াঁর দিকে মনোযোগী হন এবং পারিবারিক ইতিহাস জানতে চান, আর সঠিক রোগ নির্নয় ও চিকিৎসার জন্য পারিবারিক ইতিহাস জানাটা অপরিহার্য।
হারুন মিয়ার ছিল সুখের সংসার,। শহরের বাজারে তার একটি চালু কাপড়ের দোকান ছিল, শহরের উপকন্ঠে ছোট্ট একটা ছিমছাম আধা পাকা বাড়ি, বাড়ির লাগোয়া কয়েক বিঘা ফসলী জমি, গরু, ছাগল, হাঁস মুরগি ও ছিল তার। পর পর তিনজন সোনার টুকরা পুত্র সন্তান আসে তাদের সংসারে। একটা কন্যা সন্তানের অভাব বোধ ছিল তাদের মনে। তা সত্বেও তারা সুখি ছিলেন, সুখি ছিলেন এই ভেবে যে, পুত্র সন্তানেরা বড় হবে, মানুষ হবে, তাদের কে বিয়ে দিয়ে পুত্রবধু নয়,'- মেয়ে' নিয়ে আসবেন সংসারে।
তাদের এই সুখি, সচ্ছল সংসারে, সুফিয়া বেগম দিন রাত পরিশ্রম করে গেছেন ভবিষ্যতের আরো সচ্ছলতার আশায়, তিনটি ছেলেকে মানুষ করবেন, নাতিপুতির মুখ দেখবেন। খুব বড় কিছু নয়, -সুফিয়া বেগম আশা করতেন - বড় ছেলেটা বাপের দোকানে, বাপের সাথে ব্যবসা করবে, মেঝছেলে পড়া শুনায় মন নাই , ও জমিজমা গরু বাছুর দেখাশুনা করবে, আর ছোট ছেলেটা লেখাপড়া শেষ করে ছোটখাট চাকরি বাকরি করবে, - এই টুকুই চাওয়া -বেশি কিছু নয়।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস --
হারুন মিয়াঁ আজ সর্বস্বান্ত। - নিঃস্ব!
তার দোকান গেছে, গরু ছাগল গেছে, জমিজমাও শেষ। একমাত্র বাড়ির ভিটাটুকু অবশিষ্ট আছে, তাও বন্ধক রাখতে হয়েছে।
এখন হারুন মিয়াঁ নিজের জান নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, নিজের প্রাণপ্রিয় সন্তানদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে এখানে সেখানে লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন!
তিন তিনটি পুত্র সন্তানের গর্ভধারিণী ' মা' তার সোনাধারি ছেলেদের অমানুষিক নির্যাতন - অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন।
হারুন মিয়াঁ ও সুফিয়া বেগমের তিনটি ছেলেই ভয়াবহ রকমের মাদকাসক্ত। গাঁজা 'থেকে শুরু করে হেরোইন', সব ধরনের নেশায় আসক্ত তারা।মাদকের জন্য মরিয়া তারা। মাদকের টাকার জোগার করতে এহেন অপকর্ম নাই যা তারা করে নাই। নেশা করতে করতে শারীরিক দিক দিয়ে কংকালসার, আর মানসিক দিক দিয়ে ভয়ংকর অমানুষ ও উম্মাদ হয়ে গেছে তারা।
একজন নয়, দুইজন নয়, তিন তিনটি সন্তানের সবার পরিণতি হয়েছে একই।
তাঁদের সুচিকিৎসার জন্য কি করেন নাই বাপ - মা!?
ডাক্তার দেখিয়েছেন, পর পর তিন জনকেই একাধিকবার রিহ্যাব সেন্টারে ভর্তি করে দিয়েছেন। জমি জিরাত, দোকানপাট, গরু ছাগল সবই শেষ করে দিয়েছেন, কিন্তু রিহ্যাব সেন্টার থেকে বের হয়ে কিছুদিন ভাল থাকার পর আবার যে কে সেই!
আবার টাকার চাহিদা বেড়েছে, টাকা না পেলে ভাংচুর শুরু হয়েছে, ছুরি নিয়ে জন্মদাতা বাপকে তাড়া করেছে, গর্ভধারিণী মায়ের গায়ে হাত তুলেছে, অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছে!
অবশেষে এলাকার গন্যমান্য ব্যাক্তি, জনপ্রতিনিধির সহায়তায় তিন ছেলেকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন হারুন মিয়াঁ ।
আশা ছিল সরকারের সহায়তায় সরকারি খরচে তার ছেলেরা ভাল হয়ে, সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরবে।
পুলিশে দেওয়ার একদিন পরেই গভীর রাতে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ এবং বড় ছেলের গলার আওয়াজ পেয়ে ভয়ে কুঁকড়ে যান হারুন মিয়াঁ ।
সারা রাত ভয়ে ভয়ে নিজের ঘরের দরজা খোলেননি তিনি।
ফজরের আজানের আগেই সন্তর্পনে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান হারুন মিয়াঁ।
গর্ভধারিণী মায়ের উপর আবারো নেমে আসে নির্যাতনের খর্গ।
বাড়ির বাইরে থাকতেই হারুন মিয়ার মোবাইলে ফোন আসে। অপর প্রান্ত থেকে দাবি করা হয় পনেরো হাজার টাকা। না, মাদকাসক্ত ছেলেদের দাবি নয়,- এ দাবি 'মানবাধিকার আইনজীবীর' দাবি।
তিনি মানবাধিকার এর সুস্পষ্ট লংঘন দেখেছেন! একই পরিবারের তিন তিনটি ছেলেকে হাজতে ঢোকানোতে গভীর ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়েছেন। তাই তিনি স্বপ্রনোদিত হয়ে বিজ্ঞ আদালতে লড়াই করে তিন ছেলের জামিনের ব্যবস্থা করেছেন।
এমন একটি মহৎ কাজের জন্য তিনি তার নায্য ' ফিস' দাবি করতেই পারেন!
এইবার যেন সুফিয়া বেগমের কন্ঠটি একটু স্পষ্ট শোনা গেল, তিনি ধীর অথচ স্পষ্ট কন্ঠে ডাক্তারের কানের কাছে উচ্চারন করলেন --
" অগোরে মাইর‍্যা ফ্যালানোর কোন ওষুধ নাই? "
ডাক্তারের ভুল ভাঙল! ' মা' মরতে চান নাই। তার কলিজার টুকরা তিন সন্তানকে মেরে ফেলে দেওয়ার জন্য ওষুধ চান তিনি!
কয়েকটি ওষুধ লিখে সুফিয়া বেগমকে বিদায় করলেন ডাক্তারবাবু।
ডাক্তারবাবু চেম্বারের বাইরে চলে এলেন। অঝোর ধারায় আষাঢ় মাসের বৃষ্টি হচ্ছে।
একটানা বৃষ্টির কান্নাতেই হোক, কিংবা সুফিয়া বেগমের গুমড়ে মরা বেদনার্ত হৃদয়ের সংস্পর্শেই হোক, ডাক্তার বাবুর হৃদয়তন্ত্রিতে মোচড় দিয়ে ওঠা কয়েকটি শব্দ বার বার অনুরনিত হতে থাকে --- " মাইর‍্যা ফ্যালানোর ওষুধ নাই? " - " মাইর‍্যা ফ্যালানোর ওষুধ নাই! ?"....

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়