Dr. Aminul Islam

Published:
2020-09-22 01:49:42 BdST

সোনার হরিণ :এক ডাক্তারের জীবনের সোনালী রুপালি কাহিনি : টিএ বিল ও আধা মোবাইল কোর্ট



ডাঃ সুকুমার সুর রায় লিখেছেন ধারাবাহিক ডাক্তারী জীবনের কাহিনি।

 

( ডাক্তার প্রতিদিনে প্রকাশিত প্রথম ৪ পর্বের লিঙ্ক লেখার শেষে রয়েছে )

 

ডাঃ সুকুমার সুর রায়
______________________________

৫.
সকালে রেডি হয়ে মনে হলো নয়ারহাট হয়েই যাই। তাদের সাথে স্পিডবোটে চৌহালি পৌছে, দুই চার দিন বেশি ছুটি নিয়ে বাড়িতে কাটিয়ে আসি।
সেই উদ্দেশ্যেই সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় থেকে ধামরাই গামী একটি মিনিবাসের হাঁক ডাকে তাতে উঠে চেপে বসলাম।
মুড়ির টিন মার্কা হলেও দেখলাম বাসের গায়ে স্পষ্ট বাংলা অক্ষরে বিপদ থেকে উদ্ধারের দোয়া লেখা আছে -- " লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্তি কুন্তু মিনাজ্জোয়ালেমিন "।
সাইয়েন্সল্যাব এর মোড় থেকে ছেড়ে, মিনিবাসটি যেন আগে পিছে শিল পাটার মশলা পেষার মত ঘষাঘষি করতে লাগলো। এক গজ এগিয়ে আবার তিন গজ পিছিয়ে আসতে লাগলো। হেল্পারের কান ফাঁটানি চিৎকার সমানে চলতে লাগলো। -- এই যে, ধামরাই!ধামরাই! ধামরাইএর ফাস্ট টিপ! ফাস্টটিপ চইল্যা গ্যালো।।ডাইরেক্ট ধামরাই! গেটলক! গেটলক !!
উচ্চঃস্বরে চিৎকারের পাশাপাশি মুড়ির টিনের গায়ে সমানে ধমাধম থাপড়াতে লাগলো বাসের হেল্পার!
এসব বিষয়ে আমার কোন বিকার নাই।
ড্রাইভারের হাতের বাঁয়ে, সিট কভারের বাম পাশে যে লম্বা এক ফালি সিট থাকে, সেখানে আমি বসে পড়লাম। ঘাড় উঁচিয়ে দেখে নিলাম । " মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন" এই রকম কিছু লেখা নাই দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম!
মিরপুর রোড ধরে গড়াতে গড়াতে জোরে জোরে থাপড়াতে থাপড়াতে প্যাসেঞ্জার উঠানো হতে লাগলো।
একসময় ছোট্ট মিনিবাসের মধ্যে তিলধারণের জায়গা আর অবশিষ্ট রইলো না।
যাত্রীদের মাঝে অসহিষ্ণুতা দেখা দিল।
কার পায়ে কার জুতার পাড়া লাগলো! কার মাথায় কার কনুইয়ের গুঁতা লাগলো! কার ব্যাগের কোনায় কে গুঁতা খেলো, এসব নিয়ে মৃদু গুঞ্জন উঠলো।
তবে বোঝা গেল, সবাই ধামড়াইয়ের অফিস যাত্রী এবং ডেইলী প্যাসেঞ্জারি করে অভ্যস্ত।
গাবতলি বাসটার্মিনাল ছাড়তেই বাসের গতি রকেটের মত বেড়ে গেলো। হেল্পারের থাপড়ানিও সমান গতিতে চলতে লাগলো ; অফিস টাইমে পৌছানোর জন্যে সময়ের মেকআপ দিতে হবে যে !
তখন ঢাকা আরিচার রাস্তা ছিল সিঙ্গেল রাস্তা।
জাতীয় স্মৃতিসৌধ এলাকা পার হয়ে গিয়েছিলাম ।
পেছন থেকে একটি দূরপাল্লার বিআরটিসির বাস অনবরত হর্ন বাজিয়ে সাইড চাচ্ছিলো।
আমাদের হেল্পার তার স্বভাব সুলভ অনবরত থাপ্পড় বাজিয়ে সাইড না দেওয়ার পক্ষে জোড়ালো অবস্থান জানান দিচ্ছিলো।
ড্রাইভার ঠিক কোন পক্ষে তার মতিগতি বোঝা যাচ্ছিলো না।
বাস চলছিল দ্রুত গতিতে এবং প্রচন্ড দুলুনি হচ্ছিলো। যাত্রিরা ভীতসন্ত্রস্ত হলেও টাইমলি অফিসে পৌছানোর আশায় কেউই মুখ খুলছিল না।
এমন সময় সামনের দিক থেকে একটি তেলবাহী ট্যাংকলরী ছুটে এলো।
সেই ট্যাংকলরীকে জায়গা দেওয়ার জন্য ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে, আমাদের ড্রাইভার সাহেব বাম দিকে চেপে এলো!
একই মুহুর্তে বিকট হর্ন বাজাতে বাজাতে পেছনের বিআরটিসির বাসটি ডান দিক দিয়ে মুখ বের করে দিয়ে রাজকীয় ভঙ্গিতে একই সমান্তরালে চলে এলো।!
ড্রাইভারের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম যেন তার দুই চোখ বড় বড় হয়ে গেলো! ক্কড় ক্করাত্ শব্দ করে তিনি কড়া ব্রেক কষলেন। কিন্তু ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গেছে!
আমাদের বাসের সামনের বাম পাশের চাকা রাস্তা ছেড়ে খাদের কিনারে চলে এসেছে!
তারপর আস্তে করে বাসটি কাঁত হয়ে বাম দিকে গড়িয়ে পড়তে লাগলো!!
প্রথমে মনে হল, কারা যেন হুমড়ি খেয়ে আমার গায়ের উপরে পড়ে গেল! পরক্ষণেই যেন আমি আবার তাদের উপর গিয়ে পড়লাম, তারপর আবার তাদের নীচে পড়ে গেলাম। এইবার মনে হলো শরীরের উপরে ভারী কিছু চেপে বসলো। ভারী চাপে বুকের পাঁজর ভেঙে যাবার জোগাড় হলো।
চারিদিক থেকে আল্লাহ! আল্লাহ!, লাইলাহা ইল্লাল্লাহু! শব্দ কানে ভেসে আসতে লাগলো !
আমার শুধু একবারই মনে হলো _ " এইভাবে অকালে মারা গেলাম!! "
যখন হুঁশ হল, দেখলাম - কোমর সমান জলের মধ্যে উদ্ভ্রান্তের মতো পড়ে আছি!
বুঝলাম, বাস রাস্তার পাশে খাদের মধ্যে পড়ে গেছে ! আস্তে আস্তে খাদের জলে ডুবে যাচ্ছে! বাসের মধ্যে থেকে খুব তাড়াতাড়ি বের হতে না পারলে নির্ঘাত মারা যাবো।!
অন্ধের মত হাঁতড়াতে হাতড়াতে জানালার ভাঙা কাঁচে হাত বিঁধে গেলো।
তখনই মনে হল, এতো ভাঙা জানালা!!
দরজা কোন দিকে!?
মাথা ঝাঁকি দিয়ে প্রকৃতিস্থ হওয়ার চেষ্টা করলাম ।
দরজার অবস্থান খুঁজে পেতেই দেখা গেলো, - সবাই এক যোগে দরজা দিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু দরজা প্রায় জলে ডুবে আছে । ঠেলাঠেলি করে লোকজন জলের মধ্যে সাঁতরে বের হচ্ছে!
ঠিক সেই সময় আমার হক্কত করে মনে হলো - আরে! ড্রাইভারের সিটের পাশেতো একটা দরজা থাকে ! সেখান দিয়েতো বের হওয়া যাবে।
ড্রাইভারের দরজার কাছে গিয়ে দেখলাম, হ্যাঁ, ড্রাইভারের দরজা হাট করে খোলা এবং বাম দিকে কাত হয়ে আছে। চারিদিক থেকে লোকজন এগিয়ে এসেছে।
দরজা দিয়ে লাফ দিবো! ঠিক সেই সময় হঠাৎ মনে পড়ে গেল, আমার কাছে একটি ছোট ট্রাভেল ব্যাগ ছিল! বেঁচে যখন আছি, তখন ব্যাগটা নিয়ে যাবো না কেন!?
নিজের সিটের কাছে গিয়ে জলের মধ্যে হাঁতড়ে হাঁতড়ে ব্যাগটা টেনে তুললাম।
আবার ড্রাইভারের দরজার কাছে গিয়ে এক উদ্ধারকারী মানুষের হাতে ব্যাগটি দিয়ে নিজেও সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে কোমর জলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
অনতিবিলম্বে উদ্ধারকারী ভাইয়ের কাছ থেকে নিজের ব্যাগটি ছিনিয়ে নেওয়ার মত করে টেনে নিয়ে, পাহাড় বেয়ে ওঠার মত খাদের নীচ থেকে মহাসড়কে উঠে এলাম।
নীচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের মুড়ির টিন খাদের জলে অর্দ্ধনিমজ্জিত অবস্থায় শুয়ে আছে।!
কেউ একজন বলল, একজন মানুষ মারা গেছে! তার মাথা ও কান দিয়ে রক্ত ঝরছে!
একজনের হাত, আরেকজনের পা ভেঙে গেছে!
রাস্তায় অনেক মানুষ ও গাড়ি জমায়েত হয়ে গেছে!
এতক্ষন পর - ভয়ে, আতংকে, উদবেগে, উত্তেজনায়, আমার জলে ভেজা কাঁদায় মাখা শরীর সমানে কাঁপতে লাগলো !!।।

৬.

সপ্তাহ খানেকের মধ্যে চৌহালি ফিরে এসে চাকুরীতে মনোযোগ দিয়েছি।
একটা জিনিস খেয়াল করলাম এই অল্প কয়েকদিনের মধ্যে ডাক্তার হিসেবে আমার জনপ্রিয়তা কিঞ্চিৎ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এর পেছনে হয়তো '' কোম্পানি মিয়াঁর ''হাত আছে। চেয়ারম্যান সাহেবের ঘনিষ্ঠ সহচর ' বডিগার্ডও বলা যেতে পারে যিনি ঢাকার পথে স্পিডবোটে চালকের সহকারী হিসেবে ছিলেন তিনিই এলাকায় একধরনের রটনা রটিয়ে দিয়েছেন যে, " ডাক্তার বাবু সেদিন সাথে না থাকলে চেয়ারম্যান ভাবিকে বাঁচানো কঠিন হতো! "
যাইহোক হাসপাতাল আউটডোরে কলিগদের তুলনায় আমার কাছে বেশি মানুষ আসতে লাগলো।
যদিও আউটডোরে যে চিকিৎসা আমরা দিতাম তা ছিলো একধরনের প্রতারণার নামান্তর।
খুব সামান্য কিছু কমন ওষুধ সাপ্লাই থাকতো যা দিয়ে কোন প্রকৃত চিকিৎসা করা সম্ভব ছিলোনা।
এই ওষুধ দেওয়ার জন্য মেডিকেল এসিস্ট্যান্টরাই যথেষ্ট ছিলো।
ইতিমধ্যে একজন দুইজন করে রোগি ইনডোরে ভর্তি হতে শুরু করলো।
আমাদের চার জন কলিগের কাজ ছিলো আউটডোর শেষ হয়ে গেলে ইউএইচএফপিও স্যারের রুমে বসে গল্প করা আর চা খাওয়া। কখনো কখনো উপজেলার অন্যান্য অফিসারদের রুমে দলবেঁধে ঢু মারা।
খাওয়া দাওয়ার কোন চিন্তা ছিলো না । সকালে বাসায় বসে থেকেই নদীর তাজা মাছ, চরের টাটকা সব্জি, গরুর খাঁটি দুধ পাওয়া যেতো।
সুইপার মিলন খাতুন আমাদের রান্না করে দিতো।
বিকালের দিকে আমরা দলবেঁধে নদীর ধারে হাঁটতে বের হতাম।
উপজেলা মুন্সেফ ( পরবর্তীতে সহকারী জজ) রাজশাহীর এনামুল ভাই আমাদের সাথে হাঁটতেন। কিন্তু হাঁটাহাঁটির একপর্যায়ে আমরা যখন ক্যানটিনে বসে চা খেতে চাইতাম তখন তিনি কিছুতেই রাজি হতেন না। কারন জজ সাহেবদের চাকুরিবিধিতে এই বাধ্যবাধকতা আছে। সরাসরি পাবলিক সংস্পর্শে আসা ওনাদের জন্য বারণ।
কিন্তু রাত্রিবেলায় ওনার বাসায় বসে তাস খেলার জন্য কোন বারণ ছিলো না।
উপজেলা কোর্ট বিল্ডিং তখনো হস্তান্তর না হওয়ায় তিনি আমাদের ক্যাম্পাসের তৃতীয় শ্রেণির একটি কোয়ার্টারে থাকতেন। নীচতলায় ওনার আদালত এবং দোতলা বাসভবন হিসেবে ব্যবহার হতো ।
একদিন বিকালে হাঁটার জন্য বাসা থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি ঠিক সেই সময় হাসপাতালের ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান কাদের সাহেব বিনীত ভঙ্গিতে আমার রুমে এসে হাজির হলেন।
কাদের সাহেব একদম নিরীহ প্রকৃতির হুজুর মানুষ।
জোহরের নামাজের সময় অফিসের যে কয়জন জামাতে নামাজ পড়েন তাদের ইমামতি করতে দেখেছি কাদের সাহেবকে।
কাদের সাহেব আমার দিকে জোড়হাত করে বললেন -" স্যার, যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটা আব্দার করবো। "
আমি বললাম - ' কিসের আব্দার? '
" দয়া করে আমার বাড়িতে একটু যেতে হবে স্যার। "
আমি বললাম - ' কেন! ? '
" স্যার, আমার চাচাতো ভাই খুবই গুরুতর অসুস্থ, তাকে একটু দেখে আসবেন স্যার।"
' আচ্ছা, গুরুতর অসুস্থ হলে, তাকে নিয়ে এসে হাসপাতালে ভর্তি করে দিচ্ছেন না কেন? '
" না স্যার, সেই অবস্থায় নাই। এখুন তাখুন অবস্থা! আমি সবাইকে বলে আসছি এই কথা বলে যে, আপনাকে সাথে করে নিয়ে যাবো! "
অগত্যা বেশি কিছু চিন্তা না করেই কাদের সাহেবের সাথে বের হয়ে পড়লাম।
হাসপাতালের দক্ষিন পাশের বাউন্ডারি ওয়ালের সাথেই একটি ডিঙি নৌকা নিয়ে একজন মাঝি বসে ছিলো।
আমরা নৌকায় ওঠার পরে মাঝি নৌকা ছেড়ে দিলো। একটা বিলের মত প্রান্তর। এই বিলের দক্ষিন পুর্ব দিকে যে গ্রামটি দেখা যাচ্ছে সেইটিই পুর্ব জ্যোতপাড়া কাদের সাহেবের গ্রাম।
রোগি দেখে মনে হলো সত্যিই মরনাপন্ন অবস্থা। তার হাত পা শুকিয়ে কংকালের মত হয়ে গেছে। চোখ মুখ গর্তে বসে গেছে।
পেটটি ফুলে আছে। শরীর একদম ফ্যাকাসে। রোগী তিন চার মাস হলো জ্বরে ভুগছে।
পেটে হাত দিয়ে দেখলাম - পেট শক্ত। লিভার এবং স্পিলিন হাত দিয়ে প্রায় ধরা যায়।
তিনি কোন জটিল ক্রনিক রোগে ভুগছেন। হতে পারে ক্যান্সার, হতে পারে টিবি, কিংবা কালাজ্বর।
কাদের সাহেবকে বললাম, " আগামীকাল সকালে যত কষ্টই হোক রোগিকে হাসপাতালে নিয়ে যাবেন। রক্তের সিবিসি, এলডিহাইড টেস্ট, প্রস্রাবের রুটিন পরীক্ষা করতে হবে। ওনার কালাজ্বর হতে পারে বলে সন্দেহ করছি। এলডিহাইড টেস্ট যদি পজিটিভ হয় তাহলে খুবই ভালো হয়।
এটা যদি না হয়, তাহলে খারাপ কিছুর জন্যে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।
ফেরার সময় কাদের সাহেব আমার পকেটে টাকা গুঁজে দিতে চাইলেন। আমি বাঁধা দিয়ে বললাম " আপনিতো আমাদের স্টাফ, টাকা দিচ্ছেন কেন! " কাদের সাহেব কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে জোড়হাত করে বললেন - " স্যার, আপনার জন্য সামান্য সম্মানী। আপনি না নিলে আমাদের মান সম্মান থাকেনা। "
এই বলে তিনি দুই খানা নোট আমার পকেটে গুঁজে দিলেন।
আবছা আলোয় মনে হলো দুই খানা বিশ টাকার নোট আমার পকেটে গুঁজে দেয়া হলো।
ফেরার পথে মনে মনে চিন্তা হলো চল্লিশ টাকা কম টাকা নয়! তখন আমাদের ব্যাসিক বেতন ১৮৫০ / টাকা। তার মানে দৈনিক বেতন ষাট টাকা।
লোকটির বাড়িঘরের যে অবস্থা দেখলাম তাতে হতদরিদ্র মনে হলো! তার উপরে এইরকম মরনাপন্ন অবস্থা। তার কাছ থেকে এই চল্লিশটি টাকা নেওয়া কী ঠিক হলো!?
ছাত্রাবস্থায় গরীব দুঃখীদের নিয়ে এক ধরনের রাজনৈতিক চিন্তা চেতনা মনে মনে পোষন করে এসেছি!
বাসায় ফিরে পকেট থেকে টাকা বের করে দেখি, আরে চল্লিশ টাকাতো নয়, রীতিমতো দুইশো টাকা! দুইটি কড় কড়ে একশো টাকার নোট!!
একজন ডাক্তার হিসেবে এই টাই আমার জীবনে রোগি দেখা বাবদ প্রথম উপার্জিত টাকা।
একজন মুমুর্ষ হত দরিদ্র মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিজেকে খুব ছোট মনে হতে লাগলো।
কলিগদেরকে কিছু বললাম না। । নিজের মনেই ছটফট করতে লাগলাম। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখলাম, আগামীকাল কাদের সাহেবের কাছে টাকাটা ফেরত দিয়ে দিবো।
পরদিন সকালে আউটডোরে বসে টাকার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম।
বেলা বারোটার দিকে খুব হাসি খুশি ভঙ্গিতে কাদের সাহেব আমার চেম্বারে ঢুকে হড়বড় করে বলে ফেললো - " স্যার, এলডিহাইড টেস্ট পজিটিভ হয়েছে! এক্কেবারে স্ট্রংলি পজিটিভ!! "
আমি নিজেও অত্যন্ত খুশি হলাম।
বললাম, ''এক্ষুনি রোগিকে ভর্তি করে দিচ্ছি, কালাজ্বরের চিকিৎসার জন্য স্টিবাটিন ইঞ্জেকশন সাপ্লাই আছে। অতএব চিন্তা নাই, অল্প দিনের মধ্যেই আপনার রোগী সুস্থ হয়ে যাবে আশা করা যায়।"
ট্রিটমেন্ট ফাইলে চিকিৎসা লিখতে লিখতে হঠাৎ এক অদ্ভুত ভালো লাগার অনুভূতি আপাদমস্তক বয়ে গেলো!
ডাক্তার হওয়ার পরে এই প্রথম কারো সুপারভিশন ছাড়া স্বাধীন ভাবে একটি জটিল রোগ আমি অতি অল্পতেই ডায়াগনোসিস করতে পেরেছি এর চেয়ে আনন্দের বিষয় আর কী হতে পারে!?
চিকিৎসা দিয়ে ফাইলটি কাদের সাহেবের হাতে দিয়ে বললাম, "একজন গরীব মানুষের কাছ থেকে কেন এতগুলি টাকা আমাকে দিয়েছেন? এই টাকাটা ওনাকে ফেরত দিবেন। "
কাদের সাহেব আমার হাত চেপে ধরে বললেন - " স্যার, গত তিন চার মাসে আমার ভাইয়ের কয়েক হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে! এপর্যন্ত রোগই ধরতে পারা যায় নাই স্যার! আল্লাহর কাছে আপনার জন্য দোয়া করবো স্যার।। "


৭.

(টি, এ, বিল)------
ইতিমধ্যে আমাদের ইউএইচএফপিও খবির স্যার বদলি হয়ে গেলেন।
খবির স্যারের জায়গায় এলেন রফিক স্যার। রফিক স্যারের বয়স তুলনামূলক কম। দুই চার দিনের মধ্যেই বোঝা গেলো নতুন স্যারের প্রেস্টিজ জ্ঞান বড় টনটনে।
মাসের পঁচিশ কী ছাব্বিশ তারিখে তিনি আমাদের জিজ্ঞেস করলেন যে, আমরা বেতন বিল সই করেছি কি না?
বেতন বিল আসলে কী জিনিস তা জানা ছিলো না। কারন চাকুরীতে যোগদানের সাথে যে ফাউন্ডেশন ট্রেনিং হয় তা আমাদের ছিলোনা।
উনি বললেন প্রথম শ্রেনীর অফিসারদের মাসিক বেতন বিল নিজে নিজেই তৈরি করে, সই স্বাক্ষর করে, একাউন্টস অফিসে পাঠাতে হয়।
রফিক স্যার হেড এসিস্ট্যান্টকে ডেকে আমাদের বেতন বিল তৈরি করে দিতে বললেন।
হেড এসিস্ট্যান্ট হরলাল পাল দালাল আমাদের বেতন বিল তৈরি করে দিলেন। আমরা শুধু সই স্বাক্ষর করে দিলাম।
কয়েকদিন পর হেড এসিস্ট্যান্ট দালাল বাবু আমার আউটডোর চেম্বারে এসে জিজ্ঞেস করলেন - " স্যার, আপনার স্ত্রীর নাম কী?"
আমি আশ্চর্য হয়ে পাল্টা জিজ্ঞেস করলাম - " কেন? আমরা নতুন চারজন মেডিকেল অফিসার সবাইতো ব্যাচেলর। আপনি জানেন না! ? "
তিনি বললেন - " না স্যার, আপনাদের টি,এ, বিল করতে হবে তো, সেই জন্যে জেনে নেওয়া আর কি! "
টি এ, বিল যে কী জিনিস সেটাও জানতাম না।
' বড় বাবু, টি এ বিলের ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলুনতো। '
তখন উনি বললেন, " আপনারা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ইনসার্ভিস ট্রেইনিং শেষ করে এখানে এসে যোগদান করেছেন। তার মানে আপনারা সেখান থেকে বদলি হয়ে এখানে এসেছেন।
এই যে সেখান থেকে বদলি হয়ে সপরিবারে মাল সামান নিয়ে ট্রাক ভাড়া করে এখানে এসে জয়েন করেছেন, তাতে আপনাদেরতো অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। আপনারা যে এখানে এসেছেন, এটা আপনাদের ব্যাক্তিগত কাজে আসেন নাই। এসেছেন সরকারের আদেশ বলে সরকারি কাজে। তাই, এই যে ভ্রমনের খরচ, সেটা সরকারের নিকট থেকে আদায়যোগ্য। এইটাই টিএ বিল,মানে ট্রাভেলিং এলাউন্সের বিল হিসাবে একাউন্টস অফিসের মাধ্যমে আপনারা পাবেন ! "
আমি বললাম - '' বড় বাবু, আসলে এই যাতায়াত বাবদ আমার তেমন কোন খরচ হয় নাই। ''
বড় বাবু বললেন - "তা না হোক, এটা আপনার প্রাপ্য । আপনার প্রাপ্য আপনি নিবেন না কেন!? "
আমি বললাম - '' আচ্ছা ঠিক আছে, বিল তৈরি করুন। ''
মনে মনে বললাম - '' তাহলে সরকারি চাকুরির নানামুখি 'সোনার হরিণের ' এটাও একটা সোনার হরিণ!? ''
এদিকে পরের মাসের দশ/বারো তারিখ পার হয়ে গেলো ; এপর্যন্ত আগের মাসের বেতন পাচ্ছি না কেন!? যেখানে আইসিডিডিআরবির চাকরিতে মাস শেষ হওয়ার আগের দিনই ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্টের লোকেরা বেতনের চেক হাতে ধরিয়ে দিতো!
বড় বাবুকে জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন - "স্যার, একাউন্টস অফিসার আপনাদের বিল এখনো পাশ করে নাই। কারন আপনাদের এলপিসির কাগজ এখনো পাওয়া যায় নাই। আর বিলের একপাশে আপনাদের নমুনা স্বাক্ষর দেয়া হয় নাই।
একদিন একাউন্টস অফিসে গিয়ে নমুনা স্বাক্ষর দিয়ে আসতে হবে। "
আমি বললাম, '' আচ্ছা, যতদূর মনে পড়ে এলপিসির কপি বিলের সাথে দেওয়া হয়েছে! ''
বড় বাবু বললেন - " সেই কপি না স্যার,ওটাতো আপনার পার্সোনাল কপি। 'আপনার আগের একাউন্টস অফিস থেকে ডাক যোগে এলপিসির 'এম্বুস কপি' আসার পর বেতন পাশ হবে। আর যদি আপনি সশরীরে একাউন্টস অফিসে গিয়ে নমুনা স্বাক্ষর দিয়ে আসার সময় একাউন্টস অফিসার সাহেবকে একটু অনুরোধ করে আসেন, তাহলে বিল পাশ করে দিতে পারে"।
এসব কথা ইউএইচএফপিও রফিক স্যারকে বলাতে তিনি খুব রেগে উঠলেন। তিনি বললেন --" খবরদার! একাউন্টস অফিসারকে বেতন পাশ করার জন্য কখনো অনুরোধ করতে যাবেন না। সে দ্বিতীয় শ্রেণির অফিসার, আপনি প্রথম শ্রেণির অফিসার এটা মনে রাখবেন। "
বড় বাবুকে ডেকে তিনি ধমক দিলেন - " ওনাদেরকে একাউন্টস অফিসে যেতে বলেছেন কেন? "
বড় বাবু গাঁইগুঁই করতেই তিনি বলে দিলেন - " ওনাদের যদি নমুনা স্বাক্ষর লাগে, তবে বিল ফেরত নিয়ে এসে এইখানে বসে নমুনা স্বাক্ষর নিয়ে, একাউন্টস অফিসে দিয়ে আসবেন। বিল যেদিন পাশ করে করবে,না করে না করবে, খবরদার, ওনারা অনুরোধ করতে যাবেন না। "
বুঝলাম ' সোনার হরিণের ' এটি আরেকটি দিক।' ইগো', 'আত্মসম্মান বোধ', ' অফিসার সুলভ এটিউচুডের' দিক!!
কয়েকদিন পর বড়বাবু বড় বড় ফর্মা কাগজের একটি ছোট খাটো বস্তা আমার টেবিলে মেলে ধরে বললেন - " স্যার, সই করেন। "
আমি বললাম - ' এইটা কী? '
" স্যার,এইটা আপনার টি,এ, বিল।"
খুলে উল্টে পাল্টে দেখে আমার চক্ষু চড়ক গাছ হয়ে গেলো!
আমার পরিবার, বউবাচ্চা, সব দেখানো হয়েছে! তাতে সুদূর রংপুর থেকে দুই ট্রাক ভর্তি মালামাল নিয়ে বহু ঘুরে বহু কসরত করে অবশেষে চৌহালি পৌছাতে আমার কয়েক হাজার টাকা খরচ হয়েছে! ট্রাক ভাড়ার পাকা রশিদ আছে! কুলির সর্দার নাম সই করে মজুরি নিয়েছে, তার ভাউচার আছে! ট্রাক লোড আনলোড করার খরচ আছে। লঞ্চ ভাড়া আছে।! তাই সদাশয় সরকারের নিকট আমার এই টাকাটা পাওনা হয়েছে!
আমি বললাম - '' দালাল বাবু, আমি তো বলেছি, আমার কোন পরিবার নাই!। ''
তিনি বললেন - " স্যার, তাতে কী? আজ পরিবার নাই, আগামীকাল হবে। আর সবাই এই ভাবেই টিএ বিল নেয় স্যার, তাছাড়া পোষাবে না স্যার! "
আমি বললাম - '' বড় বাবু, এই বিল কী একাউন্টস অফিসার পাশ করবে? ''
বড় বাবু বললেন -- " জ্বি স্যার। "
আমি আবার বললাম - " যে একাউন্টস অফিসার বেতন বিল পাশ করতেই গড়িমসি করছে! সেই একাউন্টস অফিসার এই রকম অবৈধ টিএ বিল পাশ করবে কেন? "
বড়বাবু এক রহস্যময় হাসি দিয়ে বললেন ----" স্যার, একাউন্টস অফিস টিএ বিলের একটা পার্সেন্টেজ পেয়ে থাকে! আর আমরা অনেক কষ্ট করে বিল বানাই, আমরাও মিষ্টি খাওয়ার জন্য কিছু পেয়ে থাকি স্যার। "
আমি বড় বাবুর চোখের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালাম। তারপর বললাম - " আমার টিএ বিলের কোন প্রয়োজন নাই। এই বিল আপনি এক্ষুনি, আমার সামনে ছিঁড়ে ফেলুন। ব্যাচেলর হিসাবে আমার যে কয় টাকা বিল হয় সেইটা করুন, না করলে বাদ দেন! "
বড় বাবু হরলাল পাল দালালের মুখ কিঞ্চিৎ গম্ভীর হয়ে গেলো।
রাগে ক্ষোভে মনে মনে গড় গড় করতে করতে ভাবলাম এইটি -হলো ' সোনার হরিণের ' আরেকটি ভয়ংকর দিক!!!


৮.
(আধা মোবাইল কোর্ট)
ইতিমধ্যে ইউএইচএফপিও রফিক স্যারের সাথে আমার ঘোরাঘুরি বেড়ে গেছে।
কারন আমরা দুইজন থাকি কোয়ার্টারের নীচতলায়। মেডিকেল অফিসার রফিক, রবিউল, আলতাফ,ওরা থাকে দোতলায়।
ইউএইচএফপিও স্যার এবং মেডিকেল অফিসারদের মধ্যে লিয়াজোঁ মেইনটেইন করার দায়িত্ব পড়েছে আমার উপরে। আবার স্যার ছুটিতে গেলে, আমাকেই দায়িত্ব দিয়ে যান। এতে বন্ধুরা আমাকে বিদ্রুপ করে ' সেকেন্ড ইন কমান্ড' বলে ডাকা শুরু করেছে।
একদিন বিকেলে রফিক স্যার বললেন, "ওদেরতো বের হতে দেরি হবে। চলেন আমরা দুইজন নদীর ধার দিয়ে হেঁটে আসি। "
নদীর ধারে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসার সময় বাজারের মধ্যে স্যার বললেন, --- " চলেন চা খাওয়া যাক। "
পশ্চিম পাশে যমুনার ধারে 'নিতাইয়ের মিষ্টির দোকান'। সেখানে চায়ের ব্যবস্থা আছে।
দোকানে ঢুকে আমরা চায়ের অর্ডার দিলাম। সাথে প্যারার সন্দেশ।
নিতাই নিরাসক্ত ভাবে বললো - " দাদা বসেন, জল গরম হোক। "
আমরা চায়ের অপেক্ষায় বসে আছি।
ঠিক সেই মুহুর্তে হঠাৎ থানার একজন পুলিশ কনস্টেবলকে নিতাইয়ের দোকানের দিকে উঁকি ঝুঁকি দিতে দেখা গেলো ।
নিতাই তা দেখামাত্র তার আসন থেকে লাফ মেরে উঠে এগিয়ে এলো -- " ছার! ছার! ভিতরে আসেন ছার! বসেন ছার! বসেন ছার! কী লাগবো ছার!?
এক নিশ্বাসে এসব কথা বলেই নিতাই ভীষণ ব্যস্ততা নিয়ে, তার গলার গামছা দিয়ে এক খানা চেয়ার পরম যত্নে মুছে টুছে পুলিশ ছারকে বসার জন্য এগিয়ে দিলো।
রফিক স্যার তার হাতের কনুই দিয়ে আমার পেটে গুঁতো মেরে ইশারায় নিতাইয়ের কর্মকান্ডের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন।
বাকি সময়টুকু আমরা আর কেউ কোন কথা বললাম না।
লজ্জায়, ক্ষোভে, অপমানে, মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিলো । চোখ মুখ বুজে, চা খেয়ে বেরিয়ে এলাম।
রাস্তায় এসে আমিই মুখ খুললাম।
আমি বললাম - " স্যার , আমার খুব ভুল হয়ে গেছে! প্রথমেই 'আপনি যে আমাদের বড় স্যার', একথা নিতাইকে আগেই আমার বলা উচিৎ ছিলো। ইউএনও সাহেব যখন রাস্তায় বের হন, তখন তার আগে আগে সাঙ্গোপাঙ্গরা যেমন করে - " এই যে, স্যার আসছে!, স্যার আসছে! বলে রাস্তা ক্লিয়ার করে দেয়!! তেমনি করে আগেই একটা অবস্থা তৈরি করা দরকার ছিলো।
আমার এই কথা শুনে স্যারের গোমড়া মুখে মলিন হাসির রেখা দেখা দিলো।
ইউএইচএফপিও স্যার বললেন - " আমাকে না হয় নিতাই চেনে নাই, আপনাকে তো চেনে! আপনাকেও তো ' স্যার ' সম্বোধন করে নাই, ' দাদা' বলেছে!
আমি বললাম - " স্যার, এই ''স্যার ''সম্বোধন বিষয়টিতো উপনিবেশিক কায়দা কানুন!"
তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,- " একজন কনস্টেবলকে ' স্যার' সম্বোধন করলে আপনার মত একজন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাকে 'স্যার' সম্বোধন কেন নয়?
ঠিক আছে, আগামীকাল থেকে নিতাই যাতে আপনাকে স্যার' সম্বোধন করে সেই ব্যবস্থা করা হবে । "
আমি একটু ভড়কে গেলাম। কিন্তু আর কোন কথা বাড়ালাম না।
পরদিন সকালে স্যারের পিয়ন একটা খাম আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেলো।
পাতলা কাগজে টাইপ করা চিঠিটি খুলে পড়তে লাগলাম । চিঠির ভাষা অনুযায়ী একটি ' নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক টিম' গঠন করা হয়েছে। সেই টিমের সভাপতি করা হয়েছে স্বয়ং আমাকে। স্যানিটারি ইন্সপেক্টর ফজলু সাহেবকে করা হয়েছে সদস্য সচিব।
এই চিঠির একটি কপি থানায় পাঠানো হয়েছে। বেলা এগারোটায় একটি পুলিশ এসকর্ট পাঠানোর জন্য ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অনুরোধ করা হয়েছে!
বেলা সাড়ে দশটায় স্যানিটারি ইন্সপেক্টর সাহেব আমার রুমে চলে এলেন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম - " ফজলু সাহেব,আসলে কী কাজ করতে হবে?"
তিনি বললেন - " আপনার কিছুই করতে হবে না স্যার, যা করার আমিই করবো। আপনি শুধু সাথে থাকবেন। "
পুলিশের দল চলে এলে আমরা একসাথে বাজারে গিয়ে পৌছালাম। পুলিশ দলে গতকাল নিতাইয়ের মিষ্টির দোকানে যে পুলিশ কনস্টেবলকে মহাসমাদর করা হয়েছিলো তাকেও দেখতে পেলাম।
বিভিন্ন মুদির দোকানে ঢুকে 'সরষের তেল ', ' ঘি' সহ অন্যান্য খাদ্য পন্যের স্যাম্পল নেওয়া হলো। একাজে সাহায্য করতে লাগলো স্যানিটারি ইন্সপেক্টরের পিয়ন মোজাম্মেল। সে বড়ই এক্সপার্ট লোক।
এরপর দুই তিনটি মিষ্টির দোকান।
নিতাইয়ের মিষ্টির দোকানে ঢুকে স্যাম্পল নেওয়ার সময় মোজাম্মেল আমার কাছে এসে বললো - " স্যার, দেখেন দেখেন, মিষ্টির আলমারিতে ঢাকনা নাই। রসগোল্লার গামলার মধ্যে মড়া মশা পড়ে আছে স্যার !"
আমি বললাম - " মোজাম্মেল, যে গামলার মধ্যে মশা পড়ে আছে, সেই গামলার মিষ্টি ফেলে দাও। "
মোজাম্মেল এক গামলা রসগোল্লা ড্রেনের ভিতর ফেলে দিলো।
গতকালের কনস্টেবল আমার কাছে এসে বললো, - স্যার, দেখেন কীরকম মাছি ভিন ভিন করতিছে!
নিতাই এতক্ষন হতভম্ব ও বিমূঢ় অবস্থায় এইসব কর্মকাণ্ড দেখছিলো।
তারপরেই সম্বিত ফিরে পেয়ে ,কাঁদতে কাঁদতে চট করে এসে আমার পা জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো - " ছার , আমি গরীব মানুষ! ছার ,আমি গরীব মানুষ!! "
আমি শুধু বললাম - " মিষ্টির আলমারি কাঁচের পাল্লা দিয়ে ঢেকে দিও। এরপর যেন খোলা না থাকে।"
মনে মনে চিন্তা করলাম, বেশতো! পাওয়ার এক্সারসাইজ করতে বেশতো মজা লাগে!!
পরক্ষনেই রিয়ালাইজ করলাম, এই অমানবিক কাজটি করার ক্ষমতা ও ইচ্ছা কোনটিই আমার নাই।
সবচেয়ে বড় কথা জোর খাটিয়ে কখনো সম্মান আদায় করা যায় না।
পুলিশকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যেকোন সময় যে কাউকে আটক করার ক্ষমতা। চাইলে তারা পাছায় কষে কয়েকটা ডান্ডার ঘাও মারতে পারে।
এসি ল্যান্ড সাহেব লক্ষ লক্ষ টাকা দামের জমির 'নাম জারি' করে দেন। তিনি ম্যাজিস্ট্রেট। ১৪৪ ধারা জারি করার ক্ষমতা রাখেন। গুলি করার অর্ডার তিনিই দিতে পারেন। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে জরিমানা ও কারাদণ্ড দেওয়ার ক্ষমতা তার আছে।
প্রত্যেকের সার্ভিসের ধরন আলাদা। ক্ষমতা ও সম্মানও আলাদা।
একজন চিকিৎসক প্রকৃত পক্ষে এডমিনিস্ট্রেটর নন। তিনি আসলে বিজ্ঞানী, হাসপাতালে নিরবে নিভৃতে মানুষের জীবন বাঁচানো তার কাজ। এই খানেই তার সাফল্য ও সম্মান নিহিত রয়েছে।
অফিসে ফিরে ইউএইচএফপিও স্যারকে বললাম - " আমাকে যে কাজে পাঠিয়েছিলেন, সেইটি আমার কাজ নয়। সেইটি আসলে স্যানিটারি ইন্সপেক্টরের কাজ। আমার অনুরোধ, এইরকম কোন কাজে যদি কোনো মেডিকেল অফিসারকে পাঠাতে হয় তাহলে দয়া করে আমাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে পাঠাবেন। "


(--------চলবে-------)
---- ডাঃ সুকুমার সুর রায়
প্রখ্যাত লোকসেবী চিকিৎসক। সুলেখক।

ডাক্তার প্রতিদিনে প্রকাশিত প্রথম ৪ পর্বের লিঙ্ক ::

https://daktarprotidin.com/manusher-jonno/5754/%E0%A6%B8%E0%A7%8B%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%B9%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%A3-%E0%A6%A8%E0%A6%A4%E0%A7%81%E0%A6%A8-%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A6%BF-%E0%A6%AA%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AC-%E0%A6%A5%E0%A7%87%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%85%E0%A6%AC%E0%A6%B8%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4-%E0%A6%8F%E0%A6%95-%E0%A6%A1%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%86%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A6%BF 

 

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়