ডাক্তার প্রতিদিন

Published:
2020-05-24 16:39:06 BdST

করোনাকাল : কয়েকটি বেদনাদায়ক ঘটনা


 


ডাঃ মোঃ শরিফুল ইসলাম সুজন
__________________________

দু/তিনটে ঘটনা বলি

আমাদের বাসা থেকে আমার হাসপাতাল ৩৬ কি, মি, দূরে। আমরা যে মাইক্রোবাসে আসা যাওয়া করি, তা ১৫ সিটের, ৫ টি row.

৯ই এপ্রিল শবে বরাতের আগের দিন অর্থাৎ ৮ই এপ্রিল আমার পাশে একজন ডাক্তার সাহেব আসা-যাওয়া করলেন, পরের দুই দিন বৃহষ্পতি ও শুক্রবার টানা ছুটি, শনিবারে তিনি জানালেন I am not feeling good, I will not go. ঐ দিন উনি (১১ই এপ্রিল শনিবার) আমাদের না জানিয়ে COVID-19 পরীক্ষা করতে দিলেন ও পরের দিন রবিবার ১২ই এপ্রিল রাত ১০টায় জানা গেল, তিনি করোনা (+)ve; অথচ তিনি গত ৫ দিন থেকে জ্বরে ভুগছিলেন, যা আমাদের কাউকে জানান নি এবং শুধু তিনিই নন, আমাদের মাইক্রোবাসের ১১ জনের মধ্যে ৩ জনের পজেটিভ আসে ঐ একই দিনে, আমাদের বাকী সবার টেষ্ট করা হয় পরের দিন, তাদের অবশ্য (-)ve আসে। গাড়ি সহ সবাই ১৪ দিনের গৃহবন্দী।

পরবর্তিতে হাসপাতালের অনেক ডাক্তার কর্মচারির (+)ve আসে, ফলশ্রুতিতে পুরো হাসপাতাল লক ডাউন। এখন লক ডাউন করলে তো হবে না, হাসপাতাল চালু না থাকলে খরচ আসবে কোথা থেকে, বেতন বন্ধ হবার যোগাড়।

পরবর্তী ঘটনা আরও বেদনাদায়ক। আমি বাসায় বিকেল ০৪ঃ৩০ এ ফিরি, সন্ধ্যে ৬টায় গেল বুহষ্পতিবার (১৪ই মে) emergency থেকে ফোন আসল, এক ভদ্রলোক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন, অচেনা, অজানা, অপরিচিত এক পথচারী তাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন, কতক্ষণ আগে কিভাবে আহত হয়েছেন কেউ জানে না, মাথার প্রায় অর্ধেকের বেশী চামড়া ছুঁলে কোন রকমে ঝুলে আছে, এত রক্তক্ষরণ হচ্ছে যে মাথার খুলি ও মগজের কি অবস্থা বুঝার উপায় নেই, রক্তাক্ত প্রান্তর, রক্তক্ষরণ দ্রুততার সঙ্গে বন্ধ না করা গেলে পরেরদিন সকাল হয়ত রোগীর পক্ষে আর দেখা সম্ভব নয়।

ঢাকায় তো আমাদের হাসপাতালের গাড়ি থাকে না, সেই দূর দুরান্ত থেকে গাড়ি এল, আমি গেলাম, আল্লাহ্ র রহমতে টানা ৩ ঘন্টা যমে-মানুষে টানাটানি করে সন্তোষজনক অবস্থায় শেষ রাতে বাসায় ফিরে আসা গেল, মোটামুটি secure আলহামদুলিল্লাহ।

অথচ দেখেন, তার পরিবারের লোকজন জানেই না কি হচ্ছে, নিশ্চই রাগ করছে, কেন ফিরছে না, এদিকে ওদিকে খোঁজ করছে, হয়ত ইফতারি নিয়ে বসে আছে, লোকটা ফিরলে সবাই একসাথে বসে খাবে। আর জানেন তো, পথে অজানা-অচেনা লোক অজ্ঞান হয়ে পরে থাকলে কোন না কোন সুহৃদয়বান লোক সর্বপ্রথম তার মোবাইল আর মানি ব্যাগটা আত্মসাৎ করেন, ফলে মানুষগুলো traceless হয়ে যায়।

পরের দিন শুক্রবার, আমি শনিবারে ICU এ এসে দেখি ভদ্রলোকের ১০২ জ্বর। হাসপাতালে ভর্তি সকল রোগীর রুটিনলি COVID-19 টেষ্ট করা হয়, সন্ধ্যায় রিপোর্ট আসলো রোগী (+)ve

রোগীকে emergency তে attend করা ৬/৭ জন, OT এর স্টাফ ৬/৭ জন, ICU এর স্টাফ ১০/১২ জন সবাই টেষ্ট দিল ও কোয়ারান্টাইনে চলে গেল, এ যেন ঠক বাঁচতে গাঁও উজার অবস্থা। একজন ডাক্তার ও একজন সিষ্টারের (+)ve আসল। আগের নিয়মে কন্ট্রক্ট ট্রেসিং করে সবাইকে ১৪ দিন কোয়ারান্টাইনে রাখলে হাসপাতাল carry on করা আজকাল প্রায় অসম্ভব, জনবলের এত প্রতুলতা নেই। তাই যাদের পর পর দুটো sample (-)ve এসেছে ও আসছে, তাদের আবারও কাজে যোগদান করতে বলা হচ্ছে।

তৃতীয় ঘটল আরেক ঘটনা, আরেক রোগী ICU তে, পাশের রোগী snake bite, দুদিন পরে শুনি সেও (+) ve, কৈ যাই, আর কতবার নিজের টেষ্ট করানো যায়।

Basically community transmission কথাটার অর্থই হল আমরা source খুঁজে পাব না, তবে পথে প্রান্তরে, আকাশে বাতাসে শুধু করোনা আর করোনা। আমরা বসে থাকলে রোগী বাঁচানোর চেষ্টা করবে কে, এ যুদ্ধে বাঁচলে গাজী মরলে শহীদ, আল্লাহ্ রহম করুণ। আশা করি, কেউ ভুল বুঝবেন না বা দূরে ঠেলে দিবেন না।

এ গল্প শুধু আমার না, আমাদের প্রায় সকলের।

যতক্ষণ 'হায়াতে তৈয়েবা' অর্থাৎ সুস্থ সবল হয়ে বেঁচে আছি, ততক্ষণ তো কারো বিপদ হলে করোনার দোহাই দিয়ে বাসায় থাকা সম্ভব নয়। নিজের ও সঙ্গীদের মৃত্যু ঝুঁকি জেনেও আমাদের এগিয়ে আসতে হবে ও হচ্ছে।

ঝড়ে উড়ে যাবে, বৃষ্টিতে ধুয়ে যাবে, রোদে পুড়ে যাবে এগুলো শুধু অলীক কল্পনা মাত্র।

 

আল্লাহ্ আমাদের মঙ্গল করুন।
_____________________

ডাঃ মোঃ শরিফুল ইসলাম সুজন
শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ, বগুড়া
৪র্থ ব্যাচ
এম, বি, বি, এস ২০০১
এফ, সি, পি, এস
(নিউরো-সার্জারী)

___________________________

AD.. 

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়