Dr. Aminul Islam
Published:2020-09-27 18:20:05 BdST
সোনার হরিণ : এক ডাক্তার-জীবনীর রহস্য রোমাঞ্চ:মঞ্চ নাটক,ডু দ্য নিডফুল,দেখামাত্র গুলি
ডা. সুকুমার সুর রায়
_______________________________________
নবম - পর্ব :মঞ্চ নাটক ----
রাতে খাবার সময় রফিক স্যার আমাকে বললেন - " আগামীকাল ভোরে ' জেলার মাসিক মিটিংয়ে এটেন্ড করার জন্য যাবো। আপনি গার্লস স্কুলে একটা অনুষ্ঠান আছে সেখানে পারলে এটেন্ড করবেন।
সকালে অফিসে গিয়ে বড়বাবুকে বললাম --" গার্লস স্কুলের কোন অনুষ্ঠানের চিঠি আছে কি? "
বড়বাবু আমার হাতে একখানা আমন্ত্রণ পত্র দিয়ে গেলেন।
" শাহিদা আক্তার উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের " এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠান ও বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতি ছাত্রীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। "
প্রধান অতিথি উপজেলা চেয়ারম্যান মহোদয়। বিশেষ অতিথি ইউএনও, সহকারী কমিশনার ( ভূমি), থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা প্রমুখ। প্রধান শিক্ষক সভাপতিত্ব করবেন।
এই ধরনের অনুষ্ঠানে এটেন্ড করার কোন পুর্ব অভিজ্ঞতা ছিলো না।
যথা সময়ের একটু আগেই অনুষ্ঠান স্থলে হাজির হয়ে হেডমাস্টার সাহেবের সাথে দেখা করে নিজের পরিচয় দিলাম - " আমি ডাঃ ওমুক, মেডিকেল অফিসার। "
হেডমাস্টার সাহেব আমাকে একটি চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলে হন্তদন্ত হয়ে এদিক সেদিক ছুটাছুটি করতে লাগলেন।
একজন ভদ্রলোক সম্ভবত সহকারী শিক্ষক মাইকে অনবরত ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছেন।
মেয়েরা যাতে কলরব না করে শান্ত ভাবে যার যার আসনে বসে থাকে সেই বিষয়ে বার বার সতর্ক করে দিচ্ছেন।
অতিথিরা যখন আসবেন তখন সবাই মিলে নিজ নিজ আসনে দাঁড়িয়ে কীভাবে তালে তালে করতালি দিতে হবে তা শিখিয়ে দিচ্ছেন।
যারা যারা অতিথিদের পুষ্পস্তবক অর্পণ করবে তাদেরকে মঞ্চের একদিকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে বললেন।
আমি কী বেশি আগে এসে পড়েছি! নাঃ, আমন্ত্রণ পত্রে বেলা এগারোটার কথা বলা আছে। ঠিক সময়েইতো এসেছি! অন্য কোন অতিথি এখনো এসে পৌছায়নি।
মাইকে বলা হচ্ছে - " অতিথিরা এলে তালে তালে করতালি দিয়ে বরন করে নেওয়া হবে! তাহলে সব অতিথি কী এক সাথে আসবে?
আমি তাহলে কেন আগে এসে পড়েছি! অন্য অতিথিদের সাথে যোগাযোগ করে এক সাথে আসা উচিৎ ছিলো কি!
হঠাৎ দেখি দুই তিনজন শিক্ষক একজনকে সমাদরে এগিয়ে নিয়ে এসে আমার পাশের চেয়ারে বসিয়ে দিলেন।
তিনি আর কেউ নন ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল কাদের সাহেব! প্রতিদিন রাতে অফিসার্স ক্লাবে যার সাথে ক্যারম খেলা হয়।
তিনি আমার সাথে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন।
আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। যাক বাবা! আমি একা নই। তারও একটু পরে দুইজন কনস্টেবলকে দুইদিকে নিয়ে গট গট করে চলে এলেন ওসি সাহেব!
কিছুক্ষনের মধ্যে উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনও মহোদয় সদলবলে চলে এলেন।
অনুষ্ঠান স্থলে একধরনের হুলুস্থুল ও টান টান উত্তেজনা দেখা দিলো!
মেয়েরা দাঁড়িয়ে তালে তালে করতালি দিতে লাগলো। প্রধান শিক্ষকের নেতৃত্বে শিক্ষকগণ দল বেঁধে ওনাদের বরন করে নিয়ে আসতে এগিয়ে গেলেন! মাইকে মুহুর্মুহু স্লোগান হতে লাগলো - " চেয়ারম্যান মহোদয়ের আগমন, শুভেচছা স্বাগতম!
ইউএনও মহোদয়ের আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম!
এই ধুন্ধুমার কর্মকাণ্ডের মাঝে আমাদের চেয়ারে গ্যাঁট মেরে বসে থাকা শোভা পায় না। তাই আমি ও এসি ল্যান্ড সাহেব নিজ নিজ চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেলাম।
চেয়ারম্যান ও ইউএনও মহোদয় কে সরাসরি মঞ্চে নিয়ে গিয়ে বসানো হলো।
মাইকে ঘোষণা হতে লাগলো -- " মাননীয় প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করছেন আমাদের এই নদী সিকস্তি এলাকার দুস্থ মানুষের প্রানের নেতা, দুঃখী মানুষের নয়নের মনি, জন দরদী রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব, বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী, জনগণের ভোটে নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান জনাব 'অমুক' মহোদয়! "
' এই মেয়েরা জোরে তালি দাও । '
এবারে, --বিশেষ অতিথির আসন অলংকৃত করছেন এমন একজন বিশিষ্ট শিক্ষা দরদী! যার একান্ত আনুকূল্য ছাড়া আমাদের এই বিদ্যালয়টি আলোর মুখ দেখতে পেতো না! তিনি হলেন আমাদের এই শাহিদা আক্তার গার্লস হাইস্কুলের সম্মানিত সভাপতি, বাংলাদেশ সরকারের একজন সুযোগ্য ও দক্ষ উপজেলা নির্বাহী অফিসার জনাব মুহাম্মদ ' অমুক ' মহোদয়।
বিশেষ অতিথি হিসাবে আরো আসন গ্রহণ করছেন আমাদের এই দুর্গম চরাঞ্চলের জেগে ওঠা খাষ জমি যিনি দক্ষতার সাথে বিলি বন্টনের ব্যবস্থা করে দেন, সেই দক্ষ ও যোগ্য সহকারি কমিশনার ভূমি ও প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট জনাব অমুক মহোদয়। --
' স্যার, দয়া করে মঞ্চে আসেন। '
এবারে মঞ্চে আসছেন আমাদের এই দুর্গম উপজেলার চোর, ডাকাত, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যিনি বড়ই নির্মম! সেই আমাদের অত্যন্ত দক্ষ ও যোগ্য পুলিশ অফিসার, থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জনাব অমুক মহোদয়।
এখন মঞ্চে আসার জন্য অনুরোধ করছি, অত্যন্ত জ্ঞানী, শিক্ষানুরাগী, আমাদের সকলের অতি প্রিয়মুখ মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার জনাব অমুক স্যারকে। স্যার আসেন।.... ঘোষণার এই পর্যায়ে, উপজেলা চেয়ারম্যান মহোদয় বলে উঠলেন -- " এই.. , ডাক্তার বাবুকে মঞ্চে ডাকেন। "
উপস্থাপক সম্ভবত একটু হোচট খেলেন। অতঃপর তিনি ঘোষণা করলেন --
এবারে মঞ্চে আসছেন.. মঞ্চে আসছেন....... ( সম্ভবত তিনি নাম ও পদবি ভুলে গেছেন!) আমাদের হাসপাতালের নবাগত ডাক্তার বাবু!
নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাকে মঞ্চের দিকে যেতে হলো।
মঞ্চের কাছাকাছি যেতেই ইউএনও মহোদয় হাঁক দিলেন - " এই! চেয়ার দাও,চেয়ার দাও!
মঞ্চের অতিথিদের জন্য কুশনওয়ালা চেয়ার তখন আর এক খানাও অবশিষ্ট ছিলো না।
স্কুলের দপ্তরি এক দৌড়ে দর্শক সারির একখানা প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে এনে মঞ্চের কিনারায় পেতে দিয়ে আমাকে যথেষ্ট সম্মানিত করলেন!
এরপর পুষ্পস্তবক দিয়ে বরন করার পালা।
তারপর কোরান তেলোয়াতের মধ্যে দিয়ে মূল অনুষ্ঠান পর্ব শুরু হলো।
আমি এই অপমান জনক অনুষ্ঠান থেকে পলায়নের একটি সম্মানজনক পথের সন্ধান করছিলাম।
হঠাৎ দেখতে পেলাম শামিয়ানার একদম শেষে উৎসুক জনতার মধ্যে দাঁড়িয়ে দারুন উৎসাহ নিয়ে অনুষ্ঠান উপভোগ করছে আমাদের ইউএইচএফপিও স্যারের পিয়ন মুসলেমউদ্দীন।
স্কুলের দপ্তরি মঞ্চের টেবিলে পানির জগ রেখে চলে যাচ্ছিলো। তাকে হাতের ইশারায় কাছে ডেকে আমাদের পিয়ন মুসলেমউদ্দীনকে দেখিয়ে ডেকে নিয়ে আসতে বললাম।
মুসলেমউদ্দীন এলে তাকে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলাম - " ইউএইচএফপিও স্যার তো নাই? " ও' বললো - " নাই স্যার "।
" একটা ভর্তি রোগি খারাপ আছে, তাই না?"
মুসলেমউদ্দীন বললো - " জ্বি স্যার "।
মুসলেমুদ্দীনকে পাঠিয়ে দিয়ে,আমি আস্তে আস্তে উঠে উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনও মহোদয়ের ( পাশাপাশি বসেছিলেন) কানে কানে হাসপাতালের জরুরি রোগীর কথা বলে অব্যাহতি চাওয়ামাত্র ওনারা দুইজনই আমার সাথে একমত পোষণ করলেন।
তার পাশেই সভাপতির চেয়ার অলংকৃত করে বসেছিলেন হেড মাষ্টার সাহেব।
তিনি খপ করে আমার হাত ধরে বললেন - " বুঝেছি, আপনি মনঃক্ষুন্ন হয়েছেন "।
আমি বললাম - " দেখেন, মনঃক্ষুন্ন হওয়ার মতো দক্ষতা বা যোগ্যতা আমার নাই। সত্যিই হাসপাতালে খারাপ রোগি আছে। আপনি কিছু মনে করবেন না। "
হাসপাতালে ফিরে ইনডোরে রাউন্ড দেয়ার পরে মনের মধ্যে একটি কথাই শুধু ঘুরপাক খেতে লাগলো!
উপজেলা সিস্টেম চালু হওয়ার আগে পর্যন্ত সরকারের 'একজন মাত্র প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার' থানা পর্যায়ে পোষ্টিং হয়েছিলো।
তার পদবি ছিলো টি এইচ এ ( থানা হেলথ এডমিনিস্ট্রেটর)! এবং তিনি ছিলেন একজন চিকিৎসক।
সেই সময় থানা পর্যায়ে সরকারের যে প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন, তার পদবি ছিলো সি ও ( সার্কেল অফিসার) এবং তিনি ছিলেন দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা।
উপজেলা হওয়ার পরে স্বাস্থ্য বিভাগের সেই টি এইচ এ, পদবিটি পরিবর্তন করে করা হয়েছে ইউএইচএফপিও ( উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অফিসার) ।
আমার ধারণা এই পদবিটি উচ্চারণ করা যেমন কঠিন, তেমনি সাধারন্যে বোধগম্য হওয়া আরো কঠিন।
প্রশ্ন হলো, এত বছর পরেও থানা পর্যায়ে একদম প্রথম নিয়োগ প্রাপ্ত সেই প্রথম শ্রেণির অফিসারটি সাধারণ মানুষের চেনা জানার বাইরে থেকে গেলো কেন!?
এর জন্য চিকিৎসকেরা নিজেরাই দায়ী! নাকি সরকারের অর্গানোগ্রামে কোন ত্রুটি বা কৌশল আছে!?
রাতে খাবার টেবিলে ইউএইচএফপিও রফিক স্যারকে স্কুলের অনুষ্ঠানের ধারাবিবরণী দিলাম
সব শুনে তিনি রেগে উঠে বললেন - " কোন শালার অনুষ্ঠানে আর যাওয়া হবে না। "
আমি বললাম - " সেটাতো পলায়নবাদিতা হলো । যেমন আমি অনুষ্ঠান স্থল থেকে পালিয়ে এলাম। পালিয়ে না এসে, বক্তব্য দেওয়ার পর্যায়ে এইসব অপমানের কড়া সমালোচনার সুযোগ নিতে পারতাম । "
তিনি বললেন - " ঠিকই বলেছেন, এইসব অনুষ্ঠান বর্জন করা যাবে না। তাতে তারা আরো বলার সুযোগ পাবে যে, ডাক্তার রা অসামাজিক! ডাক্তার রা শুধু টাকার পিছে ঘোরে!
এই সব অনুষ্ঠানে এটেন্ড করে কড়া প্রতিবাদ করার সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। "
( দশম - পর্ব) ডু দ্য নিডফুল ----
ইদানীং ইউএইচএফপিও স্যার ঘন ঘন ছুটিতে যাচ্ছেন, আর আমাকে অনাহুত দায়িত্বের বোঝা টানতে হচ্ছে।
দুপুরে খেয়েদেয়ে শোয়ার পর ভাত ঘুমে চোখ একটু জড়িয়ে ধরেছিলো।
হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ!
শুয়ে থেকেই বললাম, দরজা খোলা আছে ঢুকে পড়ুন।
মুখ চেনা এক ভদ্রলোক ঢুকে পড়লেন।
ঢুকেই তিনি আমার হাতে একটি চিরকুট ধরিয়ে দিলেন।
চিরকুট খুলে পড়তে লাগলাম।
পরিস্কার ইংরেজিতে লেখা আছে --
" ডিয়ার ডক্টর বাবু,
প্লিজ সাপ্লাই হিম টু (2) গ্লুকোজ স্যালাইন।
থ্যাংকস - ইয়োর্স - স্বাক্ষর অস্পষ্ট।
-- সিল -- উপজেলা চেয়ারম্যান,
চৌহালি, সিরাজগঞ্জ।
মনে মনে ভাবলাম, বেশতো চৌকস ইংরেজি লিখেছে! অথচ তার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে বাজারে ধূম্রজাল আছে। কেউ বলে গ্রাজুয়েট! কেউ বলে ম্যাট্রিক পাশ করে নাই!
ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম -" বাড়ি কোথায়? "
তিনি বললেন- " এখান থেকে পাঁচ মাইল দুরে চর কোদালিয়া গ্রামে। "
" কি কাজ করেন? "
তিনি বললেন - " উপজেলা ইঞ্জিনিয়ার অফিসের স্টেনোগ্রাফার। "
আমি জিজ্ঞেস করলাম - " এই যে চেয়ারম্যান মহোদয় দুইটি স্যালাইন দেওয়ার জন্য লিখে দিয়েছেন এটা কী ওনার জন্য না আপনার জন্য? "
তিনি বললেন - " আমার জন্য। "
" আপনি দুইটি স্যালাইন দিয়ে কি করবেন?'' " আমার আব্বা খুব অসুস্থ, তার জন্য নিয়ে যাবো। "
" আপনার আব্বা কোথায় আছেন? "
" বাড়িতে আছেন। "
"আপনার আব্বার যে দুইটা গ্লুকোজ স্যালাইন লাগবে একথা কে বলেছে? "
তিনি বললেন - " কেন, পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন সবাই বলেছে, বাড়ির পাশের গ্রাম ডাক্তার সোলেমানও বলেছে!। "
আবারো জিজ্ঞেস করলাম - " আপনার আব্বা কেমন অসুস্থ, কী সমস্যা হচ্ছে? "
তিনি বললেন - " আব্বা দুর্বল হয়ে বিছানায় পড়ে গেছে! শ্বাস কষ্ট হয়, হাত পায়ে পানি ধরে গেছে! "
আমি বললাম - " শোনেন, আপনার কথা শুনে আপনার আব্বার অবস্থা বেশ জটিলই মনে হচ্ছে! এক কাজ করেন , আগামীকাল সকালে কষ্ট করে আপনার আব্বাকে নিয়ে আসেন। আমরা কয়েকজন ডাক্তার মিলে প্রয়োজনে মেডিকেল টিম গঠন করে ওনাকে দেখবো। প্রয়োজন বোধে হাসপাতালে ভর্তি করবো। মাত্র দুইটা কেন ওনার যদি দশটা স্যালাইন লাগে তার ব্যবস্থা করা হবে। অন্যান্য যে সমস্ত ওষুধ লাগবে তাও আমাদের সাপ্লাই অনুযায়ী ব্যবস্থা করার চেষ্টা করবো। "
এতো কথা বলার পরও তিনি ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলেন।
আমি বললাম " ঠিক আছে এখন যান, আগামীকাল আসেন। "
তিনি রাগতস্বরে বললেন - " তা হলে স্যালাইন দিবেন না? "
আমি বললাম - " না। "
তিনি অগ্নি দৃষ্টিতে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন যেন আমাকে ভস্ম করে দিবেন! তার পর ঘর থেকে বের হয়ে ধরাম শব্দে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেলেন!
মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো।
একেতো ভাত ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলো, দ্বিতীয়ত এই লোক যে অগ্নিমূর্তি নিয়ে ফিরে গেলো! তাতে চেয়ারম্যান সাহেবের কাছেতো উল্টা সিধা নানান কথা লাগাবে! চেয়ারম্যান আবার না জানি কি মূর্তি ধারন করে! যে বদরাগী মানুষ! এর আগে সোনালি ব্যাংকের ম্যানেজারকে ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়ে দিয়েছিলেন! আমি এতো বোকামি করলাম কেন! চেয়ারম্যান স্বয়ং যেখানে সিল ছাপ্পর মারা চিরকুট পাঠিয়েছেন, সেই চিরকুট ডকুমেন্ট হিসাবে রেখে স্টোর কিপার কে দুইটা স্যালাইন দিয়ে দিতে বলতে পারতাম! ল্যাঠা চুকে যেতো! এগুলিতো আমার পৈত্রিক সম্পত্তি না!
সন্ধ্যার পরে মন খারাপি নিয়েই হারিকেনের টিমটিমে আলোতে সহকারী জজ এনামুল ভাইয়ের বাসায় কার্ড খেলতে বসেছিলাম।
এমন সময় জজ সাহেবের পিয়ন এসে খবর দিলো যে নীচে চেয়ারম্যান সাহেবের পিয়ন এসেছে। সে বলে গেলো যে,' চেয়ারম্যান সাহেব ডাক্তার বাবুকে সালাম দিয়েছে।'
আমি তাৎক্ষণিকভাবে বুঝে গেলাম এই সালামের অর্থ কি!?
খেলা ছেড়ে উঠে এসে ক্ষুব্ধ মনে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য এক ধরনের মানসিক প্রস্তুতি নিতে নিতে চেয়ারম্যান মহোদয়ের রুমে ঢুকে পড়লাম।
যা আশংকা করেছিলাম তাই! সেই কালপ্রিট এক কোনায় বসে আছে!
চেয়ারম্যান মহোদয় বললেন - " কী ডাক্তার বাবু! দুইটা স্যালাইন দিতে বলেছিলাম তা দেন নাই যে! ? "
আমি বললাম - " স্যালাইন দিবো না তা বলি নাই। আপনার কাছে উনি হয়তো এক ধরনের কথা বলেছে! কিন্তু তার সাথে আমার এই এই কথাবার্তা হয়েছে। আমি বিস্তারিত বর্ননা দিলাম। "
চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, " কীরে, ডাক্তার বাবু তো ঠিকই বলেছে। আগামীকাল তোর আব্বাকে নিয়ে আয়। "
এইবার আমি চান্স নিলাম, বললাম -" " আপনার সাথে আমার একটু প্রাইভেট কথা আছে। "
লোকটা বের হয়ে যাবার পর কোন রকম ভনিতা না করে আমি সরাসরি বললাম - - " আপনি আমাকে যে চিঠি লিখেছেন তার ভাষা ঠিক হয় নাই। "
চেয়ারম্যান সাহেব আমার কথা শুনে যেন চমকে উঠলেন! তার মুখের ওপর কোন অফিসার এইরকম ভাবে কথা বলতে পারে এটা হয়তো তার কল্পনাতেই নাই!
তিনি বললেন - " কেন!? কেন!? কি হয়েছে!? "
আমি শান্তভাবে বললাম - " আপনি লিখেছেন, ২টা গ্লুকোজ স্যালাইন দিতে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে আমাদের কাছে গ্লুকোজ স্যালাইন নামে কোন স্যালাইন নাই। আমাদের কাছে ৫ পদের স্যালাইন আছে - ১) ৫% ডেক্সট্রোজ একুয়া।
২) ৫% ডেক্সট্রোজ স্যালাইন
৩) ১০% ডেক্সট্রোজ স্যালাইন।
৪) নরম্যাল স্যালাইন।
৫) কলেরা স্যালাইন।
কিন্তু কোন গ্লুকোজ স্যালাইন নাই।
দ্বিতীয়ত কথা হলো, এই রোগীর স্যালাইন লাগবে কি লাগবে না এটা আপনার জানার কথা নয়, কারন আপনি চিকিৎসক নন।
আবার আমি ও রোগী না দেখা পর্যন্ত বলতে পারবো না যে, এই রোগির স্যালাইন লাগবে কি লাগবে না, স্যালাইন যদি লাগেও সেইটা কোন স্যালাইন লাগবে তা রোগির অবস্থা বুঝে আমরা ঠিক করে থাকি।
এই রোগীর ব্যাপারে যতটুকু আমি জেনেছি তাতে তার হাত পায়ে পানি এসেছে! তার মানে তার হার্টের সমস্যা বা কিডনির সমস্যা থাকতে পারে!
এমতাবস্থায় যদি আমরা স্যালাইন দিই তাহলে রোগিটা স্যালাইন দেওয়ার কারনে মারা যাবে!"
চেয়ারম্যান সাহেব চমকে উঠে বললেন--- " বলেন কি! , বলেন কি! কী সাংঘাতিক কথা!? "
আমি বললাম, " হ্যাঁ, সাংঘাতিক কথাই।
এটা ওষুধ! এটা কোন রিলিফ সামগ্রী নয় যে, আপনি বলে দিলেন ৫ কেজি চাউল দিয়ে দাও, আর আমরা সঙ্গে সঙ্গে তা দিয়ে দিলাম! "
চেয়ারম্যান সাহেব মাথা দোলাতে দোলাতে বললেন - " বলেন তো ডাক্তার বাবু কী করা যায়! আমরাতো রাজনীতি করি, জনপ্রতিনিধি! মানুষ তো আমাদের কাছে আসবেই! চিঠিও লিখে দিতে হবে! "
আমি বললাম, - " হ্যাঁ, অবশ্যই চিঠি লিখবেন। শুধু ভাষাটা একটু পরিবর্তন করে ফেলবেন। যেমন - ' প্লিজ সাপ্লাই হিম টু গ্লুকোজ স্যালাইন ' এটা না লিখে লিখবেন -- ' প্লিজ সি হিম এন্ড ডু দ্য নিডফুল ' --
" রোগি দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করুন। "
একথা তার খুব পছন্দ হয়ে গেলো! চেয়ারম্যান মহোদয় গদ গদ হয়ে বললেন -- " রাইট! ইউ আর রাইট!! "
( একাদশ পর্ব)(দেখামাত্র গুলি)----
একেবারে চাকুরি জীবনের গোড়ার দিকের কথা ।
মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার পরে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অফিসার আমাকে মহিলা আউটডোরে রোগী দেখার জন্য মৌখিক নির্দেশনা দিলেন।
এর কারন পরে বুঝতে পেরেছিলাম। পুরুষ ও শিশু আউটডোরে তুলনা মূলক ভীর কম। এই কারনেই হয়তোবা অন্যান্য কলিগ পুরুষ ও শিশু আউটডোরে বসতে শুরু করেছে। মহিলা আউটডোর তখনো খালি পরে আছে।
চা খেয়ে নির্ধারিত রুমে বসে আছি রোগী দেখার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে।
''আচ্ছালামালাইকুম" বলে ঢুকলেন একজন মাঝবয়সী লোক। ছোট ছোট করে কাটা আউটডোরের সিল ছাপ্পর মারা সাদা কাগজের স্লিপ আমার টেবিলে সাজিয়ে রেখে চলে যাচ্ছিলেন।
হাতের ইশারায় ডেকে পরিচয় জানতে চাইলাম।
তিনি বললেন তার নাম রমজান আলি।
তিনি এই হাসপাতালের ' মালি' পদে আছেন। তবে বাগান না থাকায় বড় স্যার তাকে আউটডোরে ডিউটি করতে বলেছেন।
বেশ! বেশ!, জিজ্ঞেস করলাম - ''এখানে রোগী কেমন হয়? ''
রমজান জবাব দিল--" রুগি ম্যালা স্যার, বানের পানির লাহান ঠেকায়া রাখা যায় না। "
রমজান কে বললাম - '' টেবিলে বা ড্রয়ারে কোন প্রেশার মাপার যন্ত্র দেখছিনা যে! ''
রমজান অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল --"কোন স্যারতো চায় না ; পাশের ঘরে আছে, আইন্যা দিমু? "
বললাম - '' আনো। ''
নিতান্ত অনিচ্ছা সত্বেও রমজান পাশের মেডিকেল অফিসারের রুম থেকে প্রেশার মাপার যন্ত্র এনে তাচ্ছিল্যের সাথে আমার টেবিলে রেখে দিলো।
ইতিমধ্যে ফার্মাসিস্ট সাহেব কয়েকটি ওষুধের নাম লেখা একটি ছোট কাগজ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে গেলেন - " এটি হল আজকের সাপ্লাইকৃত ওষুধের তালিকা। "
দেখলাম লেখা আছে -- ১) পি, সি, ( মানে প্যারাসিটামল) - ২০০।
২) হিস্টা (মানে হিস্টাসিন) - ২০০।
৩) এন্টাসিড -- ৩০০।
৪) এফ এস ( ফেরাস সালফেট ; মানে আয়রন ট্যাবলেট) --- ৫০০।
আরো ৩/৪ টি আইটেম, সংখ্যা উল্লেখ পুর্বক লেখা আছে।
আমি বললাম -- " ওষুধের লিস্ট বুঝলাম। তার পাশে এই সংখ্যা লেখা কেন?"
তিনি বুঝিয়ে বললেন - " এগুলি আজকের দিনের জন্য বরাদ্দ। এর বেশি আজ খরচ করা যাবে না।"
আমি বোকার মত জিজ্ঞেস করলাম "কেন?"
তাতে তিনি যা বললেন তার সারমর্ম হল এই যে, স্টোর কিপারের কাছে যা স্টকে আছে তা পর্যাপ্ত নয়।
তিনি জেলা সিভিল সার্জন অফিস থেকে প্রতি তিন মাসের কিস্তিতে মালামাল নিয়ে আসেন।
সেই মালামালের বড় অংশ থাকে ইনডোরে ভর্তি রোগিদের জন্য। কিছু মালামাল জরুরি বিভাগের জন্য। আর সামান্য কিছু আউটডোরের জন্য।
আউটডোরের প্রাপ্য মালামালের সবটাই যদি আউটডোরে একবারে সাপ্লাই দিয়ে দেয়া হয় , তাহলে তা দিয়ে সাকুল্যে পনের দিন চলতে পারে। বাকী আড়াইমাস আউটডোর বন্ধ রাখতে হবে। " সরকারি অফিসতো বন্ধ রাখা যায় না স্যার!"
তাই এটা হল স্থানীয় ব্যবস্থাপনা। যাতে রেশনিং সিস্টেমে প্রতিদিন আউটডোর চালু রাখা যায়!
আমি বললাম - " আচ্ছা বুঝলাম, এখন আজকের যে বরাদ্দ, সেটা যদি আধাঘণ্টার মধ্যে শেষ হয়ে যায় তখন উপায় কি হবে? "
তিনি বললেন - " কোন উপায় নাই স্যার, শেষ হওয়ার পর শেষ। এরপর রোগি আসলে 'ওষুধ নাই ' বলে বিদায় করে দিতে হবে। "
আমি বললাম - " এই যে ওষুধ নাই, রোগিকে এ কথা কে বলবে? ডাক্তার বলবে, নাকি আপনি ফার্মাসিস্ট বলবেন ? "
ফার্মাসিস্ট মহাশয় বললেন -- " স্যার এটাতো ডাক্তার স্যারেরা বলবেন, কারন রোগিরাতো ডাক্তারের কাছে আসবেন। "
ফার্মাসিস্টের কাছে এই নসিহত শুনে মন খারাপ হয়ে গেল। রেডিও টেলিভিশনে এরশাদ স্বয়ং এবং তার মন্ত্রীরা অহরহ বলে যাচ্ছেন যে, নতুন নতুন হাসপাতাল করা হচ্ছে! চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে!পর্যাপ্ত ওষুধ পত্র দেওয়া হচ্ছে! স্বাস্থ্য সেবা জনগের দোরগোড়ায় পৌছে দেওয়া হচ্ছে! ইত্যাদি ইত্যাদি। আর তার বিপরীতে আমরা নিয়োগপ্রাপ্ত ডাক্তারবাবুরা বলবো - "ওষুধ নাই, ওষুধ নাই। "
"আমাদের পিঠের চামড়া থাকবেতো!?"
কিছুক্ষণ পর দুই একজন করে মহিলা রোগী আসতে শুরু করলো।
তাদেরকে পাশের টুলে বসিয়ে, ধীরে সুস্থে জিজ্ঞাসাবাদ করে, টুকটাক পরীক্ষা করে, তাদের নিয়ে আসা ছোট্ট টিকেটে প্রেস্ক্রিপশন লিখে দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম।
কিন্তু দেখা গেল তারা বড়ই অসহিষ্ণু!
টুলে বসিয়ে, সমস্যার কথা জিজ্ঞেস করার আগেই তারা কেউ বলল - " 'আমাশার -' ওষুদ দ্যান, কেউ বলল - ' গ্যাসের ওষুদ দ্যান।
আমি এসব কথায় বিভ্রান্ত না হয়ে তাদেরকে টুলে বসিয়ে কিছু কথাবার্তা জিজ্ঞেস করে প্রেস্ক্রিপশন সহ দুই একটি ওষুধ যেগুলি সাপ্লাই আছে সেগুলি দিয়ে বিদায় করতে লাগলাম।
কিছুক্ষনের মধ্যে মনে হল বাইরে বেশ শোরগোল লেগে গেছে!
মুখ তুলে দেখলাম অসংখ্য মহিলা! কারো কোলে দুধের বাচ্চা, হাতে ধরা আরেক বাচ্চা! পরস্পর ঠেলাঠেলি করতে করতে চিৎকার চেঁচামেচি করে গোটা বারান্দা নরক গুলজার করে ফেলেছে!
মুহুর্তের মধ্যে এত মানুষ কোত্থেকে এলো বুঝতেই পারিনি। রমজান আলি দরজার একটি কপাট বন্ধ করে দিয়ে এক পাল্লা খোলা রেখে, চিৎকার করে শিশুসমেত উশৃংখল নারীদের লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। মনে হচ্ছে মহিলারা দরজা ভেঙে একবারে ঘরের মধ্যে হুরমুড় করে ঢুকে পড়বে!
আমি কিছুটা থতমত খেয়ে গেলেও রোগী দেখতে মনোনিবেশ করলাম।
কিছুক্ষন পরেই রমজান ধাক্কাধাক্কি করতে করতে ভিতরে ঢুকে এসে আমার কানে কানে বলে গেলো-- " স্যার, 'হাত চালান'। "
"হাত চালান! " মানে আমাকে দ্রুত বেগে রোগি দেখতে হবে!?
আমি ছিলাম বরাবর এক বোকা কিসিমের মানুষ।
কিভাবে দ্রুত রোগি দেখতে হয় তখনো তা আমি শিখে উঠতে পারিনি।
এভাবে প্রতিদিন সকাল সাড়ে নয়টা থেকে ডাক্তার হিসাবে রোগি দেখা নয়, যেন এক প্রচন্ড ঘুর্নীঝড়ের মোকাবেলা চলতে লাগলো।
আধাঘণ্টার মধ্যে ওষুধ শেষ হয়ে গেলে আবার নতুন
গজব শুরু হতো -- " ওষুধ নাই ক্যান ? , সরকার ওষুধ ঠিকই দ্যায় , ডাক্তারেরা বেঁইচ্যা খায়!, ওষুধ নাইতো এখানে বইস্যা আছেন ক্যান?
এসব কথাবার্তা ইতিমধ্যে গা সহা হয়ে গেছে।
প্রাণপণ চেষ্টা করছিলাম, যাতে ওষুধ না দিয়েও ভালো প্রেসক্রিপশন দিয়ে বিদায় করা যায়।
তার জবাবে উলটা মুখ ঝামটানি শুনতে হতো --
" ওষুদ যুদিল বাইরে থেইক্যাই কিনা খামু তাইলে হাসপাতালে আপনেগারে কাছে আসমু ক্যা ? "
কখনো কখনো বলতাম - " তখন কোথায় যেতেন? "
তাদের উত্তর হত - " ক্যা, ডাক্তারের কাছে যামু। "
এই ডাক্তার মানে - 'গ্রাম ডাক্তার ', পল্লি চিকিৎসক! '
এই ভাবে কয়দিন চলার পর নিজের মধ্যে একধরনের হীনমন্যতা শুরু হল। নিশ্চয়ই আমি সব কিছু ঠিকমত ম্যানেজ করতে পারছি না। কোথাও হয়তো আমার ত্রুটি আছে। আমার রুমেই সবচেয়ে বেশি গ্যাঞ্জামের উৎপত্তি হচ্ছে । এর মাঝে বড় স্যার একদিন আমার রুমে উঁকি মেরে দেখে গেছেন।
আমার মনে হল, নতুন মেডিকেল অফিসার হিসাবে আমার অদক্ষতা ওনার কানে চলে গেছে!
রমজানের পরামর্শমত আমার 'হাত যথেষ্ট চালু' হয় নাই। এসব চিন্তা করে আমার হীনমন্যতা আরো বেড়ে যেতে লাগলো।
ইতিমধ্যে এক অদ্ভুত জিনিষ খেয়াল করলাম, আমার পাশের রুমের সিনিয়র মেডিকেল অফিসার শমসের ভাইয়ের রুমে কখনোই কোন ভীরভাট্টা নাই, কোন গ্যাঞ্জামও নাই।
এতে আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে, আমার অদক্ষতাই আমার নাকানিচুবানি খাওয়ার অন্যতম কারন।
একদিন আউটডোর শেষে শমসের ভাই চা খেতে ডাকলেন।
চা খেতে খেতে কথাটা পেরেই ফেললাম।
শমসের ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম -- " আমার রুমে সারাক্ষণ ভীর আর গ্যাঞ্জাম লেগে থাকে, অহরহ গঞ্জনা সহ্য করতে হচ্ছে! , আপনার রুমে কোন ভীর নাই, গ্যাঞ্জাম নাই, বসে বসে চা খান আর পেপার পড়েন, রহস্য টা কি? "
শমসের ভাই এক রহস্যময় হাসি দিয়ে বললেন --
" যেদিন রমজান আলি আমার ড্রয়ার থেকে প্রেশার মাপার মেশিন নিয়ে আপনার টেবিলে দিয়েছে, সেদিনই বুঝেছি আপনার রুমে গ্যাঞ্জাম হবে, আপনি বিপদে পড়বেন। "
আমি কিছু বুঝে উঠতে না পেরে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম শমসের ভাইয়ের রহস্যময় হাসির দিকে।
শমসের ভাই আবারো বললেন -- " দাদা, এভাবে হবে না। "
আমি বললাম - " কিভাবে হবে? আমাকে কি করতে হবে? "
তিনি বললেন -"দেখামাত্র গুলি করতে হবে! "
তিনি ব্যাখ্যা করে বললেন - " এখানে ডাক্তারি করার কোন দরকার নাই। রোগি আসা মাত্র যে যা চায় দিয়ে দিবেন। 'জ' উচ্চারণ করার সাথে সাথে বুঝে নিবেন জ্বরের কথা বলছে, সোজা পিসি ( প্যারাসিটামল) লিখে দিয়ে দিবেন। সর্দি কাশি বলার সাথে সাথে হিস্টা (হিস্টাসিন) লিখে দিবেন । যখন অন্য ওষুধ সব শেষ হয়ে যাবে তখন কোন কিছুই আর শোনার দরকার নাই ;যতক্ষন এফএস (আয়রন ট্যাবলেট) অথবা বিসি ( বি কম্পলেক্স ট্যাবলেট) আছে, ততক্ষন তাই দিতে থাকবেন ;এগুলিতো শরীরের কোন ক্ষতি করবে না। আবার রোগিদেরও পাওনা ওষুধ পাওয়া হয়ে গেল!।
যখন সব শেষ হয়ে যাবে তখন দেখবেন, ফার্মাসিস্ট সাহেব একটা কাগজে লিখে দিয়ে যাবে -- " এসব ওষুধ নাই।"
যে সব রোগি পরে এসে হাউকাউ করবে ' ওষুধ নাই কেন? -- তাদেরকে মুখে কিছু বলার দরকার নাই ; ফার্মাসিস্ট এর "কোন ওষুধ নাই "লেখা কাগজটি দেখিয়ে দিবেন! "
এইভাবে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমিও এক সময় " দেখামাত্র গুলি চালানোতে " অভ্যস্ত হতে থাকলাম !!!।।।
পাদটীকা ঃ
( পঁয়ত্রিশ বছর আগের এই পদ্ধতি " দেখা মাত্র গুলি "
এখনো বহাল তবিয়তে চলমান আছে।
এর সুদূর প্রসারী ফলাফল কি হয়েছে বা হচ্ছে! বাংলাদেশের সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে! বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এ থেকে মুক্ত কিনা? বাংলাদেশের নিম্নবিত্তের মানুষ মেডিকেল ভিসা নিয়ে কেন বন্যার পানির লাহান ভারতে চলে যাচ্ছে!?
এসব বিষয় পর্যায়ক্রমে আলোকপাতের ইচ্ছা রইল।)
( যখন ছাত্র ছিলাম)
------ ( দ্বাদশ - পর্ব)( পাঙ্গাশ) -----
গত পরশু সারাদিন জার্নি করে রাজশাহী ডিডি অফিসে এসেছিলাম।
গতকাল সারাদিন ঘুর ঘুর করেও কাজ হলো না। আবার কষ্টকর ফেরত যাত্রা।
অতঃপর খুব সকালে ভগ্ন মনোরথে রাজশাহী থেকে বাসে চেপে বগুড়া পৌছে গেলাম।
জার্নি করলে আসলেই খুব ক্ষিদে পায়। তার উপরে বাস স্ট্যান্ডের আশেপাশে ছোটো ছোটো খাবারের হোটেলের পাশ থেকে যখন
তারস্বরে ডাকা ডাকি শুরু হয় ' গরু, খাসী, রুই, ইলিশ, পাঙাশ! আসেন ভাই, আসেন! তখন পেটের ক্ষিধে আরো চাগাড় দিয়ে ওঠে।
ঢুকে পড়লাম এক রেস্তোরাঁয়। খাবার কী আছে জিজ্ঞেস করতেই, ম্যানেজার ও 'টেবিল বয়' সমস্বরে বলে উঠলো, "আরিচার পাঙ্গাশ মাছ আছে! খুব ভালো!"
আরিচার পাঙ্গাশ মানে, যমুনার পাঙাশ!ভাল হবারই কথা, আচ্ছা দাও, পাঙাশ মাছই দাও।
হ্যাঁ, খেতে খেতে বোঝা গ্যালো, যমুনারই মাছ! সেই রকম তৈলাক্ত! সেই রকম স্বাদ!
খেয়েই আবার রওয়ানা হতে হলো। এবার সিরাজগঞ্জের বাস।
সিরাজগঞ্জের বাস ধরে সিরাজগঞ্জ ঘাটে পৌছানোর পর এবার লঞ্চ।
লঞ্চে যমুনা নদী পার হয়ে ভুয়াপুর ঘাটে পৌছাতে বেলা সাড়ে তিনটা বেজে গেলো।
সেখানেও ডাকাডাকি ; মুর্গী, কবুতর, বাচা মাছ, পাঙাশ!....।
শুনেছি ভুঁয়াপুর ঘাটে নাকি ব্যাঙের মাংসকে কবুতরের মাংস বলে চালানো হয়!
ক্ষিদায় পেট চোঁ চোঁ করলেও দৌড়ে গিয়ে বাস ধরতে হবে! তাই যমুনাতীরের ডাকা ডাকি উপেক্ষা করতে হল।
বেলা সাড়ে চারটায় টাংগাইল পৌছে গেলাম।
টাংগাইল পৌছালেই হবেনা, আমাকে ধরতে হবে নাগরপুরের বাস। সেটা আবার শহরের দক্ষিন-পশ্চিম কোনায়! দে দৌড় রিক্সায়।
কিন্তু ঐ যে ডাকে! খাসি, মুর্গি, রুই মাছ!
এবার আর উপেক্ষা করতে পারলাম না।
ঢুকে গেলাম ভিতরে, কি আছে, কি আছে, বলতেই সমস্বরে আবারো জবাব পেলাম ; "আরিচার পাঙ্গাশ খান, খুব ভাল।"
"অন্য কোন মাছ নাই?" '
"পাঙ্গাশ খান স্যার, যমুনার টাটকা পাঙাশ, সেই রকম স্বাদ! "
"আচ্ছা দাও", আবার স্বাদের পাঙ্গাশ মাছ দিয়ে ভাত খাওয়া হলো।
আমার গন্তব্য চৌহালি পৌছাতে রাত ৮টা বেজে যাবে! সেখানে কেউ আমার জন্য খাবার নিয়ে বসে থাকবে না।
খাবার পাওয়া যেতে পারে ভাগ্যক্রমে, না পাওয়ার সম্ভাবনা ষোলআনা। এরকম পরিস্থিতিতে ক্ষিধাটা আরো বেশি চাগাড় দিয়ে ওঠে। আর ক্ষিধার পেটে স্বাদটা একটু বেশি লাগাই স্বাভাবিক।
যাহোক, খাওয়া শেষে আবারো নাগরপুরের বাসে চেপে এলাসিন ঘাট ; সেখান থেকে ঠেলা নৌকায় চেপে ধলেশ্বরী নদী উজিয়ে শাহজাহানপুর পৌছানো, সেখান থেকে দুই মাইল পায়ে হেঁটে রাত্রি সাড়ে আটটা নাগাদ চৌহালি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পৌছানো সম্ভব হলো!!
চৌহালি পৌছানোর পর পরই টের পেলাম, কেমন যেন সাজ সাজ রব।!
কি ব্যাপার! , কি ব্যাপার! হাসপাতালের গেটে মখদুম ভাইয়ের সাথে দেখা হলো।
" দাদা আয়া পড়চেন, ঠিক টাইমেই আয়চেন, নন যাই, - মিরকুটিয়া যাওন লাগবো! "
"কেন ভাই! মিরকুটিয়া কেন?"
"আবে, চৌহালি চাকরি করতে আয়চেন ; আর যমুনা নদীর পাঙ্গাশ মাছ ধরা দ্যাখবেন না! আপনার জীবনই বৃথা হয়া যাইব্যো! "
"ব্যাপারটা কি খুলে বলেন তো মকদুম ভাই!"
" দাদা, রাজশাহী থেন সারা দিন জার্নি কইর্যা আয়চেন, অহন একটু বিশ্রাম করেন, রাত এগারো টার দিকে আপনারে ডাইক্যা লইয়্যা যামুনে। "
সত্যি সত্যিই সেই এডভেঞ্চারে গিয়েছিলাম।
মকদুম ভাইয়ের মোটর সাইকেলের পিছনে চেপে হাসপাতাল থেকে ৬ মাইল দুরের মিরকুটিয়া ঘাটে।
সেখান থেকে নৌকায় চেপে অকুস্থলে!!
অনেক নৌকা! অনেক হাঁক ডাক! চিৎকার, চেঁচামেচি,টর্চের ধাঁধানো আলো!
রাতের আঁধারে তেমন কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
মকদুম ভাই ব্রিফিং করলেন, -"এইদিনের প্রস্তুতি অনেক দিনের প্রস্তুতি!
বন্যার পানি কমতে থাকার শুরুতে জেলেরা বুঝতে পারে নদীর কোন এলাকায় ছোট পাঙ্গাশের ঝাঁক বিচরন করে! ঐ বিস্তির্ন এলাকাজুড়ে ওরা নিয়মিত বস্তায় বস্তায় চাউল ছিটাতে থাকে।"
'নদীর মধ্যে বস্তায় বস্তায় চাল ছিটানো, অদ্ভুত ব্যাপারতো!'
"হ্যাঁ, ওরা আগের বছরেই নদীর এই জল মহাল গুলি সরকার থেকে লিজ নিয়ে নেয়।
৪/৫ মাস পরে এখন এই মাছ ধরার সময় ওরা প্রশাসন, ডিসি, এসপি, থানাপুলিশ, চেয়ারম্যান, মেম্বার, সবাইকে খবর দিয়েছে। কোটি কোটি টাকার মাছ ধরা হচ্ছে! গত দুই দিন হল, আজ শেষ দিন!!"
ভোরের আলো সামান্য ফুটতেই অবাক হয়ে দেখলাম, বিশাল জাল টেনে ঘেরা হয়েছে,! আস্তে আস্তে তীরের দিকে আসছে ;দূর থেকে দেখা যাচ্ছে যেন ট্যাংরা মাছের ঝাঁক! ।
পুলিশের নৌকা, বড় সাহেবের স্পিড বোট, হাজারো মানুষ, সে এক এলাহি কান্ড! ।
এখান থেকে আড়তদারেরা নৌকা বোঝাই করে মাছ নিয়ে যাবে আরিচা ঘাটে। সেখান থেকে চালান হবে সারা দেশে।
এতক্ষনে বুঝতে পারলাম বগুড়া, ভুয়াপুর,টাংগাইল সব খানের পাঙ্গাশের মোজেজা!।
উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেবের বদান্যতায়
ও ক্ষমতার প্রতাপে উপজেলার সকল অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য গরুর গাড়ী বোঝাই পাঙাশ মাছ এলো, অফিস অনুযায়ী বন্টন হলো।
স্বাস্থ্য কম্পলেক্স পেল তিনটি ; একেকটির ওজন ষোল সতেরো কেজি!
পর পর তিন দিন পাঙাশ মাছ খাওয়া হলো। কারন বিদ্যুৎ নাই, ফ্রিজও নাই।
সেই ছিল যমুনা নদীর স্বাদের পাঙাশ!
এই কাহিনীর অবতারণা আসলে পাঙাশ মাছ খাওয়া নয়,। পাঙাশ মাছকে কেন্দ্র করে যমুনার জল মহালে যে অভূতপূর্ব
কর্মযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেছি, তা যমুনার এই দুর্গম চরে চাকুরী সূত্রে না গেলে অজানাই থেকে যেতো! ! ।।
(পাদটীকা ঃ পাঠক, বর্তমানের চাষ করা পাঙ্গাশ মাছের সাথে সেই পাঙ্গাশ মাছকে একাকার করে ফেলবেন না যেন!!)
( --------- চলবে --------)
--- ডাঃ সুকুমার সুর রায়।।
প্রিয় পাঠক,
ডাক্তার প্রতিদিনে প্রকাশিত প্রথম ৪ পর্বের লিঙ্ক ::
এর সঙ্গে পরের ৪ পর্ব ( ৫-৮) পর্বর লিঙ্ক পাবেন।
আপনার মতামত দিন: