ডাক্তার প্রতিদিন

Published:
2020-04-20 18:03:39 BdST

বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সর্বশেষ খবর কি: করোনা সন্দেহে ২ মৃত্যু : অত:পর


 

ডেস্ক
__________________

বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালের সর্বশেষ খবর কি ! সারা বাংলাদেশ এখন শেবাচিম পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে। বিশ্বের নানা দেশ থেকেও আসছে ফোন।
বরিশাল থেকে সংবাদদাতারা জানান, বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে আইসোলেশনে থাকা বেদে যুবকের মৃত্যু হয়েছে। রোববার ১৯ এপ্রিল বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে তার মৃত্যু হয়।
রোববার সকাল পৌনে ৮টার দিকে শেবাচিমের করোনা ওয়ার্ডে আইসোলেশনে মৃত্যু বরণ করে জাহাঙ্গির হোসেন ।
মৃত্যু হওয়া যুবক লিটন (২৫) গত ১৭ এপ্রিল রাত ৯টায় জ্বর, সর্দি এবং কাশিসহ করোনার উপসর্গ থাকা সত্যেও তথ্য গোপন করে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারী ইউনিট-৩ এর ওয়ার্ডে ভর্তি হয়।

বিষয়টি প্রকাশ পেলে ওইদিন রাত রাত ১০টার দিকে লিটন নামের ওই যুবককে করোনা ওয়ার্ডে আইসোলেশনে পাঠানো হয়েছিল। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে লিটনের।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শেবাচিম হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার আবুল কালাম। তিনি বলেন, মৃত যুবক লিটন মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার সুলতানী গ্রামের আব্দুল সরদারের ছেলে। সে একজন বেদে ছিলেন বলে তার স্বজনদের কাছ থেকে জানাগেছে।

রোববার সকাল পৌনে ৮টার দিকে শেবাচিমের করোনা ওয়ার্ডে আইসোলেশনে মৃত্যু হয় জাহাঙ্গির হোসেন নামের অপর এক ব্যক্তির। তার বাড়ি মঠবাড়িয়ায়। তিনিরও করোনাভাইরাসের উপসর্গ ছিল।

১৮ এপ্রিল রাত ৯টা ৫০ মিনিটে তিনি শেবাচিম হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে ভর্তি হন। মৃতব্যক্তির নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠানোর পাশাপাশি মৃতদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

এছাড়া বিকেল সাড়ে ৫টায় মৃত্যু হওয়া যুবকের নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষার জন্য শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের পিসিআর ল্যাবে প্রেরণ করা হলেও রিপোর্ট পাওয়া যায়নি।
________________


শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হতে বলছিঃ

শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হতে বলছিঃ


ডা. মোঃ ফয়সাল ইসলাম ফাহিম।
অনারারী মেডিকেল অফিসার,মেডিসিন ইউনিট-৩__________

শেরে-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে সমগ্র দেশবাসী এতোক্ষণে জেনে গেছে যে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ণ ডক্টরস হোস্টেল বাধ্যতামূলক লকডাউনের ফলে প্রায় দেড়শ জন ইন্টার্ণ ডক্টর সেলফ আইসোলেশনে।

কেন এই লকাডাউন?কি হয়েছিল এখানে?

আসুন ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করিঃ

গত ১৩/০৪/২০২০ তারিখে বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ থেকে আসা জনৈক অজ্ঞান রোগীকে ভর্তি করা হয় শেবাচিমহা এর মেইল মেডিসিন ইউনিট-৩ এ। কর্তব্যরত দুই ইন্টার্ণ চিকিৎসক রোগী অজ্ঞান দেখে রোগীর লোকদের কিছুদিনের মাঝে জ্বর কিংবা শ্বাসকষ্ট হয়েছিল কিনা জিজ্ঞাস করলে তারা খুব বিশ্বাসযোগ্যভাবেই তা অস্বীকার করে।পরবর্তীতে ইউনিটের সিনিয়র ডাক্তার প্রাথমিকভাবে দেখে ও রোগীর লোকের কাছে শুনে ধারণা করেন স্ট্রোক(মস্তিষ্কে রক্তজমাট কিংবা রক্তক্ষরণজনিত রোগ) অথবা ইলেক্ট্রোলাইট ইম্ব্যালান্স(শরীরে অস্বাভাবিক লবণ ঘাটতিজনিত সমস্যা) হয়েছে রোগীর। সেভাবেই রোগীর চিকিৎসা শুরু করা হয় এবং প্রয়োজনীয় টেস্ট করাতে দেওয়া হয়। কিন্তু পরের দিনে রোগীর অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় এবং এক্সরে ফিল্ম দেখে করোণা সন্দেহ হওয়ায় আবারো রোগীর লোকদের সুন্দরভাবে জিজ্ঞাসা করা হয় কোন জ্বর বা গলাব্যাথা এসব হয়েছিল কিনা কয়েকদিন আগে।তারা আবারও অস্বীকার করে। কিন্তু তাদের কথায় বসে না থেকে ইউনিট প্রধানের কথায় রোগীর করোনা টেস্ট করার জন্য স্যাম্পল পাঠানো হয়, এবং পরের দিনই অর্থ্যাৎ ১৫/০৪/২০২০ তারিখে রোগীর টেস্টের রেজাল্ট পজিটিভ আসে! তখন রোগীর লোকজন স্বীকার করে নেয় যে রোগীর জ্বর এবং শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল হাসপাতালে আসার আরো অনেক আগে থেকেই!

কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে।।

হিস্ট্রি গোপন করে রোগীকে ভর্তি করা হল তেরো তারিখে,নীচ থেকে ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার দেখে উপরে পাঠাল, তাকে রিসিভ করল ইণ্টার্ণ দুজন ডাক্তার, দেখল অন্যান্য সিনিয়র ডাক্তার,তারপর জেনারেল ওয়ার্ডে অন্যান্য প্রায় ৬০/৭০ জন রোগীর সাথে বেডে দেওয়া হল অন্যান্য অজ্ঞান পেশেন্টের মতই,দুদিন পর পনের তারিখে জানা গেল তার কোভিড-১৯ পজিটিভ!

ঠিক কতজন মানুষ ১৩-১৫ তারিখ এই দুইদিন এই রোগী দ্বারা আক্রান্ত হয়ে গেল নিজেদের অজান্তে একবার হিসেব করুন? শুধুমাত্র একটি মিথ্যে তথ্য দিয়ে ডাক্তারদের বিভ্রান্ত করার জন্য ?

হিসেব করে দিচ্ছি আমি।

রোগী যেই এম্বুলেন্সে এসেছে তার লোকজন, রোগীকে ট্রলিতে করে যে ট্রলিম্যান নিয়েছে সে, ইমার্জেন্সি যে অফিসার দেখেছে,ইমার্জেন্সীর অন্যান্য কর্মচারীরা,যে লিফটম্যান লিফটে উঠিয়ে এনেছে,যে দুজন ইন্টার্ণ ডাক্তার রিসিভ করেছে রোগী, সেই ইন্টার্ণদের সাথে আরো যে ১৫ জনের উপর ডাক্তার একই রুমে বসে ডিউটিতে ছিল, রোগী যে জেনারেল ওয়ার্ডে ছিল সেখানের আরো ৬০ থেকে ৭০ জন রোগী,তাদের প্রত্যেকের ২/৩ জন করে প্রায় দুশোর মত ভিজিটর, ওয়ার্ডের দ্বায়িত্বে থাকা প্রতিজন নার্স,ওয়ার্ডবয়,ক্লিনার। হিসেবটা বুঝিতে গিয়ে আপনার মাথা চক্কর দিলেও আপনাকে দোষ দেবনা আমি!

ফলাফলস্বরূপ বাধ্যতামূলক লকডাউন করতে হল মেডিসিন ইউনিট ৩ এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে। ঘটনা এখানেই শেষ হলে হতো, কিন্তু হয়নি।

মনে আছে ওই দুজন ইন্টার্ণ চিকিৎসক এর কথা? তাদের কথায় আসি।

আপনার মনে হতেই পারে যে ডাক্তাররা তো পিপিই পরে রোগী রিসিভ করে, সরকারই তো সাপ্লাই দিয়েছে সব। তাহলে সমস্যা কি হলো ইন্টার্ণ সেই ডাক্তারদের?

এবার আপনাদের একদম সত্যটা আবার বলি যেটা আপনারা হয়ত এতোদিনে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখেছেন, তা হল-ডাক্তারদের পিপিই দেওয়া হচ্ছে ঠিকই,কিন্তু সম্পূর্ণ বাজে এবং মানহীন নামেমাত্র পি পি ই!

বিশ্বাস করুন, আমাদের পিপিই এর নামে যে স্যুট দেওয়া হয়েছে তা কোন আদর্শ হাজমাত স্যুট না,সেটা দেশী একটা কোম্পানির বানানো রেইনকোট, 'ফ্রগটগ' নাম সম্ভবত কোম্পানিটার,সারাবছর স্পেশালি বর্ষার সময় পাওয়া যায়। যেই গগলস দেওয়া হয়েছে তা বাচ্চাদের খেলনা চশমার মত পাতলা একটা প্লাস্টিকের গ্লাস, মাস্ক হিসেবে আদর্শ N-95 এর বদলে দিয়েছে পাতলা গেঞ্জির কাপড়ে সেলাই করা জোড়াতালি মাস্ক যা দিয়ে ধুলা কিছু আটকালেও কখনোই কোন ভাইরাস আটকাবেনা!!

আর সেই ইন্টার্ণ দুজন আরেকটু ভালো কোয়ালিটির গাউন নিজের দায়িত্বে কিনে পরেছিল, তাও শেষরক্ষা হলোনা কারণ তাদের আদর্শ মাস্ক N-95 এর বদলে কাপড়ের ন্যাকড়ার মত মাস্ক এবং সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক পরে একজন করোনা পেশেন্ট ডিল করতে হয়েছিল!!

এখন বলতে পারেন N-95 মাস্ক কেন কিনে নিলনা তারা? প্রথমত N-95 মাস্ক এখন মহামারীর কারণে ব্যক্তিগতভাবে সংগ্রহ করা যাচ্ছেনা,দ্বিতীয়ত একজন ইন্টার্ণ যে এখনো সরকারের কাছ থেকে ১ টাকাও সম্মানি পায়নি ট্রেনিং এর প্রথম মাস শেষ হয়নি বলে সে কিভাবে ১০০০-১২০০ টাকা দিয়ে ওয়ান টাইম ইউজের জন্য মাস্ক কিনবে? কেনই বা কিনবে? এই মাস্ক এবং অন্যান্য সুরক্ষাসামগ্রী কি প্রশাসনের সাপ্লাই দেওয়ার কথা ছিলনা ডাক্তারদের?

ফলাফল গতকাল ওই দুজন ইন্টার্ণ এর করোনা টেস্টের রেজাল্ট পজিটিভ আসলো।।

১৫ তারিখের আগে তারা বিনা সন্দেহে ডিউটি করেছে,হোস্টেলে অন্যদের সাথে থেকেছে,খেয়েছে।তখনো আমরা কেউই জানিনা ওই পেশেন্ট এর লোক আমাদের মিথ্যা বলেছে,পেশেন্টের করোনা পজিটিভ!
যতক্ষণে জানলাম ততক্ষণে ওই দুজন থেকে আরো ইন্টার্ণ ডাক্তার ইনফেক্টেড হয়ে গেল! ফলাফল তাদেরই আরো একজন ইন্টার্ণ ডাক্তার এবং সামনের মাসে পরীক্ষা উপলক্ষ্যে হলে থাকা পঞ্চম বর্ষের আরেক ছাত্র কোভিড-১৯ পজটিভ! এই নিয়ে মোট ৪ জন ডাক্তার কনফার্মড পজিটিভ। বাকিদের এখনো টেস্ট করা বাকি,করা গেলে সংখ্যাটা কত হয় আপনারাই মিলিয়ে নেবেন দয়া করে।

বর্তমানে শেরে বাংলা মেডিকেল ডক্টরস হোস্টেলে প্রায় ১৫০ জনের উপর ডাক্তার থাকে যারা কোভিড আক্রান্ত ইন্টার্ণদের সাথে ওই দুদিন একই ডায়নিং এ খেয়েছে,পাশাপাশি রুমে থেকেছে, যাদের অনেকেই তাদের সাথে একইসাথে ডিউটি করেছে,সংস্পর্শে এসেছে।
ফলাফল- শের ই বাংলা মেডিকেল এর ডক্টরস হোস্টেল ১৫০ জন ডাক্তারসহ বাধ্যতামূলক লকডাউনে!!

নিউজে দেখলাম বলা হচ্ছে ইন্টার্ণরা কর্মবিরতিতে গেছে। সত্যটা হচ্ছে এমন কিছুই হয়নি। ইন্টার্ণরা হাসপাতালে যাওয়ার সাহস পাচ্ছেনা,যদি সে পজিটিভ হয়? যদি তার কারণে সাধারণ পেশেন্ট কিংবা অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হন? গণহারে সমস্ত ডাক্তারকে টেস্ট করা ছাড়া তো জানা সম্ভব নয় কে আক্রান্ত হলো,কে নয়!

এখন আপনারা কাকে দোষ দিবেন?

আক্রান্ত হয়েছে কিনা সেই ভয়ে আতঙ্কিত লকড ডাউন ডাক্তারদের? নাকি যেই পেশেন্ট পার্টি হিস্ট্রি গোপন করে এই সমস্ত জনপদকে বিপদে ফেলে দিল তাদের?

নাকি শুরু থেকেই ডাক্তারদের মানসম্মত সুরক্ষাসামগ্রীর বদলে নিম্নমানের জিনিস দিয়ে জোর করে ডিউটি করিয়ে এই সিচুয়েশনে নিয়ে আসা প্রশাসন কে?

উত্তরটার অপেক্ষায় রইলাম।

-ডা. মোঃ ফয়সাল ইসলাম ফাহিম।
অনারারী মেডিকেল অফিসার,মেডিসিন ইউনিট-৩,
শেরে-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

__________________

 

বিজ্ঞাপণ যোগ ------

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়