Ameen Qudir
Published:2020-02-25 05:30:57 BdST
ডাক্তার লাঞ্ছনার সাতকাহন এবং কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা
ডা. আজাদ হাসান
_______________________
অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা এবং বাসস্থান, এগুলো মানুষের মৌলিক অধিকার।
কবি সুকান্তের ভাষা,
"যে শিশু ভূমিষ্ট হলো আজ রাত্রে,
তার মুখে খবর পেলুম,
সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,
নতুন বিশ্বের দ্বারে ব্যক্ত করে অধিকার,
জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে"।
হ্যাঁ, স্বাস্থ্যসেবা বা চিকিৎসাও মানুষের মৌলিক যে ৫টি উপাদান বা অধিকারের কথা উল্লেখ আছে তন্মধ্যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বা স্তম্ভ। তাই প্রতিটি জনগণের স্বাস্থ্যসেবা সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি এবং অঙ্গীকার করেই প্রতিটি সরকার ক্ষমতায় আসেন।
কিন্তু মান সম্মত সেবা নিশ্চিত করতে হলে স্বাস্থ্যসেবার সাথে সংশ্লিষ্ট খাতটি কেমন চলছে তা খতিয়ে দেখা উচিৎ। আর তাই এ ক্ষেত্রে জনগণের প্রত্যাশা, সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে সরকারের প্রস্তাবিত বাজেট, মান সম্পন্ন সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছা এবং গৃহীত পদক্ষেপ সমূহ মূল্যায়ন হওয়া উচিৎ। বলাবাহুল্য, এ ক্ষেত্রে ইস্পিত মানের সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে অন্তরায় সমূহ দ্রুত চিহ্নিত হওয়া প্রয়োজন এবং সেই মোতাবেক সমস্যার সমাধানে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রত্রিকার খবরে প্রকাশিত হচ্ছে আবার কিছু কিছু ঘটনা লোক চক্ষুর অগোচরে থেকে যাচ্ছে, আর তা হলো, বিভিন্ন স্তরের হাসপাতালে কর্তব্যরত অবস্থায় বিভিন্নভাবে চিকিৎসকরা শারীরিক ভাবে লাঞ্চিত হচ্ছেন এবং জীবন নাশের মতো জঘন্ন্য হুমকির সম্মুখীন হতে হচ্ছেন। এবং এ ক্ষেত্রে “চিকিৎসকদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা” প্রদানের বিষয়টি রাজনৈতিক কমিটমেন্ট -এর অভাবে বরাবরই সরকার অবহেলা করে আসছেন। ফলশ্রুতিতে চিকিৎসকরা আজ চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এবং তাদের মাঝে জন্ম নিচ্ছে চরম হতাশা। যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কোনো সুফল বয়ে আনবে না। পক্ষান্তরে ভারতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকদের নিরাপত্তার জন্য রয়েছে সুনির্দিষ্ট আইন বা চিকিৎসক সুরক্ষার নীতিমালা।
বর্তমানে বাস্তবতায় আমাদেরকে বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী হায়দার আলীর জনপ্রিয় গানটির কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়ঃ
"কতটুকু অশ্রু গড়ালে হৃদয় জলে শিক্ত,
কত প্রদ্বীপ শিখা জ্বালালে জীবন আলোয় দীপ্ত,
কত ব্যথা বুকে চাপালে তাকে বলি আমি ধৈর্য?
নির্মমতা কত দূর হলে জাতি হবে নির্লজ্জ?
আমি চিৎকার করে কাদিতে চাহিয়া,
করিতে পারিনি চিৎকার,
বুকের ব্যথা বুকে চাপাইয়া,
নিজেকে দিয়েছি ধিক্কার".
এ বছরের জানুয়ারী মাস হতে এ পর্যন্ত সময়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হতে শুরু করে জেলা সদর হাসপাতালে সংঘটিত বিভিন্ন অপ্রত্যাশিত ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যাচ্ছে, নিজেদের কর্মস্থলে দায়িত্বরত অবস্থায়ও মেডিক্যাল অফিসার কিংবা কনসাল্টেন্ট, ইউএইচএফপিও কিংবা সদর হাসপাতালের তত্বাবধায়ক, কেউই আর আজ নিজেদের কর্মস্থলে নিরাপদ নয়। কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে।
ঘটনা পুঞ্জি
Date - Place - Victim - Incidence
১) ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২০
বড়ুরা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কুমিল্লা।
ডাঃ ভাস্কর।
বলাকা বাসের স্টাফ কর্তৃক লাঞ্চিত।
২) ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২০
লাকশাম জেনারেল হাসপাতাল,কুমিল্লা।
ডাঃ তারেক হোসেন।
ছাত্রলীগের কর্মী দ্বারা হামলার শিকার।
৩) ১৭/০২/২০২০
লাকসাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কুমিল্লা। কর্তব্যরত চিকিৎসকসহ ২ জন আহত হিজড়াদের দ্বারা জরুরী বিভাগে হামলা এবং ভাংচুর।
৪) ১৬/০২/২০২০
পার্বতীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, দিনাজপুর। ★ডাঃ আবদুল্লাহ কাফি।
২ লক্ষ টাকা চাদা দাবী, অনাদায়ে জীবন নাশের হুমকি।
৫) ১৪/০২/২০২০
মধুখালি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
ডাঃ দেবজ্যোতি।
ঔষধ কোম্পানীর এমআর কর্তৃক নিগ্রহের শিকার।
৬) ১৫/০২/১৪৪১
কুমিল্লা শহর।
ডাঃ মারজুক রবি।
ছিনতাইকারী কর্তৃক মারাত্মকভাবে আহত।
৭) ১৫/০২/২০২০
কসবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ★ডাঃ আনিকা বাসারাত।
দূর্বৃত্তরা সরকারী কোয়ার্টারের গ্রীল কেটে ঘরে ঢুকে সম্পূর্ণ ঘর তছনছ করে দেয়। ঘর হতে নগদ অর্থ, মালামাল, মূল্যবান জিনিস পত্র লুন্ঠন করে।
৮) ১২/০২/২০২৯
মোংলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।
ডাঃ দেবোব্রত দেব।
মিঠাখালি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকে না চেনার কারণে কতিপয় দূর্বৃত্ত কর্তৃক দূর্ব্যবহার এবং হুমকির শিকার।
৯) ৮/০২/২০২০
নওগা ২৫০ শয্যা হাসপাতাল।
ডাঃ মোমিনুল হক। হাসপাতাল তত্বাবধায়ক।
শারীরিক ভাবে লাঞ্চিত করা হয়।
১০) ৩/০২/২০২০
ফুলতলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, খুলনা।
ডাঃ উত্তম কুমার দেওয়ান। কনসালটেন্ট, শিশুস্বাস্থ্য।
মেডিক্যাল এসিস্ট্যান্ট কর্তৃক ছুরিকাহত।
১৪) ৯/০২/২০২০
সাজেদা হাসপাতাল, চিটাগং রোড।
ডাঃ অভি
ইলেক্ট্রকিউশন-এর রোগী রেফার্ড করায় গালাগালি করা হয় এবং জীবন নাশের হুমকি দেয়া হয়।
১৫) 0৮/০২/২০২০
উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
ডাঃ শাহরিয়ার।
শ্রমিক লীগের স্থানীয় নেতা শিপন মোল্লাকে না চেনার অপরাধে হুমকির শিকার।
১৬) 0৬/০২/২০২০
কোটালিপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
ডাঃ শামসুল ইসলাম।
কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে মারতে উদ্যত হন।
১৭) ১৮/০২/২০২০
বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।
ইন্টার্নী চিকিৎসক শারীরিক ভাবে আক্রান্ত। সিসিইউ হতে পোস্ট সিসিইউ-তে রোগী চিফট করায় কর্তব্যরত চিকিৎসককে খামচে রক্তাক্ত করা হয়।
১৮) ১৪/১/২০২০
কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
ভুল চিকিৎসার অভিযোগে হৃদরোগ ইন্সটিটিউট-এ রেফার্ডকৃত রোগী পথিমধ্যে মৃত্যু বরণ করলে, হাসপাতাল ভাংচুর করা হয়।
১৯) ১১/০২/২০২০
লাঙ্গলকোট কুমিল্লা।
ডাঃ জহির।
সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন।
২০) ১১/০১/২০২০
গঙ্গাচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
মহিলা চিকিৎসক এর সাথে জনৈক ব্যক্তি দূর্ব্যবহার করেন।
২১) ১৫/০১/২০২০
কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
বুকে ব্যথার জন্য রেফার্ডকৃত রোগী হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে নেয়ার সময় পথিমধ্যে মৃত্যু বরণ করলে হাসপাতাল ভাংচুর করা হয়।
২২) ১১/০১/২০২০
নাসির নগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
ডাঃ অভিজিত রায়। ইউএইচএন্ডএফপিও।
চতূর্থ শ্রেণীর একজন কর্মচারীর শাস্তি মূলক বদলী আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রফেসর (ডাঃ) মোঃ আবু ইউসুফ ফকির, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (স্বাস্থ্য, শিক্ষা) কর্তৃক টেলিফোনে হুমকি-ধামকি, বদলী কিংবা চাকুরীচূতি, এমন কি জেল খাটানোর ভীতি ও হুমকি প্রদান করা হয়।
এভাবে প্রতিদিনই কর্মস্থলে চিকিৎসক লাঞ্ছনার ঘটনার লিস্ট দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। আর সেইসাথে চিকিৎসকদের মাঝে একদিকে যেমন পুঞ্জিভূত হচ্ছে চাপা ক্ষোভ অপর দিকে জন্ম নিচ্ছে গভীর হতাশা। আর এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে আজ তরণ চিকিৎসকরা এদেশে থাকতে ভরসা পাচ্ছে না যার ফলশ্রুতিতে অনেকে প্রতিশ্রুতিশীল চিকিৎসকরা আজ বিদেশে পাড়ি জমানোর পরিকল্পনা করছে।
প্রসংগত একটি বিষয় না বললেই নয়, সেটা হলো, টানেলের শেষ প্রান্তে আমরা “আলোর শিখা” দেখতে পাচ্ছি, যা আমাদেরকে ভবিষ্যতে আরো আত্মপ্রত্যয়ী এবং আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে।
উল্লিখিত প্রতিটি ঘটনায় কোথাও বিডিএফ, কোথাও বা এফডিআরএস এবং কোথাও কোথাও বিএমএ পৃথক পৃথক ভাবে ভুক্তভোগী চিকিৎসকদের পার্শ্বে সাহায্যের হাত প্রসারিত করেছেন। কখনো বন্ধুর মতো, কখনো সাহায্যকারী হিসেবে কখনো বা প্রতিকূল পরিস্থিতি হতে উদ্ধার কর্তা বা ত্রাণকর্তা হিসেবে স্ব স্ব অবস্থান হতে সবাই যার যার ভূমিকা রেখেছেন, যা সত্যিই প্রশংসনীয়। এজন্য বিডিএফ, এফডিআরএস, বিএমএ-সহ সবাইকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিএমএ-ও ভিকটিম বা ভুক্তভোগী চিকিৎসক এর পার্শ্বে দাড়ালেও এ ক্ষেত্রে বিএমএ-র কাছে চিকিৎসক সমাজের প্রত্যাশা আরো বেশী ছিলো, যা তারা পরিপূর্ণ ভাবে পূরণ করতে সমর্থ হন নাই।
এমতাবস্থায়, আমরা সাংবিধানিক কাঠামোর মাধ্যমে "চিকিৎসকদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা"র প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।
বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় চিকিৎসকদের সুরক্ষার জন্য "নিরাপদ কর্মস্থলে"র নিশ্চতার জন্য " চিকিৎসক নিরাপত্তা আইন" করার প্রয়োজনীয়তা খুব বেশী করে অনূভুত হচ্ছে। কিন্তু এ আইনটি আরো আগে করার প্রয়োজন থাকলেও অতীতে কোনো সরকারই এ নিয়ে মাথা ঘামান নাই। তাই আমরা যতই "নিরাপদ কর্মস্থল"-এর দাবী জানাই না কেনো, তাতে খুব একটা লাভ হবে মনে হয় না। এমতাবস্থায়, আমাদেরকে এই দাবী বাস্তবায়নের জন্য আরো
হোম ওয়ার্ক করা আবশ্যক। যেমনঃ প্রতি জেলায় জেলায় সাংবাদিক সম্মেলন করা যেতে পারে। তা ছাড়া স্বাস্থ্য বিষয়ক সংসদীয় কমিটি, মাননীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রী এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নীতি নির্ধারকদের সাথেও এই দাবীটির যৌক্তিকতা তুলে ধরে আলোচনা করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে আমরা "নিরাপদ কর্মস্থলে"র নিশ্চয়তাসহ রাজনৈতিক কমিটমেন্ট এবং সরকারী নির্দেশনা প্রত্যাশা করি।
পরিশেষে কবি সুকান্তের কথামালা দিয়ে শেষ করছিঃ
"আমি একটি দেশলাইয়ের কাঠি,
এত নগণ্য হয়তো চোখেও পড়ি না।
তবে জেনো মুখে আমার উসখুস করছে বারুদ,
বুকে আমার জ্বলে উঠবার দূরন্ত উচ্ছ্বাস।
আমি একটি ছোট্ট দেশলাইয়ের কাঠি।
আমরা বারবার জ্বলি নিতান্ত অবহেলায়,
কিন্তু আমরা জানি না,
কবে আমরা জ্বলে উঠবো সবাই একসাথে,
শেষ বারের মতো!
_____________________
ডা. আজাদ হাসান
সিওমেক
২১ তম ব্যাচ।
আপনার মতামত দিন: