SAHA ANTAR

Published:
2020-10-07 01:28:29 BdST

সোনার হরিণ১৯৮৮: গোটা শহর জলের নীচে :তিনটি উঁচু জায়গায় মানুষ গিজগিজ করছে



ডাঃ সুকুমার সুর রায়


_____________________


সপ্তদশ -পর্ব::অষ্টাশির কড়চা

 

১৯৮৮ সালে সিরাজগঞ্জের 'খোকশাবাড়ি দশ শয্যা বিশিষ্ট পল্লী স্বাস্থ্য কেন্দ্র ' ছিল আমার সরকারি চাকুরী জীবনের দ্বিতীয় কর্মস্থল।
চৌহালি উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেব হাজতে যাওয়ার পর বহু চেষ্টা তদবির করে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে অন্যান্য অফিসারদের মতো আমিও সেইখান থেকে বদলি হয়ে আসতে পেরেছিলাম।
দুইজন মেডিকেল অফিসারের পোষ্ট ছিল এখানে।
বন্ধু ডাঃ রফিকুল ইসলাম ছিল আমার সহকর্মী। সিরাজগঞ্জ শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে হাসপাতালটির অবস্থান। রফিক কোয়ার্টারেই থাকতো। আমি শহরে ছিলাম, স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশে ' মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুলের ' ঠিক দক্ষিন পাশের ওয়াল ঘেঁষে যে টিন শেড বাড়িটি, সেখানেই ভাড়া থাকতাম । আসলে বাড়িটি আমার হাইস্কুল শিক্ষক সন্তোস স্যারের বাড়ি, উনি তখন ডিসি অফিসে চাকুরীরত। আমি তখন ব্যাচেলর। ছোট এক ভাই আর এক বোন আমার সাথে থাকতো।
রেগুলার একই রিকশায় চেপে অফিসে যেতাম। রিকশাওয়ালার নাম আয়নাল। আয়নালের কাজ হলো প্রতিদিন সকালে আমাকে রিক্সায় অফিসে পৌছে দিয়েই ব্বেড়িয়ে পড়তো। এদিক ওদিক খ্যাপ মেরে ঠিক যথা সময়ে আবার আমাকে অফিস থেকে নিয়ে আসতো।
আগষ্ট মাসের কোন এক সন্ধ্যায় শহরের লোকজনের মাঝে আতংক ছড়িয়ে পড়ল।
জানা গেল শহরের উত্তরে রানীগ্রামের পাশে বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ ভেংগে প্রবল তোড়ে শহরে জল ঢুকছে।
আতঙ্ক নিয়েই রাতে এক সময় ঘুমাতে গেলাম।
পরদিন সকালে রিক্সাওয়ালা আয়নাল হাজির।
বলল " স্যার, এহুনো রাস্তা জাগো আচে, অপিসে গেলি চলেন রউনা অই । "
রিক্সায় চেপে রওনা হয়ে দরগা রোড পার হতেই দেখা গেল রাস্তার উপর দিয়ে চিপচিপানি জল গড়িয়ে যাচ্ছে। কিছুদূর অগ্রসর হয়ে কাজিপুর রোডে পড়তেই দেখা গেল রাস্তায় হাঁটু জল !
তবুও আয়নাল রিক্সা টেনেই চলেছে। দুই একজন লোক উল্টা দিক থেকে আতঙ্কিত হয়ে ছুটে আসছিলো। তাদেরই একজন বললো ''শিগগীর ফিরে যাও, পানির তোড়ে এই মাত্র কাজিপুর রোডের 'কাঠের ব্রীজ ' ভেংগে গেছে, যাওয়ার কোন উপায় নাই।"
' অগত্যা শহরের দিকে ফিরতে হল।'
ফিরে সিভিল সার্জন অফিসে রিপোর্ট করতে হল - অফিসে যাওয়া সম্ভব হল না বলে।
তখন সিভিল সার্জন ছিলেন সুজাবত স্যার। তিনি বললেন "এই জরুরি অবস্থায় অবশ্যই কর্মস্থলে অবস্থান করতে হবে। আজ যাওয়া সম্ভব না হলে আগামীকাল যে কোন উপায়ে নৌকা টৌকা জোগাড় করে সেখানে যেতে হবে।"
বাসায় ফিরলাম। , ভাই বোনদের বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম।
বিকেলে শহরে বের হলাম। ইতিমধ্যে গোটা শহর জলের নীচে তলিয়ে গেছে। শহরের তিনটি উঁচু জায়গায় মানুষে গিজগিজ করছে, একটি হল বাজার স্টেশনের প্লাটফর্ম এলাকা, ইলিয়ট ব্রীজ এলাকা এবং বাহিরগোলা স্টেশনের অল্প একটু এলাকা।
বাসায় ফিরে দেখি উঠানে জল ঢুকেছে!
ঘরে ঢুকে খাটের পায়ার নীচে কয়েকটা ইট দিয়ে উঁচু করে নিলাম। রাত দশটার দিকে ঘরে জল ঢুকতে শুরু করলো। এই অবস্থায় খাটে শুয়ে পড়লাম।
মাঝরাতে স্যারের চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙ্গলো। তিনি বললেন তার খাট জল ছুঁই ছুঁই করছে! আমি বললাম আমার খাট এখনো কিছুটা উঁচু আছে কারন ইট দিয়ে উঁচু করা হয়েছে। তিনি তখন বললেন তার ছেলে অজয়কে আমার খাটে নিয়ে নিতে, ওনারা বসেই থাকবেন। শেষ পর্যন্ত সারা রাত বসেই কাটাতে হলো।
সকালে বাড়ি ছাড়ার তোড়জোড় শুরু হল। আমি ব্যাচেলর মানুষ, আমার তেমন কিছুই ছিলো না।
বিছানাপত্র গুটিয়ে সিলিঙের উপরে তুলে ফেললাম। স্যার সপরিবারে পাশের ম্যাটসের হোস্টেলে উঠে গেলেন। আমি জল ভেংগে ভেংগে বাহির গোলার দিকে আগালাম, উদ্দেশ্য অফিসের দিকে যাওয়া।
বাহিরগোলা ঘাটে একটা ছোট নৌকাতে দুই তিনজন যুবককে দেখা গেল, তাদের জিজ্ঞেস করতে জানালো তারা খোকশাবাড়ি হাসপাতালে যাবে।
নিজের পরিচয় দিতেই তারা নৌকায় উঠতে বলল।
নৌকায় উঠে দেখলাম তিনটা ঝাঁকা খবরের কাগজ দিয়ে ঢাকা আছে। এগুলিতে কী জিজ্ঞেস করতেই ওরা জানালো - " স্যার, আপনি যখন এই হাসপাতালেরই মেডিকেল অফিসার, আপনাকে আমাদের সহযোগীতা করতে হবে। "
ওরা সারা রাত জেগে তিন ঝাঁকা রুটি তৈরি করেছে।
খোকশাবাড়ি হাসপাতালে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় পাঁচ ছয়শো মানুষ। এই মানুষ গুলি দুইদিন যাবত একদম না খেয়ে আছে। এই অল্প পরিমান রুটি এত মানুষের মাঝে কেমনে নিয়ে যাওয়া হবে এই নিয়ে তারা খুবই চিন্তিত।
হাসপাতালে পৌছে দেখা গেলো এক অবর্ণনীয় দৃশ্য! হাসপাতালের গ্রাউন্ড ফ্লোরে চিপচিপানি জল , সেই জলের মধ্যেও শত শত অভূক্ত মানুষ,। বাচ্চাদের কান্নার রোল।, মায়েদের হাহাকার! তাদের হাহাকার 'ক্ষুধার্ত '-এই জন্য নয় - তারা সর্বস্ব হারিয়ে এখানে চলে এসেছে। বাঁধ ভাংগা জলের তোড়ে তাদের ঘর বাড়ি সহায় সম্বল সব কিছু ভেসে গেছে। কারো কারো বাড়ি ঘরের চিহ্নমাত্র নাই। যেখানে বাড়ি ছিল সেখানে এখন ভয়ানক জলের ঘুর্নিপাক বয়ে চলেছে! এক রাতের মধ্যে তারা শুধু পৈত্রিক জান'টা হাতে নিয়ে এখানে এসে পৌছেছে!
খাতা কলম হাতে নিয়ে দ্রুত আশ্রিতদের একটা তালিকা তৈরি করে ফেললাম।
সেই তিন হৃদয়বান যুবকের তিন ঝাঁকা রুটি দিয়ে প্রাথমিক ত্রান তৎপরতা শুরু করা হলো।
ডাক্তারদের কোয়ার্টারের মেঝেতেও জল । এক বেডেই রফিকের সাথে রাত্রিযাপন করে সকালে আরেক বিপত্তি। টয়লেট করা সম্ভব নয়, জলে সয়লাব।
তৃতীয় শ্রেণির তিন তলা কোয়ার্টারের একটা রুমে সাময়িক আশ্রয় নিতে হল।
দেখা দিল খাওয়াদাওয়ার বিপত্তি। সকালে কাজের বুয়া রান্না করে দিয়ে গেছে ভাত আর বিলাতি ভর্তা। সকালের নাস্তা করা হয়ে গেছে। দুপুরে বুয়ার কোন দেখা নাই। অপেক্ষা ক'রে ক'রে রান্না ঘরে ঢুকে দেখা গেলো, বড় ডিসে অনেক ভাত ঢাকা আছে, পাশেই আরেক ছোট গামলাতে অনেক খানি বিলাতি ভর্তা। বোঝা গেল বুয়া একবারেই তিনবেলার খাবার রান্না করে দিয়ে গেছে! এছাড়া তার পক্ষে আর কী বা করার ছিল।
আবার শহরে ফিরে এলাম।
স্যার ও তার পরিবারকে খুঁজে বের করলাম মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুলের হোস্টেলের তিন তলার এক রুমে।
স্যার বললেন ' " চল বাসায় যেতে হবে একটা নৌকা নিয়ে, ফ্রিজসহ বেশ কিছু জিনিষ পরে আছে জলের নীচে, একদম নষ্ট হয়ে যাবে। "
একটা নৌকা ভাড়া করে যাওয়া হলো। আমি টিনের চালা বেয়ে উঠানের মধ্যে নামার সিদ্ধান্ত নিলাম, ধারনা হলো বুক জল হবে। কিন্তু যখন ঝাঁপ দিলাম একদম ডুবে গেলাম।
যাহোক অনেক কষ্টে জলে ডুব দিয়ে তালা খোলা হল। এদিকে সাপের ভয়! লাঠি দিয়ে শব্দ করে করে ভিতরে ঢুকে প্রয়োজনীয় দামি জিনিষগুলি উদ্ধার করে আনা হলো।
বেলা চারটায় বৌদি ডাক দিলেন, "ঠাকুরপো ভাত খেয়ে যাও। "
ভাত, ডাল আর আলু ভর্তা, সে যেন ছিল এক অমৃতসম খাবার!
পাশের রুমে আশ্রয় নিয়েছিল এক বন্ধু সমাজকল্যাণ অফিসার সোবহান। তার রুমে ডাব্লিং করে থাকতে শুরু করলাম।
সব চেয়ে বড় সমস্যা যেটি, তা হলো পানীয় জলের সমস্যা।
এ তল্লাটে একটা মাত্রই টিউবওয়েলের মাথা জেগে ছিল , সেটা ছিল সদর হাসপাতালে।
কলা গাছের ভূরা ঠেলে নার্সেরা কলসি ভর্তি জল নিয়ে আসতো, অবলীলায় সেই জলে ভাগ বসাতাম। আর খাওয়ার সময় হলে বৌদির সেই মোলায়েম সুরের ডাক - "ঠাকুরপো ভাত খেয়ে যাও। "
একদিন সকালে সদর হাসপাতালে আড্ডা মারছিলাম।
' আরএমও ' মকবুল ভাই বললেন; " এই তুমি এখানে কেন? শিগগীর খোকশাবাড়ি যাও, স্বাস্থ্যমন্ত্রী কিছুক্ষন আগে খোকশাবাড়ি হাসপাতাল ভিজিটে গেছেন "।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী তখন প্রফেসর ডাঃ এম এ মতিন সাহেব।
সর্বনাশ! চাকুরীটা গেল।
দ্রুত একটা নৌকায় উঠে খোকশাবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। হাসপাতালে পৌছার আগেই দেখলাম মন্ত্রী মহোদয়ের 'স্পিডবোট বহর ' শহরের দিকে ফিরে আসছে !
বুঝলাম চাকুরীটা আর রক্ষা করা গেল না।!
হাসপাতালে ঢুকে রফিককে সভয়ে জিজ্ঞেস করলাম চাকুরী কি আছে?
রফিক বলল - " আছে "।
বললাম কিভাবে থাকে! এই জরুরী অবস্থায় কর্মস্থলে অনুপস্থিতি! তাও আবার নিজেদের মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর হাতে ধরা খাওয়া, সেটাও আবার সামরিক শাসনের আমলে! যখন 'এমএলও নং- ৯ ' চাকুরী খাওয়ার জন্য যথেষ্ট।
রফিক বলল - জিজ্ঞেস করেছিল, " কয়জন ডাক্তার? "
বলেছি -" দুইজন, আরেকজন কে শহরে পাঠিয়েছি বাজার আনতে, আমাদেরও যে খাওয়া লাগে!!"
এই ছিলো কলিগ কাম বন্ধু!
আবার সেই রকম বৌদি! যিনি কিনা এই মহা দুর্যোগের মধ্যেও পরম মমতায় বলবেন -- " ঠাকুরপো, ভাত খেয়ে যাও। "
( ----- চলবে ----)

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়