Ameen Qudir

Published:
2017-01-25 22:21:06 BdST

চিকিৎসকের অবহেলা, দায় নির্ধারণ কিভাবে হবে? কানাডার অভিজ্ঞতা


 


ডা. অসিত বর্দ্ধন
__________________________


স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন এর খসড়া প্রকাশিত হয়েছে। এনিয়ে চিকিৎসক মহল বেশ ভীত সন্ত্রস্ত। অনেকেই জানতে চেয়েছেন বিভিন্ন দেশে কিভাবে তা নিরূপণ হয়। যে সমস্ত সম্মানিত প্রবীণ ও তরুণ চিকিৎসক চিকিৎসকদের স্বার্থ রক্ষায় সোচ্চার তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কানাডার অভিজ্ঞতা নিয়ে এই লেখাটি।

কানাডার প্রত্যকেটা প্রদেশে নিজস্ব কলেজ আছে, আমাদের বিএমডিসির (Bangladesh Medical & Dental Council) সমতুল্য । কলেজ সেই প্রদেশের চিকিৎসকদের লাইসেন্সের দায়িত্বে থাকেন। রোগীদের অভিযোগের তদন্ত করাও তাদের কাজ। যে কোনো সংক্ষুব্ধ রোগী, অথবা তাঁর নিকটাত্মীয় এই কলেজের কাছে প্রথম অভিযোগ করেন প্রতিকার চেয়ে। প্রতিকার হতে পারে ক্ষতিপূরণ কিম্বা চিকিৎসকে সতর্কীকরণ সহ বিভিন্ন তিরস্কার বা জরিমানা । এখানে সেই সমস্ত অভিযোগ আমলে নেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট বিভাগ আছে। তারা অভিযোগকারীকে সাথে সাথে প্রাপ্তি স্বীকার করে চিঠি দেন। একই সাথে অভিযুক্ত চিকিৎসক, হাসপাতাল অথবা অন্যান্য স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কাছে এই অভিযোগ টি লিখিত ভাবে পাঠান। তাদেরকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এই অভিযোগের বিপরীতে জবাব দিতে বলা হয়। চিকিৎসক ও হাসপাতাল আলাদা আলাদা ভাবে তাঁর জবাব লেখেন। চিকিৎসককে অভিযোগ প্রাপ্তির শুরুতেই ম্যাল প্র্যক্টিস ইন্সুরেন্স কোম্পানিকে জানাতে হয় । ইন্সুরেন্স কোম্পানি উত্তর কিভাবে লিখতে হবে সে বিষয়ে চিকিৎসককে সহায়তা করেন। এই সময়ে অনুমতিসাপেক্ষে রোগীর সমস্ত তথ্য চিকিৎসক কপি হিসেবে পেতে পারেন। মুল তথ্য সংরক্ষিত থাকে হাসপাতালের কাছে, রেকর্ড সেকশনে। কাগজে এবং কম্পিউটারে।

অভিযুক্তদের উত্তর পাওয়ার পরে , এর একটা কপি দেওয়া হয় অভিযোগকারীকে। কলেজের নিজস্ব রিভিউ বিভাগ তখন অভিযোগ ও উত্তর এবং সংগৃহীত তথ্য মিলিয়ে দেখে সুপারিশ করেন যে চিকিৎসকের অবহেলা কিম্বা দায় প্রমাণিত কি না। যদি অভিযোগ গৃহীত হয় , তবে তা সাথে সাথে চিকিৎসককে জানানো হয়। চিকিৎসক ইনস্যুরেন্স কোম্পানিকে জানালে তারা চিকিৎসককে আইনজীবী দিয়ে আইনি লড়াইয়ে সহায়তা করেন। যদি রিভিউ বোর্ড দোষ খুঁজে না পান তবে অভিযোগকারী আবার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পুনরায় নিরীক্ষার জন্য আপিল করতে পারেন। এই আপিলে যদি চিকিৎসক দোষী না হন, তবে অভিযোগকারী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোর্টে আবেদন করতে পারেন। কেসটি কোর্টে গেলে এটি বিচারাধীন থাকা অবস্থায় একটি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। প্রথমে দুই পক্ষের উকিল তাঁর মক্কেলের সাথে কথা বলে অভিযুক্তের প্রতি অভিযোগ নামা পাঠান। এর পরে কোর্টের একজন সদস্যের উপস্থিতিতে "ফ্যক্ট ফাইন্ডিং" বা "ডিসকাভারি" সেশন হয়। যেখানে বিপক্ষের উকিল বাদী বা অভিযোগকারীকে তাঁর অভিযোগ বিষয়ে জেরা করেন। এই তথ্য "শপথ " এর আওতাধীন। এটির লিখিত ও ভিডিও কপি থাকে। এবং এখানে দেওয়া তথ্য আদালতে তাঁর (অভিযোগকারী ও চিকিৎসক) বিরুদ্ধে ব্যবহার হতে পারে। যদি উকিল মনে করেন যে অভিযোগকারীর ভিত্তি দুর্বল তবে সামারি ট্রায়ালের আবেদন করতে পারেন। সামারি ট্রায়ালের মানে যে বাদী বা অভিযোগকারীর পরিবর্তে তাদের উকিলের উপস্থিতিতে বিচারক অভিযোগ ও তাঁর প্রত্যুত্তর শুনে দায় নির্ধারণ করবেন। অথবা বিচারক সম্পূর্ণ "ট্রায়াল" এর নির্দেশ দিতে পারেন।

 

 


যে কোনো পর্যায়ে যদি চিকিৎসকের দায় প্রমাণিত হয়, তবে তাঁর জন্য অভিযোগকারী ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন। এটা স্থির হতে পারে আদালতের বাইরে অথবা আদালতের মাধ্যমে।
কলেজ নিজে একটি তদন্ত করে, তাঁর পরিপ্রিক্ষিতে চিকিৎসকের দায় ও সাজা নিরূপণ হতে পারে। চিকিৎসকের লাইসেন্স একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত স্থগিত থাকতে পারে। চিকিৎসক কে পুনরায় কিছুদিনের জন্য বিভিন্ন কোর্স করতে নির্দেশ দিতে পারেন। অথবা চিকিৎসার জন্য নিরাপদ না মনে করলে লাইসেন্স বাতিল করতে পারেন। যে কোন চিকিৎসক যদি অর্থ পরিশোধ করে থাকেন সেটা তার ফাইলে লেখা থাকে এবং এটা অন্যান্যরা দেখতে পান।
পুরো বিষয় একেবারে শেষ পর্যন্ত নিষ্পত্তি হতে ৩ থেকে ৪ বছর লাগতে পারে। দায় সরাসরি প্রমাণিত হলে অনেক আগেই শেষ হয়ে যায়, কারণ সেক্ষেত্রে ম্যাল্প্রাক্টিস ইনস্যুরেন্স কোম্পানি খরচ বাঁচাতে দ্রুত নিষ্পত্তি করে, আদালতের বাইরে।তবে অনেক সময় যা সাধারণ চোখে ভুল বা দায়িত্ব খেলাপের পর্যায়ে পরে না, আদালত সেখানে নিজের পর্যবেক্ষণ জানাতে পারেন। একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে ঃ একজন চিকিৎসক ওভারিয়ান টিউমার অপারেশনের সময় দেখেন যে টিউবটি ঠিক আছে। কিন্তু এরকম টিউমারে ক্যন্সারের সম্ভাবনা থাকায় তিনি টিউবটি কেটে ফেলেন। কিন্তু অস্ত্রোপচারের অনুমতি পত্রে তা লেখা ছিলনা। আদালত রায় দেন যে এতে "ব্যাটারি" সঙ্ঘটিত হয়েছে। রোগী ক্ষতিপূরণ পান। চিকিৎসক ও ইন্সুরেন্স কোম্পানি মনে করেছিল চিকিৎসক ঠিক কাজটি করেছেন।

 

 

আমাদের দেশে এরকম ম্যাল প্র্যাকটিস ইন্সুরেন্স থাকা আবশ্যিক হয়ে পড়েছে। এরকম একটা ব্যবস্থা থাকলে চিকিৎসকদের দিকে কেউ তেড়ে যাবে না। কারণ তাঁর হাতে প্রতিকারের উপায় থাকবে। এর সাথে প্রয়োজন চিকিৎসার তথ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা। ডিজিটাল অথবা পেপার, যেখানে পরিবর্তন করার সম্ভাবনা থাকবে না। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ডিজিটালাইজেশন একটি সমাধান কারণ চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে তথ্য সংরক্ষণ যথেষ্ট নয়।

একটি সত্যিকারের সুরক্ষা আইন চাইলে সব পক্ষের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। প্রয়োজন সহযোগিতাও। তবে সব চাইতে প্রয়োজনীয় মনে হয় সব পক্ষের এই আইনকে সম্মান করার মানসিকতা।

_____________________________


ডা. অসিত বর্দ্ধন , প্রবাসী এনেস্থেটিস্ট , bdemr.com (বিডি ইএম আর ডট কম এর প্রতিষ্ঠাতা)

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়