Dr. Aminul Islam
Published:2020-10-01 01:50:07 BdST
চতুর্দশ - পর্ব :: ইনভিজিলেটর সোনার হরিণ: ডাক্তার যখন এসএসসি পরীক্ষার ইনভিজিলেটর
ডাঃ সুকুমার সুর রায়
--------------------------------------------
সময়কাল ১৯৮৬ সাল।
মেডিকেল অফিসার হিসাবে আমার কর্ম জীবনের দ্বিতীয় বছর।
চাকুরি জীবন আমাদের ভালোই কাটছিলো।
আমাদের চাকুরি ছিলো উপজেলা পরিষদে ন্যস্ত। যেখানে উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন সর্বেসর্বা।
আমাদের এই উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেব ছিলেন একটু অন্য প্রকৃতির।
অফিসারদের উপরে এক ধরনের স্নায়বিক চাপ ছিলো।
কিন্তু আমাদের ডাক্তারদের সাথে কেন জানি এক ভিন্নধর্মী সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো। ফলে আমরা একধরনের মউজে ছিলাম।
চেয়ারম্যান গৃহিনী আমাদের মেডিকেল অফিসার রবিউল করিম ওরফে বাবলুকে এক বিশেষ স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতেন।
চেয়ারম্যান সাহেবের বডিগার্ড কোম্পানি' মিয়ার কাছ থেকে আমরা ইতিমধ্যে জেনে গেছি যে, চেয়ারম্যান গৃহিনী তার বড় কন্যার বিয়ের পাত্র হিসাবে আমাদের বাবলুকে মনে মনে খুব পছন্দ করতেন।
এর একটা সুদুর প্রসারী প্রভাব পড়েছিলো আমাদের দৈনন্দিন জীবন যাপনে।
যেহেতু চেয়ারম্যান মহোদয়ের ফেমিলি এবং আমরা একই বিল্ডিংয়ে বসবাস করতাম ; এতে হলো কি , ওবাড়িতে ভালো মন্দ রান্না হলে প্রায়শই তা আমাদের ডাইনিং টেবিলে পৌছানো হতো।
হবু জামাই বাবলুর সৌজন্যে আমাদের খাওয়া দাওয়া যত্ন আত্তি ভালোই চলতে লাগলো।
আমরাও তা নির্দ্বিধায় উপভোগ করতে লাগলাম।
অন্যান্য অফিসের অফিসারেরা একধরনের তটস্থ থাকলেও আমাদের জীবন যাপন রাজার হালেই চলছিলো।
ইতিমধ্যে এসএসসি পরীক্ষা অতি সন্নিকটে চলে এলো।
কিন্তু একই সময়ে বেতন ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার দাবিতে মাধ্যমিক শিক্ষকদের লাগাতার ধর্মঘট শুরু হলো।
এসএসসি পরীক্ষা একদম সামনে চলে এলেও শিক্ষক সম্প্রদায় তাঁদের দাবি দাওয়ার ব্যাপারে একদম অনড় থাকলেন।
তখন ছিলো সামরিক শাসন।
সরকার শিক্ষকদের ছাড়াই পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে আল্টিমেটাম দিয়ে দিলো।
একদিন আউটডোর শেষ করে বাসায় ফেরার উদ্যোগ নিচ্ছিলাম সেই সময় হাসপাতালের অফিস থেকে একখানা খাম আমার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো।
ভয়ে ভয়ে খামখানি ছেঁড়ার পর তার ভিতর থেকে বের হয়ে এলো পাতলা কাগজে টাইপ করা একখানি চিঠি!
পাতলা কাগজের চিঠি দেখলেই মনে এক ধরনের শংকা দেখা দিতো!
কারন অফিসের যে কোন আদেশ, নির্দেশ, কৈফিয়ত তলব ইত্যাদি এইরকম টাইপ করা পাতলা কাগজেই করা হতো।
চিঠিটি পড়তে পড়তে জানা গেলো যে, এই চিঠিটি উপজেলা পরিষদের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ইস্যু করা হয়েছে।
আমার কাজকর্মে অতিশয় সন্তুষ্ট হয়ে সদাশয় সরকার আসন্ন অনুষ্ঠিতব্য এসএসসি পরীক্ষায় ইনভিজিলেটর হিসাবে দায়িত্ব পালনের জন্য আমাকে মনোনীত করেছেন!
একজন মেডিকেল অফিসার হিসাবে বিভিন্ন ধরনের দায়িত্ব পালন করতে ইতিমধ্যে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি।
কিন্তু পরীক্ষার হলে মেডিকেল টিম হিসেবে না দিয়ে, সরাসরি পরীক্ষা পরিচালনার দায়িত্বে কেন নিয়োগাদেশ দেওয়া হয়েছে তা বোধগম্য হলো না! নাকি টাইপ করতে কোন ভুল হয়েছে!
অফিসের দিকে যেতেই বড় বাবুর মুখোমুখি হয়ে গেলাম।
তাকে জিজ্ঞেস করলাম - " বড় বাবু, চিঠি টাইপ করতে কি কোন ভুল হয়েছে? মেডিকেল টিমের সভাপতি লিখতে কি ইনভিজিলেটর লেখা হয়েছে!? "
বড় বাবু বললেন - " না স্যার, শিক্ষকেরা টানা ধর্মঘটে আছে। তাদের দাবিদাওয়া না মানা পর্যন্ত তারা কাজে যোগ দিবে না। এদিকে পরশুদিন থেকে এসএসসি পরীক্ষা শুরু! সরকার এডামেন্ড। শিক্ষকদের ছাড়াই পরীক্ষা নেওয়া হবে। উপজেলার সব অফিসারকে পরীক্ষার ডিউটি দেওয়া হয়েছে।"
এতক্ষনে বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব হলো।
বিকেলে অন্যান্য অফিসারদের সাথে কথা হলো। অধিকাংশকে পরীক্ষার হলে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
রাতে বিষয়টি নিয়ে একধরনের চিন্তা হলো। যদিও সব কাজই সরকারি কাজ। তারপরেও মনে হলো যে,'একটি পাবলিক পরীক্ষায় দায়িত্ব পালন হলো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দায়িত্ব পালন করা!'
এক ধরনের গর্ব অনুভব হতে লাগলো। মাত্র একযুগ আগে যেখানে আমি নিজেই ছিলাম এসএসসি পরীক্ষার্থী! সেখানে সেই আমি আজ পরীক্ষা হলের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা।
প্রয়োজনে পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কার করার ক্ষমতা আমাকে দেওয়া হয়েছে! ভাবা যায়!!
পরীক্ষার দিনে স্যুটেড বুটেড হয়ে যুগপৎ
একধরনের শংকা ও সাসপেন্স নিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে হাজির হয়ে গেলাম।
সরকারি কর্মকর্তা হিসাবে দেশ ও জাতির জন্য প্রথম একটি গুরু দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়ে যে গর্ববোধ হয়েছিলো
সেই গর্ববোধ বেশিক্ষন স্থায়ী হলো না।
পরীক্ষা কেন্দ্রের একটি হলে গিয়ে যা দেখলাম তাতে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল!
প্রতিটি পরীক্ষার্থীর সামনে বই খোলা রয়েছে! তারা নিজেদের মধ্যে উচ্চৈঃস্বরে শলাপরামর্শ করে পরীক্ষার খাতায় লিখছে! নিজেরা অবাধে দেখাদেখি করে সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজন যা কিছু করা দরকার তা করে যাচ্ছে!মনে হলো এটি কোন পরীক্ষা কেন্দ্র নয়। বরঞ্চ ক্লাশ রুম হতে পারে!
আমার মত একজন তরুন অফিসার যার রক্ত গরম এবং নীতিনৈতিকতা বোধ টনটনে ;তার পক্ষে এই অনাচার সহ্য করা এক কথায় অসম্ভব।
সমস্ত খোলা বইপত্র নিয়ে এক জায়গায় জড় করার জন্য একজন পিয়নকে হুকুম করলাম। তাতে সমস্যা দেখা দিল। চারিদিকে হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল।
এই বিশৃঙ্খলার ডামাডোলে স্পটে আবির্ভূত হলেন তৎকালীন ইউএনও জনাব আবুল হোসেন।
তিনি তার কোমল ডান হাত খানি দিয়ে আমার বাম হাতটি পেঁচিয়ে নিয়ে বিনীত ভঙ্গিতে বাইরে চা খাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন।
তখন ছিল শীতকাল। বাইরের মাঠে চেয়ার টেবিল পাতা ছিল।
তিনি বললেন - " আমরা রোদে পিঠ দিয়ে বসে বসে রোদ পোহাবো আর চা খাবো ; হলের ভিতরে যাওয়ার কোন প্রয়োজন নাই।"
আমি বললাম - " আচ্ছা ঠিক আছে, হলের ভিতরে যদি কোন কাজ করার কিছু না থাকে, তাহলে রোদ না তাফিয়ে হাসপাতালে গিয়ে রোগী দেখলে মনে হয় কিছু মানুষ উপকৃত হবে । "
তিনি বললেন " রাগ করবেন না, আমাদের হাত পা আসলে বাঁধা, কিছুই করার নাই। "
এই বলে তিনি টেবিলে রাখা ফাইল খুলে একটি চিঠি বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন।
চিঠিটি এসেছে সিএমএলএ সেক্রেটারিয়েট থেকে।
প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দপ্তরের চিঠির গুরুত্ব নিঃসন্দেহে অপরিসীম।
চিঠির মুল বক্তব্য ছিল - " বাই এনি মিন্স, এক্সামিনেশন টু বি কনডাকটেড। "
এর উপরে আর কোন কথা চলে না।
আমার মত একজন তরুন অফিসার যার শরীরে টগবগে রক্ত। নীতি নৈতিকতায় টনটনে একজন মানুষ! অন্যায় অনাচার দেখে সাপের মত ফনা তুলে ফুঁসে উঠেছিলাম সেই উদ্ধত অহংকারী ফনা মুহুর্তে নত হতে হতে মাটির সাথে মিশে গেলো।
আমার চাকুরী জীবনের শুরুতে সেই চিঠির ভাষ্যটি হৃদয়ে গেঁথে আছে। সেদিন এই শিক্ষা হয়েছে যে, উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের আদেশ নির্দেশ বিনা বাক্যব্যয়ে পালন করা হলো একজন সরকারি কর্মকর্তার জন্য অবশ্য পালনীয় কর্তব্য । আর যদি সেই উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ হয় সামরিক কর্তৃপক্ষ! তাহলেতো কোন কথাই নাই। আরো মনে হয়েছে যে, একটি শিক্ষা ব্যবস্থা তথা একটি জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য এরকম চিঠির কোন বিকল্প নাই!!
( -------- চলবে -------)
আপনার মতামত দিন: