Ameen Qudir

Published:
2020-02-23 21:19:36 BdST

চড়টা কোন একজন ডাক্তারের গালে পরেনি;পরেছে সকলের গালে


ডা. প্রলয় বসু
__________________________
চড়টা কোন একজন ডাক্তারের গালে পরেনি। পরেছে সকলের গালে। 'ভুল চিকিৎসা' নিয়ে ভুল ধারণা আমার জীবনে নিজের দেখা। নিজে সেই কষ্ট 'ভোগ' করেছি। মৃত্যু কখনো কখনো সত্যিই 'সময়' দেয়না।

ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু - মা আর আমি
-বেরসিক

সকাল বেলা, তখনো আমার ঘুমটা ভালো ভাবে ভাঙেনি, আমাদের ডুপ আমার গলা জড়িয়ে বললো, হ্যাপি ফাদার্স ডে। ডুপকে একটু চটকে দিয়ে বিছানা ছাড়লাম।
ফাদার্স ডে! বাবাদের দিন!!
বাবাকে ছোটবেলা থেকেই প্রচন্ড ভয় পেতাম। কাছে এলেই একধরনের জড়তা শরীর-মনকে গ্রাস করতো। কিছু করতে গেলেই মনে হতো বকা খাবো না তো?
আজ এতোদিন পর মনে হয় না, বাবা আমাদের খারাপ চাইতো, কিন্তু বাবার ভালো চাইবার পদ্ধতিতে কিছু নিশ্চয়ই গলদ ছিল। আমরা কেউই বাবার সাথে সহজ হতে পারিনি। কখনোই। আজও।
বাবা অসুস্থ হলে, ডাক্তারের নিয়ে যেতে গেলেও বাবাই ঠিক করবে, কার কাছে যাবে, কখন যাবে। হয়তো, বাবার চোখে আজও আমরা 'ছোট'ই আছি।
যাক সে কথা। আজ যে পিতৃদিবস, বাবাকে নিয়ে লিখবো ভেবেছিলাম, কিন্তু মা এসে বারবার পথ ঘুরিয়ে দিচ্ছে।

মায়ের অপারেশনের সময় আমি ক্লাস টেন, প্রিটেস্ট হয়ে গেছে। পুজোর পর স্কুল খুললেই টেস্ট। তারপর মাধ্যমিক।

আমরা জানতাম, মায়ের অপারেশন হবে। কিসের জন্যে? মায়ের বাঁ পায়ের হাঁটুর কাছে হাড়ে একটা টিউমার আছে। আড়াই বছর আগেও একবার অপারেশন হয়েছিল, কিন্তু আবার সেখানে টিউমার বেড়ে গেছে। সুতরাং আবার অপারেশন। না, বাবা কখনো আমার বা ভাইয়ের সাথে বসে কথা বলেনি এই নিয়ে। মায়ের মুখেই শুনতাম। মা আমার 'সেইসময়ের' সবচেয়ে বড় বন্ধু ছিল। বেঁচে থাকলে হয়তো আজও বন্ধুই থাকতো।

আমার 'মা' কখনোই 'মা' হয়ে ওঠেনি। আমার কাজে বাঁধা দিয়ে বলেনি,
এইটা করবি না,
এইটা করতে পারবি না,
এইটা করতে হবে না।
বরং বন্ধুদের মতো বলতো, চেষ্টা কর। আমি তোর হয়ে করে দেব না, তোর কাজটা তোকেই শেষ করতে হবে। কষ্ট হবে, একবারে পারবি না, অসফল হবি, দশবার চেষ্টা কর, নিশ্চই পারবি।
মায়ের হাত ধরেই, আমার যেমন পড়াশোনার হাতেখড়ি, তেমন মায়ের হাত ধরেই আমার গল্পের বইয়ের জগৎ চেনা, রাজনীতির সাথে পরিচয়, সমাজকে দেখতে শেখা।

আবার মায়ের কাছেই রান্না শেখা, ঘর মুছতে শেখা, বাসন মাজতে শেখা, সব।
আমার মনে আছে, আমাদের বাড়িতে শুক্লামাসি কাজ করতো। প্রতি মাসে মা একবার করে ছাড়িয়ে দিতো শুক্লামাসিকে কাজ থেকে। আবার শুক্লা মাসি মায়ের কাছে এসে, কান্নাকাটি করে কাজে যোগ দিতো। প্রতি মাসে নিয়ম করে পনেরো দিন শুক্লা মাসি কামাই করতো। এই নিয়মের কোন, পরিবর্তন হয়নি, অন্তত মা বেঁচে থাকা অবধি।
শুক্লামাসি যখনই কামাই করতো, তখন থাকতো আমার ঘরের কাজ শেখার পর্ব। এখন মাঝে মাঝেই মনে হয়, আমাদের কাজ শেখাবার জন্যেই মা শুক্লা মাসিকে কাজে বহাল রেখে দিত।

সিনেমা-সাহিত্য-সমাজ-রাজনীতি সব কিছুকেই মায়ের চোখ দিয়েই দেখতে শিখেছিলাম। অথচ মা বারবার বলতো, নিচে শিখে নাও, নিজে চিনে নাও, তোমাকে হাত ধরে আমি কিছুই করে দেব না। আমি তো চিরটাকাল থাকবো না।
ভীষণ ভাবে রেগে যেতাম, মায়ের কথা শুনে। মা হেসে বলতো, সবাই কে চলে যেতে হবে, আমাকেও।
আমি দুঃখে কেঁদে ফেললে, বলতো, মনকে শক্ত করো, চোখের জলটা মুছে ফেলো, সত্যিটাকে মেনে নিতে শেখো।

মা হয়তো, বুঝতে পারতো, সময় বেশী নেই।
আমি বুঝতে পারতাম না। বোঝার বয়স হয়তো হয়নি তখনো। আজও হয়নি।

বাড়িতে তখন একটা থমথমে পরিবেশ। মায়ের অপারেশন। আমি খালি শুনেছিলাম, হাড়টুকু বাদ দেওয়া হবে না সম্পূর্ণ পা টাই, সেই নিয়েই আলোচনা চলছে। টিউমারটা ক্রমশই বড়ো হচ্ছে।

একদিন, মা হাসপাতালে ভর্তি হলো। ঠিক হয়েছে, এবারের মতো, পা টাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে, কেবল মাত্র হাড়টাকে বাদ দেওয়া হবে।
তখন, ১৯৯২ সাল। এখনকার মতো, গুগল খুলে ইচ্ছে মতো ডাক্তারি করা যেত না।

অপারেশনের দিন, আমি গৃহবন্দি ছিলাম, স্বেচ্ছায়। একসময় সন্ধ্যার পর, অপারেশনের শেষে, সবাই বাড়ি ফিরল, একে একে। শুনলাম মা ভালো আছে। হাত নাড়াচাড়া করছে, চোখ খুলে চেয়েছে।
তারপর গভীর রাতে, খবর এসেছিলো, মা ভালো নেই।
আমাদের তখন, ফোন ছিল না। মাঝরাতে, কলকাতার রাস্তা তখন সুনসান করছে। আমি সাইকেল করে ছুটে ছিলাম, মায়ের 'খবর'কে খবর করতে, রাঙা মাসির বাড়ি। মাথায় তখন একটা কথাই ঘুরছে, মনকে শক্ত করো, সত্যিটাকে মেনে নিতে শেখো।
খুব ভোরবেলা মায়ের নিথর দেহটা বাড়ি এসেছিলো। চারপাশের হইচই, কান্নাকাটি কিছুই আমাকে স্পর্শ করছিল না। চোখের জল শুকিয়ে গেছিলো। মাথার মধ্যে ঘুরছিল, চোখের জল মুছে ফেলো, মনকে শক্ত করো।
আর কতো শক্ত করবো। আমার তো সব হারানোর দিন ছিল সেটা। সব কিছুই হারিয়ে যাচ্ছিল। চোখের সামনে।
বাবার চিৎকারটা মনে আছে। মনে আছে বলছিল, আমি সব ভাঙচুর করে এসেছি। ডাক্তারকে বলে এসেছি খুন করেছেন, আপনি। ভুল চিকিৎসা করেছেন।
ভয় পেয়েছিলাম বাবার গলা শুনে। ভীষণ ভয় পেতাম। খুব ভয় পেয়েছিলাম। নিজের জগতে আবার ফিরে গেছিলাম। সব হারানোর পর।

মা মারা যাবার ক'দিন পর থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম, কেন মা, ঘরের সমস্ত কাজ শেখাতে চাইতো। কারণ কেউ পাশে থাকে না।
মায়ের একটা কথা মনে পড়তো খুব। বলতো, আমার ইচ্ছা ছিল, তোদের দুজনের মধ্যে একজন ডাক্তার হ। খুব ভালো হয়।
আমি তখন, খেলা, গল্পের বই, কুইজ, লেখা নিয়ে ব্যস্ত। পড়াশোনার সময় কোথায়? টেনেটুনে পাশ।
আমি হাসতাম। আমি বলতাম, আমি ইতিহাস নিয়ে পড়বো না হলে বাংলা। আমাকে ডাক্তার হতে বোলো না।

কপালের ফেরে, মাধ্যমিক পাশ করে, 'সেই সাইন্স'। উচ্চমাধ্যমিকের পর একদিন ডাক্তার। প্রথমে খুব যে ইচ্ছে ছিল তা নয়। কিন্তু ততদিনে, মায়ের ইচ্ছেটা আমার মাথার মধ্যে, বুকের মধ্যে। অথচ ডাক্তারদের ভীষণ ঘৃণা করি। মাকে 'মেরে ফেলেছে'।

তখন, ছাত্র, ডাক্তারি পড়ছি, ২০০২। একদিন, আলমারির পুরনো কাগজপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ মায়ের চিকিৎসার যাবতীয় কাগজ পেলাম। খোঁজ করলাম কী রোগ? কী টিউমার? কী চিকিৎসা? কেন মারা গেল? কী ভুল ছিল?

একে একে সব বের হলো। পড়লাম। জানলাম। শিখলাম।
নাহ্, ডাক্তারবাবু কিছু ভুল করেননি। প্রথমবার যে অপারেশন করেছিলেন, সেটাও ঠিক। দ্বিতীয়বার যে অপারেশন করেছিলেন, সেটাও ঠিক। ভুল নেই। মা মারা গেছে। ডাক্তারের ভুলে না। কমপ্লিকেশনে। অপারেশন সঠিক হবার পরেও কমপ্লিকেশনে। "ফ্যাট এম্বোলিজম" এর জন্যে। কিচ্ছু করার ছিলো না ডাক্তারের। তাও এতগুলো বছর সেই মানুষটার সাথে সমস্ত ডাক্তারদের প্রতি এক বিদ্বেষ পুষে রেখেছিলাম। ২০০২ সাল। হ্যাঁ, দশ বছর। দশটা বছর একটা বিদ্বেষ পুষে রেখেছিলাম মনের মধ্যে।
দশ বছর পর প্রথমবারের মতো কেঁদেছিলাম। মায়ের জন্যে। আমার বিদ্বেষের জন্যে। সেই ডাক্তারের জন্যে। সমস্ত ডাক্তারের জন্যে।

হ্যাঁ, সারা জীবনে সেই দিন, সাহস করে বাবার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। বাবাকে বলেছিলাম, তুমি ভুল ছিলে। তুমি ভুল। ভাঙচুর করাটা তোমার অন্যায় হয়েছে।
সেই দিন ছিল আমার কাছে, পিতৃদিবস পালন। বাবার সামনে ছেলে হিসাবে প্রথমবারের জন্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছিলাম। বাবা কিছু বলেনি। মেনে নিয়েছিল।

ডাক্তারবাবুর চেম্বারের খোঁজ করেছিলাম। ঠিকানার খোঁজ করেছিলাম। ভেবেছিলাম ওনার সামনে দাঁড়িয়ে ভুল স্বীকার করে আসবো। কিন্তু সেই সুযোগ উনি দেন নি। হয়তো আরো বহু মানুষের ভুল চিকিৎসা করে, বছর তিনেক আগেই পরপারে চলে গেছেন।

দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, আমার ইন্টার্নশিপে, প্রথমবার যখন, রোগীর বাড়ির লোকেদের হাতে হেনস্থার মুখোমুখি হই, সেই রোগীও মারা গেছিলেন, ফ্যাট এম্বোলিজম এর জন্যে। মৃত্যু সত্যিই সময় দেয়না।
______________________
ডা. প্রলয় বসু
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়