ডাক্তার প্রতিদিন
Published:2020-04-20 16:43:28 BdST
করোনা চ্যালেঞ্জের জাতীয় টেকনিকাল পরামর্শক কমিটির প্রতি খোলা চিঠি
ডাঃ অসিত বর্দ্ধন
____________________
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন এর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গঠিত জাতীয় টেকনিকাল পরামর্শক কমিটির প্রতি খোলা চিঠি
সকল চিকিৎসকদের প্রিয় এবং শ্রদ্ধাভাজন মাননীয় সিনিয়র অধ্যাপকবৃন্দ
জাতীর এই ক্রান্তিলগ্নে, সকল চিকিৎসক যখন করোনা মোকাবেলার উদ্ভূতেরে ব্যবস্থাপনায় হতাশায় নিমজ্জিত, ব্যাক্তিগত প্রাণহানির তীব্র আশঙ্কায় আতঙ্কিত, রোগীদের ঠিকমত চিকিৎসা দিতে না পারায় মর্মাহত, সেই সময়ে চিকিৎসা সেবা ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখা আপনাদের এই কমিটিতে দেখতে পেয়ে আমি আশাবাদী।
খোলা চিঠিতে যেভাবে বন্দনা থাকে , আমি সেরকম কিছু লিখতে চাইনা।
করোনা আগমন কালীন সময়ে সোশাল মিডিয়াতে ডাক্তারদের বিভিন্ন গ্রুপের পোষ্ট গুলো থেকে যে তথ্য পেয়েছি তা আমার কাছে বিভ্রান্তিকর মনে হয়েছে। আমি কয়েকটি পয়েন্টে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
১। পিপিই কথাটা নিয়ে আমলা, চিকিৎসক সম্প্রদায়, সংবাদ মাধ্যম, প্রধানমন্ত্রীর দফতর খুব ওয়াকিবহাল মনে হয়নি। যে ড্রেস আমরা পিপিই নামে দেখেছি সেটা জীবাণু প্রতিরোধী হওয়ার পরিবর্তে জীবাণু বিতরণের আধার হয়ে উঠেছে। এটি ডিস্পজেবল হওয়া জরুরী। এটা রি-ইউসেবল করতে হলে কিভাবে জীবাণুনাশ করা হবে, কোথায় করা হবে, কে করবে, কেন ব্যাক্তিগত ভাবে করা উচিৎ হবে না, এর বিপদ কি , এবং এজন্য সরকারী হাসপাতালে কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এসংক্রান্ত বিশদ নির্দেশনা দেখিনি। এই স্যুট অবশ্যই হাসপাতালের ভেতরে জীবাণুমুক্ত করা, শুকানো , ও বিতরণের সুব্যবস্থা করতে হবে, এবং দ্রুত।
২। পিপিই সংখ্যা বড়ই বিভ্রান্তিকর ! সরকারি হিসাব বলছে " " হাজার পিপিই বিতরণ করা হয়েছে। এর মানে কি সেই সংখ্যাটা এই স্যুটের? না কি প্রত্যেকটা পিপিই মানে একটা সেট যেটার মধ্যে সম্পূর্ণ শরীর ঢাকা কয়েকটি বা একটি পোশাক, ১টি N-95 মাস্ক, ২টি সূ কভার, ১টিক্যাপ, ১টি ফেস শিল্ড বা গগলস আছে ? এই সেটের কোন কোনটা ডিসপজেবল , আর কোনটা রি-ইউসেবল ? যদি শুধু ১টি করে স্যুট দিয়ে পিপিই দেয়া হয়েছে বলা হয়, তাহলে এটা যেমন চরম মিথ্যাচার, তেমনি আমাদের সকল স্বাস্থ্যকর্মিদের সুইসাইড মিশনে পাঠানোর সামিল ( মুক্তিযোদ্ধারা বুকে মাইন বেধে নিজের মৃত্যু দিয়ে শত্রু নিধন নিশ্চিত করতেন যেভাবে, সেভাবে আমরা কি আমাদের স্বাস্থ্যকর্মিদের অরক্ষিত অবস্থায় আক্রান্ত হওয়া নিশ্চিত জেনেও তাদের চিকিৎসা করতে পাঠবো ? ) ! N-95 মাস্ক ছাড়া কোন কর্মিকে করোনা পজিটিভ রোগীর কাছে পাঠানো আর বুলেট প্রুফ ভেস্ট ছাড়া টেররিস্টদের সাথে যুদ্ধে র্যাব পাঠানো একই কথা।
৩। আমাদের ঠিক কতগুলো পিপিই দরকার সেটার মাথামুণ্ডু হিসেব কারো কাছে আছে কি না সন্দেহ! যতগুলো হাসপাতাল করোনা ডেডিকেটেড সেই হাসপাতালের এক শিফটের সকল কর্মিকে ৩ দিয়ে গুণ করে প্রতিদিনের সংখ্যা পাওয়া যাবে। যদি আমরা ধরে নেই প্রতিদিন ১০ হাজার ডাক্তার নার্স, আয়া, টেকনিশিয়ান, কাজ করছে তাহলে আমাদের অন্তত প্রতিদিন ৩০,০০০ সেট দরকার। যদি ধরেও নেই যে এই সেট একদিন পর জীবাণুমুক্ত হয়ে আসবে তাহলেও আমাদের ৬০,০০০ পিপিই দরকার। মনে রাখতে হবে, মাথার ক্যাপ, সারজিক্যাল মাস্ক , N-95 মাস্ক ডিসপজেবল। তাহলে প্রতিদিন সারা বাংলদেশে কত সেট এগুলো দরকার? n-95 মাস্ক রি-ইউস করা যায় শুধু তখন, যখন এটা সঠিক নিয়ম মেনে ডিসইনফেক্টেড করা হয় ( সেখানেও অনেক কথা আছে। নজরুল ইসলাম স্যার জানবেন) । ঢাকায় এবং পেরিফেরি হাসপাতালে কি আছে সেই ব্যবস্থা? না থাকলে যতদিন সে ব্যবস্থা না হয়, ততদিন নতুন মাস্কের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে পিপিই নিয়ে আমলাদের পরিসংখ্যান ও বাস্তবতার পার্থক্য দূর করা সম্ভব হবে। এক রোগী থেকে আরেক রোগী দেখার সময় গ্লাভস পরিবর্তন করতে হয়। প্রতিদিন হাসপাতালে কতগুলো গ্লাভস সরবরাহ হচ্ছে? আমরা কি নিজেরাই রোগীকে সঙ্ক্রামিত করে চলেছি? করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল ছাড়াও অন্য চলমান হাসপাতালগুলোতে কতগুলো পিপিই ( সব কিছুর সেট) লাগবে?
৪। সকল স্বাস্থ্যকর্মির থাকা খাওয়ার চরম অব্যবস্থাপনা চলছে। আহাজারিতে ভরে আছে অনলাইন । চোখ খুলে দেখতে চাইলে অসংখ্য পোষ্ট পাওয়া যাবে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য ব্যাবস্থা করা কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়। সাপ্লাই চেন ঠিক না রেখে কোন সেনাবাহিনী কি যুদ্ধে জিততে পেরেছে কখনো?
৫। করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের মুল চিকিৎসা রেস্পিরেটরি সাপোর্ট। সরকারী বেসরকারি মিলিয়ে আইসিইউ যা আছে তাও যথেষ্ট নয়। এছাড়া ওয়ার্ডেও অক্সিজেন লাগবে । সেগুলোতে অক্সিজেন সাপ্লাই নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যেখানে সিলিন্ডার সাপ্লাই প্রয়োজন ,এই চেইন কে জরুরী সেবার আওতায় আনুন। খুলনা থেকে বা রাজশাহী থেকে যদি কোন সিলিন্ডার ঢাকায় ভরতে পাঠানো হয়, সেটা আনা নেওয়ার জন্য সময় কত লাগবে? আমাদের হাতে থাকা সিলিন্ডার দিয়ে আমরা কয়জন রোগীকে অক্সিজেন দিতে পারি সেই হিসাবটা জানা থাকা দরকার। কমিটিতে খলিল স্যার আছেন, তাঁর চাইতে ভালো ধারণা আর কে দিতে পারেন আপনাদের?
৬ । উপরে যা বলেছি তাঁর বেশিরভাগই লজিস্টিক। আপনারা বেশিরভাগ সদস্যই ক্লিনিকাল সাইডের। আপনারা কি আদৌ এই লজিস্টিক নিশ্চিত করতে পারবেন? এটা কি আপনাদের " টার্মস এন্ড কন্ডিশনের" মধ্যে পড়বে? আমাদের আমলারা চরম ব্যার্থ । তাই চিকিৎসকেরা তাকিয়ে থাকবে আপনাদের দিকে।
প্রধানমন্ত্রীর ভিডিও কনফারেন্স দেখে মনে হয়েছে তাঁর কাছে এসব সমস্যার তথ্য নেই। আপনারা কি এই সমস্যা তাঁর কাছে সরাসরি তুলে ধরবেন? আমাদের আকাঙ্ক্ষা থাকবে আপনারা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে জানাবেন। কারণ প্রধানমন্ত্রী ছাড়া এই মুহুর্তে আর কেউ, না ডাক্তারদের, না জনগণের আস্থায় আছেন।
৭। তরুণ ডাক্তারদের কথা শোনার কেউ নেই, অজস্র হুমকি,ধামকি দেওয়া চিঠি অনলাইনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আপনারা কি এর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেবেন?
৮। আপনাদের কাছে প্র-এক্টিভ কাজ আশা করছি। আমলারা হযবরল করে ফেলেছে কাজে পিছিয়ে থেকে। আপনারা প্রতিদিন মিটিং করবেন, পরিস্থিতি মনিটর করবেন, এবং চিকিৎসকদের ও জনগণকে নির্দিধায় সত্য পরিস্থিতি জানাবেন। নাহলে আপনাদের এতদিনের অর্জিত সুনাম আমলাদের ব্যর্থতার দায় নিয়ে সামান্য হলেও কালিমা লিপ্ত হবে।
আমলাদের একটি প্রিয় কাজ হচ্ছে, যে কোন সমস্যার পড়লে একটি কমিটি করে দেওয়া। নিজের উপর থেকে আলো সরিয়ে দেওয়া। আশা করি তারা আপনাদের উপর সেই একই কায়দা খাটাতে পারবে না। যদি আপনার ব্যার্থ হন তাহলে সুরঙ্গের শেষের শেষ আলোটাও নিভে যাবে!
ডাঃ অসিত বর্দ্ধন
এনেস্থেসিওলজিস্ট , ভ্যাঙ্কুভার , কানাডা
[email protected]
আপনার মতামত দিন: