SAHA ANTAR

Published:
2020-10-12 01:19:24 BdST

" সোনার হরিণ "একজন গুরুচরণ: হাসপাতাল সেবার হারিয়ে যাওয়া নায়ক





ডাঃ সুকুমার সুর রায়
-------------------------------------------------------
( বিংশতি - পর্ব)  গুরুচরণ।

_________________

গুরুচরণের ' সাথে প্রথম পরিচয় আজ থেকে সাতাশ বছর আগে।
যেদিন রাজশাহী থেকে বদলি হয়ে একদম অঁজ গ্রামের এই হাসপাতালে আবাসিক মেডিকেল অফিসার হিসাবে যোগাদান করি, সেদিন আমার এখানেই থেকে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
প্রথম সমস্যা দেখা দিল থাকবো কোথায়!?
হাসপাতালে ডাক্তারদের থাকার জন্য কোয়ার্টার আছে বটে কিন্তু সে কোয়ার্টারে
কেউ থাকে না।
বেশির ভাগ ডাক্তার নিকটবর্তী শহরে থাকেন।
যিনি প্রধান কর্মকর্তা তিনি কোয়ার্টারের একটি ফ্ল্যাট বরাদ্দ নিয়ে রেখেছেন, কিন্তু নিয়মিত অবস্থান করেন না।
আবাসিক মেডিকেল অফিসার হিসাবে আমি কোয়ার্টারেই থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম।
কিন্তু আজই কেমন করে সেখানে উঠবো!?
আমার না আছে ফার্নিচার, না আছে বেডিং, না আছে কোন কিছু।
বেলা দুইটা বাজে। হাসপাতালের অফিস ছুটি হয়ে গেছে। প্রধান কর্মকর্তাও চলে গেছেন।
সমস্যাটির কথা বলতেই হাসপাতালের ইনচার্জ সিস্টার নাজমা হাঁক ছাড়লেন --
--- " গুরুচরন, গুরুচরন --!
একজন মধ্যবয়সী মানুষ সিস্টারের রুমের
দরজার পাশে এসে দাঁড়ালো।
বেঁটে খাটো চেহারা, গায়ের রঙ শ্যামলা । বিনয়ী ভঙ্গিতে বলল -- " জ্বী আপা। "
নাজমা সিস্টার বললেন --" নতুন 'আরএমও' স্যার আজ এখানে থাকবেন। ডক্টর্স কোয়ার্টারে দোতলার একটা রুম পরিষ্কার করে গোজ গাজ করে দিয়ে এসো। "
" জ্বী আপা, আমি ঘরদোর পরিষ্কার কইর‍্যা আসি, আপনে ইস্টোর থেইক্যা নতুন চাদর বালিশ বাইর কইর‍্যা রাখেন। "
তার পর আমাকে উদ্দেশ্য করে গুরুচরন বলল -
" স্যার, আমি আগে সব ঠিক ঠাক করি, তারপর আপনে আইসেন । "
একথা বলে গুরুচরন চলে গেল।
আমি সিস্টারের সাথে কথা বলে নতুন হাসপাতালের খুঁটিনাটি জানার চেষ্টা করতে লাগলাম।
কিছুক্ষণ পর গুরুচরন এসে আমাকে সাথে নিয়ে রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে, বাথরুম, টয়লেট,কিচেন, দেখিয়ে দিয়ে, তালার চাবি আমার হাতে দিয়ে বিদায় নিতে চাইল।
তখনই আমার মনে হল ক্ষিধে লেগেছে, খাওয়া দরকার।
গুরুচরন কে জিজ্ঞাসা করলাম - আশে পাশে কোন খাবার হোটেল নাই?
গুরুচরন বলল -- " না স্যার, এখানে তো কোন খাওয়ার হট্যাল নাই। "
"তা হলে উপায় কি?"
"স্যার, উপায় আছে। রুপসীর মা ' নামে এক মহিলা আছে। বড় স্যার যখন এখানে থাকে, রুপসীর মা 'বড় স্যারের পাক সাক্ কইর‍্যা দেয় ।"
আমি বললাম --''সেতো বুঝলাম, বড় স্যারের হয়তো রান্নার সরঞ্জামাদি আছে, বাজার ঘাটের ব্যবস্থা আছে, সেখানে রুপসীর মা রান্না করে দেয়। আমার তো খালি হাত, খালি পা। আমার এখন উপায় কি? "
গুরুচরন বলল --" স্যার, কোন চিন্তা কইরেন না,আপনি হাত মুখ ধুইয়া ফেরেশ হন, আমি এখুনি আপনের খাওয়ার বেবস্থা কইরত্যাছি।"
একথা বলেই গুরুচরন চলে গেল।
জামাকাপড় ছেড়ে বাথরুমে কলের জল ছাড়তেই হলুদের গুড়ার মত দানা দানা জিনিষ বের হতে লাগল।
বুঝলাম অনেকদিন এসব ব্যবহার করা হয় নাই।
যাই হোক ফ্রেশ টেশ হয়ে কিছুক্ষণ জানালা
দিয়ে বাইরের পুকুরের দিকে উদাস তাকিয়ে থেকে পেটের ক্ষিধে ভুলে থাকার চেষ্টা করছি, ঠিক তখনই গুরুচরন দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো। পেছনে মধ্যবয়সী রুপসীর মা। দুই জনের হাতে গামলা ঢাকা খাবারদাবার।
গরম ভাত, সাথে আলুভর্তা ও ডিম ভাজা।
খেয়ে দেয়ে, গুরুচরনের পেতে দেয়া সরকারি খাটে, সরকারি চাদর ও বালিশে গা' এলিয়ে দিয়ে কখন যেন ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছি মনে পড়ে না।
এভাবেই গুরুচরনের সাথে প্রথম পরিচয়।
পরদিন সকালে হাসপাতালের ওয়ার্ডে রাউন্ডের সময় গুরুচরন কে দেখা গেলো এক গাদা ফাইল হাতে নিয়ে সিস্টারের সাথে সাথে ঘুরতে।
তখনো গুরুচরনের পদবি জানা হয় নাই।
মহিলা ওয়ার্ডে রাউন্ডের এক পর্যায়ে যখন সিস্টারের দৃষ্টি আকর্ষন করে বললাম --------- " টয়লেট থেকে দুর্গন্ধ আসছে! " তখনই সিস্টার -'রা' রা' করে উঠে গুরুচরন কে হুকুম করলেন - "শিগগীর টয়লেট পরিষ্কার কর।"
গুরুচরন ত্রস্তব্যস্ত হয়ে ফাইলের স্তুপ একজন রোগীর বেডে রেখেই দ্রুত গতিতে টয়লেটের দিকে ছুটে গেলো!
সিস্টারকে জিজ্ঞেস করলাম -- ''গুরুচরন -'ওয়ার্ড বয় ' নয়?"
নাজমা সিস্টার বললেন - " না, ওতো সুইপার। "
"তা হলে ওয়ার্ড বয়ের কাজ করছিলো যে!"
"ওয়ার্ডবয় যে আছে, তার ডিউটি বিকালে, তাই গুরুচরন এখন ওয়ার্ডবয়ের দায়িত্ব পালন করছে। "
'' ও, আচ্ছা, তাহলে গুরুচরন কি একাই সুইপার?
আর কোন সুইপার নাই?"
নাজমা বললেন - " জাত্ সুইপার গুরুচরন একাই।
আরো দুই সুইপার পোষ্টে লোক আছে, তবে তারা মুসলমান, ওরা টয়লেট পরিষ্কার করে না। আর দুইটা সুইপারের পোষ্ট খালি আছে।"
পরে অবশ্য সুইপারের পোষ্ট পুরন হয়েছিল,
ততদিনে 'সুইপার' পদবি পরিবর্তন হয়ে ' ক্লিনার ' বা ' পরিচ্ছন্নতা কর্মী ' হয়েছিলো।
সেই পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের কেউ জাত্ সুইপার ছিলো না।
ফলে টয়লেট পরিষ্কারের কাজ গুরুচরন কে একাই করতে হতো।
পরবর্তীতে আস্তে আস্তে গুরুচরন সম্পর্কে বিস্তারিত জানা হয়ে গেলো।
গুরুচরনের বাড়ি হাসপাতাল থেকে পাঁচ কিলোমিটার দুরবর্তী শহরতলীর 'ঋষি পাড়ায়।'
খুব ভোরে হাসপাতালের কোন স্টাফ বা অন্য কেউ যখন এসে পৌছায় নাই, সেই কাক ডাকা ভোরে গুরুচরন একটি ভাঙ্গা সাইকেল চালিয়ে হাসপাতালে উপস্থিত হতো।
উপস্থিত হয়েই তার কার্যক্রম শুরু করে দিতো। প্রথমেই সে টয়লেট পরিষ্কার করতো। তারপর ওয়ার্ড, অন্যান্য রুম, বারান্দা, ঝারু দিয়ে শেষ করে, হাসপাতালের আংগিনা ঝারু দিতে শুরু করতো।
ততক্ষনে হয়তো কেউ কেউ এসে পৌছাতো, সেই 'কেউ কেউ 'আবার গুরুচরন কে ধমক দিত -- " আরো সকালে আসতে পারো না? ধুলা উড়ছে! একটু পানি ছিটিয়ে নিলে ভাল হত না? "
গুরুচরন বিনা বাক্য ব্যয়ে টিউবওয়েল থেকে বালতি ভর্তি পানি নিয়ে এসে ছিটিয়ে দিতো।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ শেষ হলে গুরুচরন চট করে অফিসিয়াল ইউনিফর্ম পড়ে নিতো। তারপর অন্য কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তো।
প্রথমে তার উপরে হুকুম হতো -- " রোগিদের বেডে বেডে ব্রেকফাস্ট পৌছে দাও। "
এরপরের হুকুম -- " আরএমও ' স্যার রাউন্ড দিবেন, -বেডে বেডে ফাইল গুলি দিয়ে দাও। "
এসব করতে করতেই হয়তো জরুরি তলব এল -- " জরুরি বিভাগে ' বিষ খাওয়া ' রোগি এসেছে , গুরুচরন শিগগির চলে আসো। "
গুরুচরন বালতি, স্টমাক ওয়াশ টিউব, ইত্যাদি নিয়ে দ্রুত ছুটে যেতো 'বিষ খাওয়া' রোগির স্টমাক ওয়াশ দিতে।
কখনো বা একসাথে অনেক একসিডেন্টের রোগি চলে আসতো, গুরুচরন ছুটে যেতো জরুরি বিভাগের দিকে।
গুরুচরন হরিজন সম্প্রদায়ের নীঁচু জাতের মানুষ, কোন লেখা পড়া জানতো না।
তা হলে কি হবে! সে পরিনত হয়েছিল এই হাসপাতালের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে , একজন অতি প্রয়োজনীয় মানুষ হিসাবে।
তাকে ছাড়া হাসপাতাল সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার কথা কল্পনাও করা যেতো না।
সে নিজেও জানতো, বলার আগেই তাকে অনেক ধরনের কাজ করে ফেলতে হবে, না করলে কাজ জমে যাবে ; এবং শেষ পর্যন্ত তাকেই তা শেষ করতে হবে।
নিজের শিডিউল কাজের বাইরেও এমন কোন কাজ নেই যা সে করতো না।
সে মুলত সুইপার, কিন্তু ওয়ার্ডবয়, পিয়ন, মালি, সিকিউরিটি গার্ড, বাবুর্চি, কারো কাজ করতেই সে পিছপা হতো না। এমনকি চিকিৎসকের ছোট খাটো কাজও সে করে ফেলতো অবলীলাক্রমে, অবশ্যই প্রটোকল মেনে। কারো বিরুদ্ধে তার কোন অভিযোগ ছিলো না । উপরন্তু, সকল কাজ সে করতো সন্তুষ্ট চিত্তে,নিজ দায়িত্বে।
যেন এই হাসপাতাল তার কাছে মন্দির, হাসপাতালের কাজ করা তার কাছে উপাসনার মত!
ছোট খাটো সেলাই করা , ফোঁড়া কাটা, ব্যান্ডেজ করা, ড্রেসিং করা তার নৈমিত্তিক কাজ। কোন আগুনে পোড়া রোগীর দুর্গন্ধে যখন কেউ সেই বেডের কাছে যেতে চাইতো না,, তখন ওয়াশ করার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নিত গুরুচরন।
এভাবেই তার উপস্থিতিতে 'আরএমও' হিসেবে আমার নিজেরও একধরনের স্বস্তি বোধ হতো।
ধীরে ধীরে অন্যদের মত আমি নিজেও গুরুচরনের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়তে লাগলাম।
গুরুচরন কে একদন্ড না দেখলেই অস্বস্তি হতো! জিজ্ঞেস করতাম-"সে কোথায়?" তখন হয়তো সে বর্জ্য ফেলতে গেছে কিংবা ফাইল নিয়ে বড় স্যারের রুমে গিয়েছে।
হঠাৎ কখনো কখনো জরুরি সিজারিয়ান অপারেশন হতো। তখন গুরুচরনের দায়িত্ব পড়তো 'ওটি' রেডি করার, ওটি 'পরিষ্কার করার। শুধু কি তাই?
'ওটি 'তে এনেস্থেসিস্টের সহকারীর দায়িত্বও পালন করতে হত গুরুচরনকে।
এনেস্থিসিয়া মেশিনের নাটবল্টুর সমস্যা হচ্ছে ! -- --- কোন্ ফাঁকে গুরুচরন একটি রেঞ্জার হাতে নিয়ে তা ঠিকঠাক করে দিচ্ছে মুহুর্তে!
অক্সিজেন সিলিন্ডারের প্যাঁচ খুলছেনা!? শিগগির গুরুচরন কে ডাকো! , সব কিছু দ্রুত ব্যবস্থা হয়ে যাবে!
একদিন গভীর রাতে আমার দরজায় ঠক্ ঠক্ আওয়াজ শুনে বললাম-" কে.. ?"
গুরুচরন সভয়ে বলল -- " স্যার,, ইমার্জেন্সিত এক বৃদ্ধ রোগি আইছ্যে, পেশাব বন্দ হয়্যা খুব কষ্ট পাইত্যাছে, একটু ওঠেন স্যার। "
দেখলাম, আশি বছরের নুরানি চেহারার এক বৃদ্ধ মানুষ, তার পেট ফুলে ঢোল হয়ে আছে, দুইদিন হল এক ফোঁটা প্রস্রাব হয় নাই! জরুরি বিভাগের বেডে শুয়ে অসহ্য যন্ত্রনায় আল্লাহ্‌ আল্লাহ্‌ করে চিৎকার করে কাঁদছে।
জানলাম, দুই বছর আগে হজে যাওয়ার আগে তার প্রস্টেটের সমস্যা ধরা পড়েছে।
ডাক্তার অপারেশনের কথা বলেছিলেন, কিন্তু তা করা হয়ে ওঠে নাই। কষ্টেসৃষ্টে এতদিন প্রস্রাব করা চলছিলো, কিন্তু দুইদিন হলো প্রস্রাব একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে!
গুরুচরন কে জিজ্ঞেস করলাম - ''ক্যাথেটার করার চেষ্টা করা হয়েছে কিনা?" সে ঘাড় নেড়ে, হ্যাঁ' সূচক জবাব দিল, কিন্তু সফল হয় নাই তাও বললো।
আমি নিজে একবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম।
বিকল্প হিসাবে 'মেটালিক ক্যাথেটার 'দিয়ে চেষ্টা করা হলো। তাতে প্রস্রাবের বদলে রক্ত আসা শুরু হলো!
রোগীর লোকজনকে বললাম -" এখানে সম্ভব হচ্ছেনা, সদরে রেফার করবো।"
তখনই গুরুচরন আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস্ করে বলল --
" স্যার, অনেকদিন আগেনা একবার প্যাট ফুটা কইর‍্যা পেশাব বাইর কইর‍্যা দিছিল্যান!"
গুরুচরনের কথায় সম্বিৎ ফিরে পেলাম। 'সুপ্রাপিউবিক পাংকচারের ' কথা বলছে গুরুচরণ।
পঞ্চাশ সিসি সিরিঞ্জের মোটা সূঁচ তলপেট দিয়ে প্রস্রাবের থলিতে ঢুকিয়ে, সিরিঞ্জ দিয়ে টেনে টেনে প্রস্রাব বের করা শুরু হলো।
কিছুক্ষনের মধ্যে প্রস্রাব দিয়ে বড় দুইটি গামলা ভরে গেলো!
বৃদ্ধ হাজি সাহেব আরামে চোখ বন্ধ করে যেন ঘুমিয়ে পড়লেন! আমাদের কাজ শেষ হওয়ার পর টেবিল থেকে নেমে, তিনি হুড়মুড় করে গুরুচরন কে বুকে জড়িয়ে ধরে নানা রকম দোয়াদরুদ পড়ে আশির্বাদ করতে লাগলেন।
প্রতি ঈদের দিনে আমরা যারা ডিউটিরত থাকতাম তাদের জন্য খাবার রান্না করতো গুরুচরন। কোরবানির ঈদের দিন রান্না শেষ করেই বেলা এগারোটার দিকে গুরুচরন হাত কচলাতে কচলাতে অতি বিনয়ের সাথে ' দুই ঘন্টার ' জন্য ছুটি চাইতো। প্রথম প্রথম বুঝিনি, কি জন্য ওর ছুটির দরকার পড়তো।
পরে অন্যদের কাছে জেনেছি -- ' ওর জাত ব্যবসা '।
কোরবানির পশুর কিছু চামড়া ওর অল্প পুঁজি দিয়ে সংগ্রহ করে লবন মাখিয়ে রেখে আসতো।
এটাই ছিল চাকরির বাইরে ওর দুই পয়সা উপড়ি আয়।
একদিন গুরুচরনের বাড়িতে তার মেয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণ পাওয়া গেলো। হাসপাতালে কর্মরত সবাইকে নিমন্ত্রণ দিয়েছে। আমরা সবাই মিলে গুরুচরনের বাড়ি নিমন্ত্রণ খেতে যাচ্ছি।
মনে মনে চিন্তা হচ্ছে -- ' গুরুচরন তো একদম নিম্ন জাতি! অচ্ছ্যুত জাতির লোক! তার বাড়িতে খাওয়া!?
অফিসে তার হাতের রান্না খেয়েছি, সেটাতো কেউ জানেনা। তাই বলে তারই সমাজে, তারই বাড়িতে, প্রকাশ্যে দিবালোকে, ঘটা করে নেমন্তন্ন খাওয়া!'
মনের ভাবনাটা প্রকাশ করে ফেললাম।
নাজমা সিস্টার অভয় দিয়ে বললেন -- " না স্যার, ওর বাড়ির পাশের এক মুসলমান বাড়িতে আয়োজন করা হয়েছে, আলাদা কেনাকাটা করা হয়েছে, মুসলমান বাবুর্চি রান্না করেছে, কোন সমস্যা নাই। "
আশ্বস্ত হয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
এভাবে জীবনের অনেকটা সময়, অনেকগুলি বছর, ধরতে গেলে চাকুরি জীবনের অর্ধেকটা সময় জুড়ে, গুরুচরণ
আমার একজন একনিষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে আমার পাশে পাশে থেকেছে।
পরের দিকে গুরুচরন অসুস্থ হয়ে পড়ে।
ওর হার্টের সমস্যা দেখা দেয়। একটু খানি পরিশ্রম করলেই হাঁপিয়ে উঠতো।
এর জন্য বড় কোন হার্টের ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা নিতে রাজি করানো যায়নি। বলতো - " আপনেগরে ওষুধ খাইয়াই ভালো থাকমু, অন্য কোন খানে যাওয়া লাইগব্যো না স্যার। "
মাঝে মাঝে কার্তিক মাসের ভোর বেলায় কপালে চন্দনের তিলক এঁকে গুরুচরনকে কীর্তনিয়া দলের সাথে '' হরে কৃষ্ণ, হরে রাম '' গান করতে দেখা যেতো।
অনেক দিন গুরুচরনের কথা মনে ছিলো না।
ঢাকা থেকে অবসর নিয়ে নিজ এলাকাতে চলে এসেছি।
একদিন গুরুচরন দেখা করতে এলো।
কথায় কথায় বলল সেও কয়েক মাস হল অবসরে গিয়েছে।
জিজ্ঞেস করলাম -"পেনশনের টাকা পয়সা পেয়েছো কিনা? পেয়ে থাকলে টাকা পয়সা দিয়ে কি করেছে?"
এর জবাবে গুরুচরন যা বলল ---
" টাকা পয়সা পাওয়া গ্যাছে। স্যার, অনেক দিনের আশা আছিল আমাগ'রে পাড়ায় একটো গোবিন্দের মন্দির বানামু। গোবিন্দ সেই আশা পুরন কইরছ্যে।
'ছয় লক্ষ টাকা খরচ কইর‍্যা মন্দির বানাইছি।
আপনে একবার মন্দির দেইখপ্যার আইসেন স্যার।"
গুরুচরনের সেই মন্দির দেখে এসেছি।
ওদের পাড়া 'ঋষি পাড়ায় ' প্রায় চার শো হরিজন সম্প্রদায়ের লোক বসবাস করে। ওরা বেশিরভাগই গরিব। জুতা সেলাই, জুতা পালিশ করা, চামড়া প্রসেসিং করা ওদের মুল উপার্জনের পথ। কেউ কেউ পৌরসভা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা গুরুচরনের মত হাসপাতালের ক্লিনারের কাজ করে। ওদের উপাসনার জন্য কোন মন্দির ছিল না।
গুরুচরন নিজের সারা জীবনের অর্জিত টাকার ছয় লক্ষ টাকা দিয়ে মন্দিরটি বানিয়েছে, এর জন্য অন্য কারো কাছ থেকে একটি পয়সা সে নেয় নাই।
ইতিমধ্যে পৌর মেয়র কে দিয়ে মন্দির উদ্বোধন করিয়ে, মন্দিরের চাবি তার পাড়ার স্বগোত্রীয়দের হাতে তুলে দিয়েছে।
আমি মনে মনে ভাবলাম - গুরুচরনের মন্দির নির্মানের তো কোন প্রয়োজন ছিলো না!
সারাজীবন তার কর্মস্থল হাসপাতালকেই সে মন্দির মনে করে এসেছে! অসুস্থ মানুষের নিঃস্বার্থ সেবা করাটা ছিল তার কাছে উপাসনার মত!
ইট কাঠের মন্দির, আর পাথরের দেবতার উপাসনা তার আদৌ প্রয়োজন ছিলো কি!
আমার এটাও মনে হল --
গুরুচরন কোন হরিজন নয়, গুরুচরন কোন হিন্দুও নয়।
সে স্রেফ একজন মানুষ। একজন সত্যিকারের দেবতা তূল্য মানুষ!
হিন্দু সমাজের কেউ যদি কোন দেবতাকে 'সশ্রদ্ধ নমস্কার' করতে চায়, তাহলে তাকে গয়া, কাশি, বৃন্দাবন, বা হিমালয়ের গুহায় যেতে হবে না।
'গুরুচরনই' সেই ব্যাক্তি- যাকে নির্দ্বিধায় শ্রদ্ধাভরে নমস্কার করা যেতে পারে। গুরুচরনই নমস্য!।।
চলবে

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়