Ameen Qudir
Published:2020-04-14 15:46:49 BdST
একজন কসাইয়ের অসহায় মায়ের করুণ আবেদন
মডেল ছবি হিসেবে প্রখ্যাত স্বাস্থ্যসেবী মাতা কন্যা ইয়াস মিন হালিমা ও সীমা ইয়াসমিনের ছবি সৌজন্য ব্যবহার করা হল। বা/স
ডেস্ক
__________________
একজন কসাইয়ের অসহায় মায়ের করুণ আবেদন
আপনারা আপনাদের বাচ্চাদের মেডিকেল কলেজে পড়তে পাঠাবেন না।
তাদের জীবনটা ধ্বংস করে দেবেন না।
লেখা প্রাপ্তি শাহাদাৎ হোসেন রোমেল-র সৌজন্যে।
-------- -------- -------- -------- -------- -------- -------- --------
এক ডাক্তারের মায়ের কথা। আপনার পুরোটা পড়ার দরকার নেই। SSC, HSC বাদ দেন, মেডিকেলের ৫-৬ বছরের এত কষ্টের, এত নির্যাতনের কথাও বাদ দেন। শুধু MBBS পাশের পর থেকে পড়ুন। দেশের ৯০% জুনিয়র ডাক্তারের অবস্থা এর চেয়েও খারাপ।আপনি পড়ুন আর আশেপাশের সবাইকে নসিহত করুন, কোন মা বাবা যেন তার সন্তানকে ডাক্তার বানানোর সপ্ন না দেখে। এ পাপ যেন কেউ না করে। নিচে লেখাটা কপি পেস্ট করলাম।
====================================
আমার নাম জাহানারা কুমকুম। আমি একজন অপরাধী মা, কারণ আমার মেয়ে ডাক্তার।
খুব কম বয়সে মা হয়েছিলাম আমি। যৌথ পরিবারের অনেক কাজের ফাঁকেও জানতাম মেয়েটাকে মানুষ করতে হবে, স্বনির্ভর করে গড়ে তুলতে হবে।
অনেক কিছুই বুঝতে পারতাম না, কিন্তু মেয়ের জন্য সেরা টিচার সেরা নোট জোগাড় করতে চেষ্টা করতাম সব সময়। মেয়েটা ম্যাট্রিকে স্ট্যান্ড করবে, এইজন্য ওর বাবা খাওয়ার টেবিলের স্বচ্ছ অয়েল ক্লথের নিচে স্ট্যান্ড করা ছেলে মেয়েদের সাক্ষাৎকারের পেপার কাটিং রেখে দিয়েছিল।
ওর পরীক্ষা দেওয়ার আগের বছরই স্ট্যান্ডের সিস্টেম উঠে গেল। শুরু হয়ে গেল জিপিএ সিস্টেম।
ওর ম্যাট্রিক পরীক্ষার টেস্টের আগের দিন ওর ছোট ভাইয়ের জন্ম হল। ছেলেটা আমার জন্মের পর থেকেই অসুস্থ ছিল। হাসপাতালে হাসপাতালে দৌড়াতাম, সাথে থাকত আমার ছোট মেয়েটা, আমার আঁচল ধরে। তখন থেকেই স্বপ্ন ছিল বড় মেয়েটাকে ডাক্তার বানাব, শিশু বিশেষজ্ঞ হবে সে।
মেয়েটার ম্যাট্রিক পরীক্ষা শুরুর এক দিন পরই ওর ছোট ভাইয়ের মৃত্যু হল। এই অবস্থায় পরীক্ষা দিয়েও আমার মেয়েটা এ প্লাস পেয়ে গেল। সব সাংবাদিকদের সে কি মাতামাতি। একজন বাসায় চলে আসলেন ইন্টারভিউ নিতে।
আমি আশায় বুক বাঁধলাম, মেয়েটা আমার অনেক বড় হবে, অনেক বড় কিছু করবে জীবনে।
ইন্টারমিডিয়েটের পরে দুই জায়গায় মেডিকেল ভর্তি কোচিং এ ভর্তি হল মেয়েটা, বার বার বলেছিল একটা ভার্সিটি কোচিং এও ভর্তি হওয়া দরকার, কিন্তু আমরা করাইনি, নিশ্চিত ছিলাম সে মেডিকেল কলেজেই চান্স পাবে।
হিরা স্যারের কোচিং এ আমার মেয়েটা সব পরীক্ষায় হায়েস্ট মার্কস পেত, খুব আশা ছিল মেয়েটা ঢাকার ভেতরের কোনো মেডিকেল কলেজেই চান্স পাবে। খুব বেশি দূরে হলে হয়ত ময়মনসিংহ যেতে পারে, অসুবিধা নেই, ওখানে আম্মার বাসা আছে।
কিন্তু কী জানি কপালের ফেরে মেয়েটা চান্স পেল সেই কোন সুদূর বরিশালে, যেখানে আমার কোনো আত্মীয় স্বজন নেই। প্রথমে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল। তারপর যখন জানতে পারলাম ওর সাথে একই স্কুলে কলেজে পড়া তাজকিয়াও একই মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছে, একটু শান্তি পেলাম মনে।
শুনেছিলাম সরকারি মেডিকেল কলেজে পড়তে নাকি কোনো খরচই হয় না, কিন্তু মাথায় দ্বিতীয়বার আকাশ ভেঙে পড়ল যখন প্রাইমেট থেকে ফার্স্ট ইয়ারের বইয়ের লিস্ট ধরিয়ে দিল। লিস্টের সব বই কিনতে প্রায় দশ হাজার টাকা লেগে যাবে তাই আপাতত অর্ধেক বই কিনে ওকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। আর একটা কংকাল না কিনলেই নয়। তারও তো দাম অনেক।
একবার কোনো মতে পাস করলেই তো টাকা আর টাকা। তার কিছুদিন পরেই মেয়ে আবার টাকা চাইল। এবার ফার্স্ট প্রফের পরীক্ষার ফর্ম ফিল আপের টাকা।
মাসে মাসে টাকা পাঠাতাম, মেয়েও টিউশনি করত। তারপরও ফার্স্ট প্রফ পাসের পর আবারও টাকা লাগল স্টেথোস্কোপ কিনতে, নতুন বই কিনতে।
আমি শুধু দিন গুনতাম, এই তো আর কয়টা দিন। একবার কোনো মতে পাস করলেই তো টাকা আর টাকা।
তারপর সেকেণ্ড প্রফের পরীক্ষার ফর্ম ফিল আপের টাকা, সেকেণ্ড প্রফ পাস করার পর ফাইনাল প্রফের পরীক্ষার ফর্ম ফিল আপের টাকা, বি পি মেশিন কেনার টাকা... অনেক টাকাই তো খরচ হল। তবে যে শুনেছিলাম ডাক্তাররা নাকি সব সরকারের টাকায় পড়ে?
ইন্টার্নি শেষ করে ঢাকায় এসে আবার কোচিং এ ভর্তি হল মেয়েটা। এফ সি পি এস পার্ট ওয়ানের কোচিং। সেখানেও গুনতে হল অনেক টাকা।
সাড়ে ছয় বছর দূরে ছিল বাসা থেকে, তার উপর ওর বাবার ধরা পড়ল ক্যান্সার। তাই ওকে বিসিএস দিতে বললাম না। আবার কোন গ্রামে চলে যেতে হবে।
আল্লাহর অশেষ রহমতে একবারেই এফ সি পি এস পার্ট ওয়ান পাস করল মেয়েটা। আমি নিশ্চিন্ত হলাম। নিশ্চয়ই এবার টাকা আসবে ঘরে।
কিন্তু না, আমার জানায় ভুল ছিল। এবার নাকি চার বছর বিনা বেতনে কাজ করতে হবে। এটা নাকি অনারারি ট্রেনিং! কি সর্বনাশের কথা!
এরপর শুরু হল ওর অমানুষিক জীবন। রাতে সামান্য কয়টা টাকার জন্য ক্লিনিকে ডিউটি করে সকালে দৌড়াত ট্রেনিং এর হাসপাতালে।
টানা আঠারো ঘন্টা কখনো জেগে থেকেছেন আপনারা? কিংবা এক জায়গায় নাইট করে অন্য কোথাও মর্নিং করতে গিয়েছেন? না গেলে বুঝতে পারবেন না।
প্রতিদিন মন খারাপ করে, রোগীর লোকের খারাপ ব্যবহার আর স্যার ম্যাডামের বকা খেয়ে। এই করোনার দিনগুলোতে আমি ওকে বলেছিলাম ডিউটি না করতে।
আমার স্বামী মারা গেছেন, আমি নিজেও অসুস্থ। ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেশারের রোগী। হাসপাতাল থেকে করোনাভাইরাস নিয়ে আসে কিনা, এই ভয় পাচ্ছি। বাসায় ওর ছোট বাচ্চাও আছে। মাকে খুব কমই পায় সে, সেই কথা আর নাই বা বললাম।
ফেসবুকে ঢুকলেই দেখি ডাক্তাররা নাকি পালিয়ে আছে, তারা নাকি রোগী দেখছে না। তাহলে আমার এত বকা খেয়েও যে আমার মেয়েটা মুখের উপর অবাধ্যতা করে ডিউটি করতে যাচ্ছে, সে কোথায় যাচ্ছে আসলে?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বললেন, বেসরকারি ডাক্তাররা নাকি কাজ করছে না। তাহলে আমার মেয়েটা কী করছে? ওর সাথে যারা আছে তারা কী করছে?
আপনারা বলেন, ডাক্তারদের অনেক টাকা। বিশ্বাস করুন আমিও তাই ভাবতাম। কিন্তু ওকে পড়াতে আমার যে পরিমাণ খরচ হয়েছে, তা ট্যাক্সের টাকায় আসেনি, আমার পরিবারের টাকায় এসেছে। ভবিষ্যতে কি হবে কিনা জানি না।
এদেশের মা বাবার প্রতি করজোড়ে অনুরোধ রেখে গেলাম, আপনারা আপনাদের বাচ্চাদের মেডিকেল কলেজে পড়তে পাঠাবেন না। তাদের জীবনটা ধ্বংস করে দেবেন না।
ইতি, একজন অপরাধী মা।
আপনার মতামত দিন: