Dr. Aminul Islam
Published:2020-10-04 01:49:07 BdST
সোনার হরিণ : একজন ডাকাতের কাহিনী
ডাঃ সুকুমার সুর রায়
____________________________
পঞ্চদশ - পর্ব:: একজন ডাকাতের কাহিনী
পঁচাশি সালে যখন চৌহালি উপজেলায় প্রথম মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগদান করতে যাই, তখন পাড়া প্রতিবেশী ও বন্ধু বান্ধবদের অনেকেই বলেছিলেন যে, এমন জায়গায় পোস্টিং হলো! জায়গাটা তো যমুনা নদীর দুর্গম চর!
সেখানেতো ডাকাতদের আস্তানা! তাছাড়া সেখানকার লোকজন ভয়ংকর দুর্ধর্ষ প্রকৃতির! তাই খুব সাবধানে থাকতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব সেখান থেকে বদলি হয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে!!
জয়েন করার পর থেকেই মানুষের এই অযাচিত পরামর্শের কারনে মনের ভিতরে এক ধরনের ভয় লেগেই থাকতো!
জায়গাটা যে ভয়ানক রকমের দুর্গম এব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত ছিলো না।
এই উপজেলাটি সিরাজগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত হলেও আসলে টাংগাইল জেলা সংলগ্ন। ছয়টি ইউনিয়ন এর চারটিই নদীর গহবরে! প্রতি বছরই সেই চর এলাকার ভূগোল পরিবর্তিত হয়ে যেতো!
দুইটি ইউনিয়নের স্থলভাগ যমুনার পুর্বপাড়ে টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলা সংলগ্ন।
যমুনার পশ্চিম পাড়ে সিরাজগঞ্জের বেলকুচি ও শাহজাদপুর উপজেলা সংলগ্ন স্থায়ী ভূমির পরিমান নগন্য। পূর্ব পাড়ে খাষকাউলিয়া ইউনিয়ন হেডকোয়ার্টারই মূলত উপজেলা হেডকোয়ার্টার!
তার পুর্বদিকে বয়ে গেছে ধলেশ্বরী নদী।
মাঝখানে যমুনার চর গুলি একটা থেকে আরেকটার দুরত্ব অনেক! এবং একমাত্র বাহন নৌকা! তাও আবার তখনকার সময়ের দাঁড়টানা বা লগি ঠেলা নৌকা!
চৌহালি উপজেলা সদর থেকে নিকটবর্তী শহর ছিলো নাগরপুর, যার দুরত্ব পনেরো কিলোমিটার পায়ে চলা পথ!!
চৌহালি উপজেলা সদর ' শিবির ' নামে পরিচিত।
কারন কোন এক বন্যার সময় এটাই ছিল একমাত্র উঁচু জায়গা এবং সেখানে ত্রান শিবির খোলা হয়েছিলো।
উপজেলা পরিষদ, হাসপাতাল, থানা, ব্যাংক, স্কুল, এগুলোসব একটা জায়গাতেই সাজানো গোছানো ছিল। কিন্তু কোন রাস্তাঘাট, বাজার ও সভ্যতার মুল উপাদান বিদ্যুৎ ছিল না।
সন্ধ্যার পর এক অসহনীয় ভূতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করতো!
যমুনা নদীর গতিপ্রকৃতি এমনি বিচিত্র যে, একজন বয়োবৃদ্ধ মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছিল যিনি জানিয়েছিলেন যে, তার সারা জীবনে না হলেও বিশ বার তার বাড়িঘর যমুনা গর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছিলো!
আবার নতুন চরে নতুন করে বসতি গড়ে তুলেছিলেন । তাদের এই সংগ্রামী জীবন যাপনই হয়তো তাদেরকে সাহসী ও দুর্ধর্ষ করে তুলে থাকতে পারে।
ইতিমধ্যে খাসকাউলিয়া ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বর নওয়াজেশ আলি মোল্লার সাথে পরিচয় হয়েছে।
প্রায়শই হাসপাতাল গেটে চা'য়ের দোকানে তাকে আড্ডা দিতে দেখা যেতো।
বেঁটেখাটো গাট্টা গোঁট্টা চেহারা, গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা, ব্যাকব্রাশ করা কোঁকড়ানো মাথার চুল, চোখ দুটো টকটকে লাল!
তার চেহারার মধ্যে এমন একটা কিছু ছিলো, যাতে তাকে দেখলে কেমন যেন মনের মাঝে এক ভয়ানক ভয়ের আবহ তৈরি হতো! মনের সেই ভয় সারা শরীরে শীতল স্রোতের মতো বয়ে যেতো! ফলে তার মুখ চোখের দিকে কখনো সরাসরি তাকাতে পারতাম না!
এহেন অবস্থায় নওয়াজেশ আলি মোল্লাকে দেখে আমার ভিতরের যে আতংক, তা একদিন সত্যি বলে জানলাম! সেদিন তিনি কথাচ্ছলে বলে ফেললেন যে, কয়েক বছর আগেও তিনি নিজ হাতে অনেক মানুষ খুন করেছেন! কিভাবে ছুরি চালিয়ে পেট চিরে নদীতে ফেলে দিয়েছেন! সে গল্প তিনি অবলীলাক্রমে গর্বের সাথে করে বসলেন।
তবে অভয় দিলেন যে এগুলো তিনি অনেকদিন হলো ছেড়ে দিয়েছেন!
এরপর থেকেই তাকে দেখলে আমার ভিতরে ভয়ের এক শিরশিরানি অনুভূতি বয়ে যেতো! ,কিন্তু বাইরে হাসিমুখে বীর বাহাদুরের মত তার সাথে কথাবার্তা চালিয়ে গেছি, এমনকি মোটর সাইকেলের পেছনে চেপে বাড়িতে তার অসুস্থ্য স্ত্রীর চিকিৎসা করতেও গেছি।
দেখতে দেখতে ঈদুল ফিতর চলে এলো।
উপজেলার সকল অফিসের সকল লোকজন ঈদের ছুটিতে বাড়ি চলে গেলো।
ঈদের দিন সন্ধ্যায় হাসপাতাল কোয়ার্টারে আমিই একমাত্র প্রানী। সারা উপজেলা কমপ্লেক্সে দ্বিতীয় আর একটি প্রানিও নেই।
চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে এলো।
সাহাবুদ্দিন নামের একজন নৈশ প্রহরী আছে। সে আছে হাসপাতালের মেইন গেটে।
গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেও সাহাবুদ্দিন আমার ডাক শুনতে পাবেনা। কারন হাসপাতাল ও কোয়ার্টারের মাঝখানে বিরাট এক মাঠ। তার মাঝে আছে আবার ইটের স্তুপ। ইটের স্তুপের মধ্যে থেকে বিকেল বেলায় দুই তিনটি শেয়াল বের হতে দেখেছি!
রাত আনুমানিক আটটা। চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার।
আমি একটি হারিকেন জ্বালিয়ে গল্পের বই পড়ছিলাম। সাহাবুদ্দিন টেবিলের উপরে খাবার ঢেকে রেখে সন্ধ্যার আগেই বিদায় নিয়ে গেছে।
হঠাৎ একটা মোটর সাইকেলের আওয়াজ পেলাম! কান খাড়া করলাম! মনে হলো থানার কোন পুলিশের মোটরসাইকেল হতে পারে। আমার ঘরের উত্তর পাশে যেদিকে থানা সেদিকের জানালা খুলে রেখেছি। সেদিকে কাউকে দেখা গেলো না। মনে হলো আমার কোয়ার্টারের মেইন গেটে এসে মোটর সাইকেল থেমে গেলো! তার পরেই দরজায় জোরে কড়া নাড়ার শব্দ হলো! ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো!! মন শক্ত করলাম, বিপদে ভয় পেলে চলবেনা। উত্তরের খোলা জানালা দিয়ে অসহায়ের মতো পুলিশ স্টেশনের দিকে তাকালাম, যদি কোন সেন্ট্রিকে বাইরে দেখা যায়!
আবারো জোরে কড়া নাড়ার শব্দ!
ভয়ে গলার খাদ নীচে নেমে এসেছিলো। শক্তি সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করলাম, " কে -!?"
দরাজ কন্ঠে হুকুম এলো -" দরজা খোলেন! "
কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম -- " আপনি কে!? "
- " আমি নওয়াজেশ আলি মোল্লা '! "
আমি অতি বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করলাম -
" ভাই, কি ব্যাপার!? রোগী আছে!? হাসপাতালে তো সাহাবুদ্দিন আছে, গেটতো খোলাই আছে।"
'' আরে না রুগী টুগি না,দরজা খোলেন। ''
তার কণ্ঠস্বর আরো কড়া!!
দেখলাম ভয় পেয়ে কোন লাভ নেই, কিসের ভয়? আমিতো চিকিৎসক, দুস্থ্য মানুষের সেবা করি, কারো সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করি নাই, আমারতো কোন শত্রু নেই ,থাকার কথাও নয়, আমার কাছেতো টাকা পয়সাও নেই যে ডাকাতি করবে!
যা থাকে কপালে, বীর বিক্রমে দরজা খুলে দিলাম! বললাম - '' নওয়াজেশ ভাই! রাতে হঠাৎ কি মনে করে ভাই!? ''
তিনি রীতিমত আদেশের ভঙ্গিতে বললেন -- " চলেন, ভিতরে চলেন! "
তার বাম হাতে টর্চ, আর ডান হাতে আলো আঁধারীতে কি যেন ঝুলতে দেখা গেল!
ঘোরের মধ্যে টলমল পায়ে রুমে ঢুকলাম।
প্রশ্ন হল : " দুপুরে কি খাইছেন?"
আমি বললাম - " ভাই, সাহাবুদ্দিন ভাত রান্না করেছে আলু ভর্তা আর ডিম ভাজি। দুপুরে খেয়েছি , আবার রাতের জন্যও রেখে গেছে ঐযে টেবিলে।"
নওয়াজেশ আলি মোল্লা হঠাৎ নরম গলায় বললেন - " দাদা, আজ ঈদের দিন,নানান ঝামেলায় ভুলেই গেছিলাম যে আপনি একলা একলা না খাইয়া আছেন! আপনার ভাবি খাবার পাঠাইছে! এই যে খাইয়া দাইয়া টিফিন ক্যারিয়ার খালি কইর্যা দ্যান!
টিফিন ক্যারিয়ার খুলে দেখলাম, পোলাও, মুরগির মাংস, মাছ ভাজি, ডিম ভূনা!
প্লেটে সব ঢেলে নিয়ে টিফিন ক্যারিয়ার খালি করে দিলাম।
ফেরার সময় 'ডাকাত' নওয়াজেশ আলি মোল্লাকে' বললাম - " ভাই, আমিতো একলা এতো খাবার খেতে পারবো না। মেইন গেটে সিকিউরিটি গার্ড শাহাবুদ্দিন আছে, ওকে একটু পাঠিয়ে দিয়েন।।।
( ------- চলবে -------)
আপনার মতামত দিন: